(এ লেখাটি এ বছর প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটি ব্যক্তি, রাজনীতিক, রাষ্ট্রনেতা সর্বোপরি মানুষ হিসেবে নেলসন ম্যান্ডেলাকে আবার পাঠকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবে। ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে তাঁর প্রতি প্রথম আলোর শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো। )
মানুষ হিসেবে আমরা অনেকে যার যার কল্পলোকে সত্যিকারের এক নায়কের স্বপ্ন দেখি। বর্তমান সময়ে সব বিচার শেষে নেলসন ম্যান্ডেলাই সত্যিকারের সেই নায়ক হিসেবে আমাদের সামনে প্রতিভাত হন।
সদা হাস্যোজ্জ্বল, আত্মত্যাগের মহান প্রতীক নেলসন ম্যান্ডেলা এখন বিশ্বের লক্ষ-কোটি মানুষের কাছে পুণ্যবান (saint), পরিপূর্ণ এক মানুষের নাম।
খুব শক্ত মনের মানুষ নেলসন ম্যান্ডেলা। কিন্তু খুব সহজেই তিনি ব্যথিত হন। তাঁর মধ্যেও রয়েছে অনেক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। ছোট্ট প্রজাপতিও হয়তো তাঁর দ্বারা কষ্ট পাবে না, কিন্তু তিনিই আবার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সামরিক শাখার প্রথম প্রধান ছিলেন! একদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের সত্যিকারের নেতা, অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত সেলিব্রেটি তিনি।
যিনি সবাইকে আনন্দ দিতে চান, আবার কাউকে ‘না’ বলতেও দ্বিধা করেন না। তিনি কৃতিত্ব নিতে চান না। কিন্তু জেনে যান, কখন তিনি সেটা পাবেন। তিনি রান্নাঘরের সকলের সঙ্গেও হাত মেলান, আবার নিজের দেহরক্ষীদেরও চিনতে পারেন না। বর্ণবাদবিরোধী কৃষ্ণাঙ্গ এই নেতা প্রেসিডেন্ট হলে অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও নিজের প্রধান দেহরক্ষী নিযুক্ত করেন একজন শ্বেতাঙ্গকে।
এত বড় জীবনের ক্যানভাস যাঁর, সেই ম্যান্ডেলার রয়েছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের প্রতিও তীক্ষ দৃষ্টি। তিনি যদি একটি টিস্যু হাতে তোলেন টিস্যুবক্স থেকে, অত্যন্ত সুচারুভাবে তা ভাঁজ করে ঢুকিয়ে নেন বুকপকেটে। জেলখানায় থাকা অবস্থায় যত চিঠি পেয়েছেন—পাওয়া আর উত্তর দেওয়ার তারিখসহ লিখে রেখেছেন ডায়েরিতে। উত্তরে কী লিখেছেন, তা-ও কপি করে রেখেছেন ডায়েরির পাতায়। কখনো কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে তিনি বিলম্ব করেননি।
সময়ানুবর্তিতার ব্যর্থতাকে তিনি মনে করেন চরিত্রের দুর্বলতা।
২৭ বছরের কারাজীবন থেকে বেরিয়ে তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসকে (এএনসি) নতুন করে সংগঠিত করেছেন। বহুবিধ সংকট-সন্ত্রাস-আক্রমণ-বিপদের খাদ পেরিয়ে ম্যান্ডেলা দেশের প্রথম সাধারণ নির্বচনের পর শ্বেতাঙ্গদের দল ও উগ্র অশ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে জাতীয় ঐকমত্যের গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করেন। একই সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম অশ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করেন। খুব অল্প সময়েই দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বের বুকে একটি সম্মানজনক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে মাত্র এক মেয়াদ সম্পন্ন করেই প্রেসিডেন্টের পদ থেকে বিদায় নেন নেলসন ম্যান্ডেলা।
