আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে হারিয়ে গেলেন বাবু

তিন বছর আগে অপহৃত বাবাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন ওহিদুর রহমান বাবু (২২)। অথচ বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে গতকাল বাবু নিজেই হারিয়ে গেলেন চিরতরে। বাবু আর কোনো দিন বাবার ছবি হাতে নিয়ে কোনো পত্রিকা অফিসে ছুটে যাবেন না, খোঁজাখুঁজি করবেন না কোনো থানা কিংবা হাসপাতালে। এখন থেকে বাবুকেই আর খুঁজে পাবেন না কেউ। ঢাকা কলেজের ছাত্র বাবু দিনছয়েক আগে অবরোধের পেট্রলবোমায় দগ্ধ হন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে এ কদিন বাবু অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরিয়েছেন। তাকে বাঁচানোর চেষ্টার কমতি ছিল না চিকিৎসকদের। বাঁচার আকুতি ছিল বাবুরও। স্বজনদের প্রার্থনা ছিল বাবু ফিরবে। কিন্তু গতকাল ভোর সাড়ে ৪টায় সবাইকে ছেড়ে চলে যান বাবু।

এ কদিন তার শয্যাপাশে বসে ছেলের মাথায় মমতার পরশ বুলিয়ে দিতেন মা সালেহা বেগম। মায়ের মমতাও তাকে আটকাতে পারল না। এই মা তার আদরের ধনকে হারানোর জন্য এ দেশের রাজনীতি আর রাজনীতিকদের দায়ী করেছেন। তিনি এ দেশের রাজনীতিকে খুনি বলেছেন।

ঢাকা কলেজের ছাত্র ওহিদুর রহমান বাবু।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র। কলেজের শিক্ষক আর সহপাঠী বন্ধুদের কাছে প্রিয় বাবুর বাড়ি ছিল নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের অভিরামপুর গ্রামে। বাবার নাম ওজিউল্লাহ। তারা সপরিবারে বসবাস করতেন পুরান ঢাকার বংশালে। পরিবারে দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।

তিন বছর আগে তার অপহৃত হওয়ার পর থেকেই নিখোঁজ। বাবাকে হন্যে হয়ে খুঁজতেন, পুলিশের বিভিন্ন দফতর ও গণমাধ্যম কার্যালয়ে ছোটাছুটি করা ছিল বাবুর নিত্য দিনের রুটিন। ফেসবুকের মাধ্যমে গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে শেয়ার করতেন বাবা হারানোর কষ্ট-যন্ত্রণা। বাবার স্মৃতি ঘিরেই ছিল তার লেখালেখি। প্রায়ই বাবার ছবি বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে আপলোড করে তার সন্ধান কামনা করতেন।

কিন্তু কোথাও খোঁজ মেলেনি বাবার, তবুও হাল ছাড়েননি বাবু। বাবাকে ফিরে পাবেন এমন আশা নিয়েই প্রিয় মানুষটিকে খুঁজে ফিরতেন তিনি।

গত বৃহস্পতিবার। বিএনপির অবরোধ কর্মসূচির শেষ মুহূর্ত। এ সময় বিহঙ্গ পরিবহনে আসছিলেন কারওয়ান বাজারের উদ্দেশে।

শাহবাগ পেঁৗছালে দুর্বৃত্তরা পেট্রলবোমা ছোড়ে বাসটিতে। সেই আগুনে দগ্ধ হলেন বাবুসহ আরও ১৮ যাত্রী। এর আগে ওই বাসের আরোহী নাহিদ ও রবিন মারা যান বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। ওই ঘটনায় আহত আরও কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

বাবুদের এই অকাল যাত্রাকে মেনে নিতে পাচ্ছেন না কেউ।

গতকাল ওহিদুর রহমান বাবুর মৃত্যুর পর শোকে পাথর তার মা সালেহা বেগমকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন স্বজনেরা। মাঝেমধ্যেই তিনি হাহাকার করে উঠছিলেন। আর বলছিলেন, 'অ হুত তুই অাঁর আগে চলি গেলি? অাঁরে লই যাইতে হাইল্যি না!' পরিবারের সবার বড় বোন রোজিনা আক্তার বুক চাপড়িয়ে কাঁদছিলেন ভাই হারানোর বেদনায়। আর জঘন্য রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের থু থু দিচ্ছিলেন। পাশে বসা স্বজনরা তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

দেবরের শোকে বিলাপ করে চলেছেন ভাবী সানু আক্তার। ওহিদুরের লাশ দেখে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন ভগি্নপতি শোহায়েব। ঘটনার পর থেকে স্বজনরা বাবুর সুস্থ হয়ে ওঠার আশায় বার্ন ইউনিটের সামনে কাটিয়েছেন নির্ঘুম রাত। তার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে একে একে হাসপাতালে ছুটে আসেন স্বজন, বন্ধু, গণমাধ্যম কর্মী ও পরিচিতজনেরা। একে-অন্যকে জড়িয়ে ধরে ভেঙে পড়েন বুকফাটা কান্নায়।

স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে ঢাকা মেডিকেলের পরিবেশ। দুপুর ১২টায় বাবুর মরদেহের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের সামনে খোলা মাঠে। সেখানে শত শত ছাত্র এবং শিক্ষক ও স্বজনেরা অংশ নেন। এরপর লাশ নিয়ে রওনা দেওয়া হয় গ্রামের বাড়ি বেগমগঞ্জে। অবরোধের আগুনে শাহবাগে পুড়ে যাওয়া বিহঙ্গ পরিবহনের ঘটনায় ওহিদুর রহমান বাবুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিনজনে।

২৬ অক্টোবর থেকে গতকাল পর্যন্ত যানবাহনে অগি্নসংযোগের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১১ জন। প্রতিটি মৃত্যুতেই যেমন শোকের সাগরে ভাসছে পরিবার, তেমনি মারা যাওয়া অনেকে পরিবারের মধ্যে জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। তাই নিদারুণ বিপাকে পড়েছে এসব পরিবার।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।