বিচারকদের স্বাক্ষরের পর সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা বৃহস্পতিবার এই রায় প্রকাশ করে।
প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতির বেঞ্চ গত ১৭ সেপ্টেম্বর এই রায় ঘোষণা করে।
সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেয়া এই রায়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডাদেশের পক্ষে ছিলেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
অন্যদিকে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।
শুরুর দিকে বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া এই বেঞ্চে থাকলেও শুনানি চলাকালে তিনি অবসরে চলে যান।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মোট ছয়টি অভিযোগ বিবেচনায় নিয়ে পাঁচটি অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
যে একটি অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়েছিল বিচারিক আদালত, আপিলের রায়ে তাতে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে। অন্য চারটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের শাস্তিই বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ।
রায়ে বলা হয়, ষষ্ঠ অভিযোগে ৪:১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। মৃত্যু পর্যন্ত তাকে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।
ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ২৬ মার্চ কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে হযরত আলী লস্করের বাসায় যান। সেখানে কাদের মোল্লার নির্দেশে লস্করের স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা করা হয়। এক মেয়ে হন ধর্ষণের শিকার।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে কাদের মোল্লার মামলায়ই প্রথম চূড়ান্ত রায় হয়, যেখানে সর্বোচ্চ আদালত বিচারিক আদালতের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনের পর সংশোধিত আপিল আইনের আওতায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিত এই যুদ্ধাপরাধীর।
১৭ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণার পর গণজাগরণ মঞ্চসহ যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবির আন্দোলনকারীরা এই রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ইতোপূর্বে সংসদে দেয়া বক্তব্যে যুদ্ধাপরাধের রায় দ্রুত কার্যকরের কথা বলেন। তারপরও রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হতে আড়াই মাসেরও বেশি সময় লেগে গেল।
ওই রায় দেয়ার পর প্রাথমিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া না দিলেও পরে বিএনপির হাই কমান্ডে থাকা আইনজীবীরা সংবাদ সম্মেলন করে কাদের মোল্লাকে রিভিউ আবেদন করার সুযোগ দেয়ার দাবি জানান।
আপিল বিভাগের এই সংক্ষিপ্ত রায়ের পর ওই সময়কার আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ জানিয়েছিলেন, কাদের মোল্লার সামনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগই অবশিষ্ট রয়েছে।
শফিক আহমদের ওই বক্তব্যের পরও আসামি পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের দাবি, সংবিধান অনুযায়ী কাদের মোল্লাও রিভিউর সুযোগ পাবেন।
পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে ৩০ দিনের মধ্যে আপিল বিভাগে সেই আবেদন করবেন বলেও সে সময় জানিয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবীরা।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে একাত্তরে হত্যাকাণ্ডের একটি মামলায় ২০১০ সালের ১৩ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্ত শুরু হয়।
গত বছরের ২৮ মে বিচার শুরু করে গত ৫ মে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে সাজার রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
গণজাগরণ আন্দোলনের সূচনার দিন ৫ ফেব্রুয়ারি বিকাল। বিকালের এই জমায়েতই পরে লাখো মানুষের সমাবেশে পরিণত হয়।
সেদিন আদালত ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় জামায়াত নেতার দেখানো ‘ভি’ বা বিজয় চিহ্ন খবরে প্রকাশিত হওয়ার পর রাজধানীর তরুণরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে শাহবাগ মোড়ে জড়ো হয়ে বিরল এক সমাবেশের সৃষ্টি করে।
দেশ-বিদেশে ‘বাংলা বসন্ত’ নামে পরিচিতি পাওয়া সর্বস্তরের মানুষের অভূতপূর্ব এই অহিংস সমাবেশ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করার দাবি ওঠে।
তার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধন করে প্রসিকিউশন ও আসামি উভয় পক্ষের আপিলের সমান সুযোগ তৈরি করা হয়।
আগের আইনে শুধু আসামির খালাসের ক্ষেত্রেই প্রসিকিউশন আপিল করতে পারত।
আইন সংশোধনের পর প্রসিকিউশন সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে আপিল করে। সাজা থেকে অব্যাহতি চেয়ে আপিল করেন কাদের মোল্লা।
গত ১ এপ্রিল আপিলের শুনানি শুরু হয়। তখন আসামি পক্ষ প্রশ্ন তোলে, কাদের মোল্লার রায়ের পর আইন সংশোধন হওয়ায় তার ক্ষেত্রে সংশোধিত আইনের প্রয়োগ করা যাবে কি না।
এই বিষয়টির সুরাহায় অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের সাত আইনজীবীর বক্তব্য শুনে আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত নেয়, কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে সংশোধিত আইন কার্যকর হবে।
সাড়ে পাঁচ মাস শুনানির পর ১৭ সেপ্টেম্বর আসামি পক্ষের আপিল আবেদন খারিজ করে দিয়ে প্রসিকিউশনের আপিল আবেদন গ্রহণ করে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
মামলার ইতিবৃত্ত
মুক্তিযুদ্ধকালে মোস্তফা নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর কাদের মোল্লাসহ কয়েকজন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়।
এছাড়া ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরো একটি মামলা হয় কাদেরের বিরুদ্ধে। এ মামলাতেই ২০১০ সালের ১৩ জুলাই জামায়াতের এই নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০১১ সালের ১ নভেম্বর কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যা, খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর ২৮ ডিসেম্বর অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।
গতবছর ২৮ মে ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি ঘটনায় তার বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক।
দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে। এর পক্ষকাল পর কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল।
কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আপিলের ক্ষেত্রে যে অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য শোনে আদালত, তারা হলেন- রফিক-উল হক, এম আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম, টি এইচ খান, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আজমালুল হোসেন কিউসি ও এ এফ হাসান আরিফ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।