এই স্বল্প সময় রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে দক্ষিণ আফ্রিকার চরম বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থাকে তিনি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় উন্নীত করেন, যাতে প্রতিফলন ঘটে তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা আর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার। তিনি ‘এক নতুন দক্ষিণ আফ্রিকা’ গড়ে তোলার পথ উন্মুক্ত করেছেন।
কলেজে অধ্যয়নকালেই তিনি সক্রিয় হয়েছিলেন বর্ণবাদবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে। সেই থেকে জীবনের এক পর্ব থেকে আরেক পর্ব কেটেছে তাঁর জেল-জুলুম, সংগ্রাম আর সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতির পেছনে। জীবনের এক বাঁকে ২৭ বছর তাঁকে কারা ভোগ করতে হয় রববেন দ্বীপের কারাগারসহ অন্যান্য কারাগারে।
নেলসন ম্যান্ডেলা বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় রাষ্ট্রনেতা, যিনি নিজেকে জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একজন পিতা, একজন স্বামী, একজন দাদা, একজন নানা, একজন বন্ধু—এভাবে তিনি একজন সম্মানিত মানুষ বিশ্বের সর্বত্র।
১৯৯০ সালে জেল থেকে মুক্ত হয়ে আসার পর বিগত দুই দশকে অসংখ্য প্রকাশনা, ব্যাপক প্রচার আর বহুমুখী আলোচনায় এসেছেন তিনি। ১৯৯৪ সালে তাঁর আত্মজীবনী লং ওয়াক টু ফিডম প্রকাশের পর থেকে এখন পর্যন্ত এটি সারা বিশ্বে সর্বাধিক বিক্রীত বই হিসেবে সমাদৃত। এ ছাড়া তাঁর অফিস থেকে, তাঁর ফাউন্ডেশন থেকে শত শত বক্তৃতা, বিবৃতি আর বাণী দিয়েছেন তিনি।
আরও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই কনভারসেশন উইথ মাইসেল্ফ্: নেলসন ম্যান্ডেলা ও নেলসন ম্যান্ডেলা: ইন বিজ ঔন ওয়ার্ডস।
এই বই দুটিতে সংকলিত ম্যান্ডেলার চিঠিপত্র, নোটবই, সাক্ষাত্কার ও ভাষণের খণ্ড খণ্ড অংশ সাজিয়ে তুলে ধরা হলো তাঁর সারা জীবনের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির কথা।
নিজেকে নিয়ে ম্যান্ডেলা
আত্মজীবনীর অহমিকা
আমি কিছুতেই আমাদের প্রতিজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হব না—কোনো পরিস্থিতিতেই আমি অন্যের জন্য অপ্রীতিকর কিছু বলব না...। তবে অসুবিধা একটা আছে, অধিকাংশ সফল মানুষই, কোনো না কোনো অহমিকাবোধের শিকারে পরিণত হয়। তাঁদের জীবনে এমন একটা পর্যায় আসে, যখন তাঁরা ভাবেন যে, তাঁদের অসাধারণ সফলতার কারণে জনগণের কাছে দাম্ভিক আত্মপ্রচারণা করা যেতেই পারে।
আত্মপ্রশংসার মনোভাবটি গোপন রাখতে ইংরেজি ভাষায় কী চমত্কার একটি শব্দ সৃষ্টি করা হয়েছে। তাঁরা একে ‘আত্মজীবনী’ বলতে ভালোবাসেন, যেখানে অনেক সময়ই অপরের অক্ষমতার বিপরীতে লেখক নিজেই নিজের প্রশংসনীয় সব সাফল্যের বিশদ বর্ণনা করতে পারেন। আমি আদৌ আমার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে লিখতে বসব কি না, সে বিষয়ে আমার নিজেরই যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমার এমন কোনো অর্জন নেই, যা নিয়ে গৌরব করতে পারি। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে আমার দক্ষতাও নেই।
জীবনের প্রতিটি দিন আয়েশহীনভাবে কাটালেও আত্মজীবনী লেখার চেষ্টা করার মতো সাহস আমার নেই।
মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি যথার্থই একটি মাঝারি মানের মানুষকে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করছে। কোনো কিছুই আমাকে আত্মপ্রচারণায় প্রলুব্ধ করতে পারবে না। আত্মজীবনী লিখতে পারলেও হয়তো সেটির প্রকাশ আমার অস্থি মাটিতে মিশে যাওয়ার আগ পর্যন্তই বিলম্বিত হতো, আর তাতে হয়তো আমার প্রতিজ্ঞার বিপরীত কোনো ইঙ্গিতও থাকতে পারত।
মৃত ব্যক্তিদের কোনো উদ্বেগ থাকে না, যদি তাদের সম্পর্কে সব সত্য উদ্ঘাটিতও হয়ে যায়।
আজীবন নীরবতার ভেতর দিয়ে আমি যা রক্ষা করেছি, তা যদি ধ্বংসও হয়ে যায়, সে দায় পরবর্তী প্রজন্মের কাঁধেই বর্তাবে, আমাদের নয়। আমি তেমনই একজন মানুষ, বহু বিচিত্র বিষয়ে যার ভাসা ভাসা তথ্য জানা রয়েছে, কিন্তু দেশ ও জনগণের ইতিহাস-সম্পর্কিত যে বিষয়টিতে বিশেষজ্ঞ হওয়া উচিত ছিল, তাতেও আমার গভীর কোনো জ্ঞান নেই।
ফাতিমা মীরকে ১ ১ মার্চ ১৯৭১-এ লেখা চিঠি
বিয়ে থেকে পালিয়ে
গোষ্ঠীপতি হওয়ার জন্য আমাকে প্রস্তুত করা হচ্ছিল,...কিন্তু আপনি জানেন, একটি বাধ্যতামূলক বিয়ের উদ্যোগ থেকে রক্ষা পেতে আমাকে সেদিন পালিয়ে যেতে হয়েছিল...। ২ ঘটনাটি আমার জীবনের পথটাকেই পাল্টে দিয়েছিল। আপনি কি জানেন, সেদিন আমি যদি বাড়িতেই থাকতাম, তাহলে এত দিনে একজন সম্মানিত গোষ্ঠীপতি হয়ে যেতে পারতাম? আমার একটা বিরাট ভুঁড়ি থাকত, আর থাকত প্রচুর গরু-মহিষ আর ভেড়া।
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের৩ সঙ্গে আলাপচারিতা
দেশি সাহিত্য
অধিকাংশ মানুষই তাদের অতীত জীবনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। ২৩ বছর বয়স পর্যন্ত আমি একটা পল্লিতে বেড়ে উঠেছি, তার পর আমি গ্রাম ছেড়ে জোহানেসবার্গে চলে আসি। তখন অবশ্য আমার অধিকাংশ সময়ই স্কুলে কাটত। শুধু জুন আর ডিসেম্বরের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পেতাম। জুন মাসে মাত্র এক মাস আর ডিসেম্বরে প্রায় দুই মাসের ছুটি পেতাম।
তাই বছরের অধিকাংশ সময়ই স্কুলে থাকতে হতো। ২৩ বছর বয়সে ১৯৪১ সালে জোহানেসবার্গে চলে আসার পর থেকেই আমি পাশ্চাত্য জীবনধারা ও আনুষঙ্গিক নানা বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে শুরু করি। কিন্তু গ্রামে থাকতেই আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল, আর তাই আপনি লক্ষ করে থাকবেন যে, আমাদের নিজস্ব দেশজ সংস্কৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে।
অবশ্য পাশ্চাত্য সংস্কৃতি এমন একটা বিষয়, যা ছাড়া আমরা বাঁচতেও পারি না। সুতরাং আমি এ দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির আবহেই প্রভাবিত হয়েছি।
আমি যদি বলি যে, পাশ্চাত্য ধারা আমার অস্বাভাবিক মনে হয়, তাহলে অসততা হবে, আমাদের জনগোষ্ঠীর অনেকেই এর দ্বারা প্রভাবিত। আমি নিজেও ইংরেজিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কারণ, অনেকগুলো বছর এখানেই কেটেছে আমার, কাটাতে হয়েছে জেলখানাতেও। সত্যি বলতে কী, জোসা সাহিত্যের সঙ্গে আমি আমার সংযোগটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম। অবসর গ্রহণের পর আমি আফ্রিকার সাহিত্যসহ বিভিন্ন সাহিত্য পাঠের সুযোগ পাব বলে আশা করছি।
যে বিষয়গুলোর জন্য আমি সবচেয়ে বেশি অপেক্ষা করে আছি, এটি তার একটি। জোসা ও সোথো সাহিত্য আমি পড়তে পারি, পড়তে পছন্দও করি। ৪ কিন্তু রাজনৈতিক ব্যস্ততার কারণে আমি কিছুই পড়তে পারিনি। এ জন্য আমার অনেক বেদনাবোধ রয়েছে।
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে আলাপচারিতা
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।