আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প - বাজী

মোটাসোটা - গোলমুখ - চোখ ছোট একজন মানুষ

আপনাদের মনে থাকতে পারে মাস খানেক আগে সকাল সকাল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পত্রিকার পাতা উল্টাতে গিয়ে অনেকেই কাপটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে নিজের কাপড় নষ্ট করেছিলেন। যারা নষ্ট করেছিলেন তারা তো বুঝবেন কোন খবরটার কথা বলছি। আর যারা ব্যাপারটা ধরতে পারেন নাই তাদের বলছি ঠিক দু’মাস আগে পত্রিকার পেছনের পাতায় একটা চমকে যাবার মত ব্যাপার ছিল। আপনাদের নজরে কি এসেছিল? না আসলে পুরানো পত্রিকাটা বের করে দেখুন। কি আছে শেষের পাতায়? উল্টে থাকা ট্রেনের ছবি? জ্বলন্ত বাসের ছবি? পোড়া কিংবা সারা শরীরে রক্ত মেখে দৌড়ের উপর থাকা মানুষের ছবি? নাকি দু’জন মানুষের এক সাথে বসে চা খাবার ফটোগ্রাফ? না।

এগুলোর কোনটাই ছিল না। বরং এক কোনায় একটা বিজ্ঞাপন দেখতে পাবেন। বিজ্ঞাপনটা সাদা-কালো। ওতে লাস্যময়ী তরুনীর ছবি নাই। ধুম-ধাড়াক্কা অফার নাই।

বিজ্ঞাপনটার ভাষা সাদামাটা। কেউ একজন বাজী ধরেছেন। আগামীকাল সকাল সাড়ে দশটার পর চলমান অবরোধের ভেতর একটা সাদা গাড়ি রাস্তায় চলাচল করবে। গাড়ির মালিক হিসেবে আমি বাজী ধরছি অবরোধের ভেতর আমার গাড়িতে কেউ আগুন লাগাতে পারবে না। যদি কোন উৎসাহী পিকেটার গাড়িতে আগুন লাগিয়ে গাড়িটাকে অগ্নিদগ্ধ করতে পারেন তবে তার জন্য রয়েছে দশ লাখ টাকার বিশেষ পুরষ্কার।

পুরষ্কারের অর্থ স্বনাম ধন্য আইনজীবী ব্যারিষ্টর শফিক উল হকের কাছে গচ্ছিত আছে। পিকেটারের নাম পরিচয় গোপন রাখা হবে। এবার বলেন এমন বিজ্ঞাপনটা পড়ে যদি আপনার হাত থেকে চায়ের কাপটা পড়ে নাই যায় তবে আপনার চমকে যাবার ক্ষমতাটা অনেক আগেই হয়ত নষ্ট হয়ে গেছে। চমকে যাবার ক্ষমতা নষ্ট হতে পারে কিন্তু মানুষের কৌতহূলের মৃত্যু হয় না। সেই কৌতহূল নিবারনের জন্য সেদিনই সম্পাদক মশাইয়ের স্পেশাল হুকুমে এ শহরের যে ডজন খানেক সাংবাদিক একজন মানুষকে খুঁজে বেড়িয়েছে তার ভেতর আমিও ছিলাম।

মানুষটির নাম শবনম বারী। জ্বি। বিজ্ঞাপনদাতা একজন মহিলা। অনেক খোঁজ করে, সাধ্য সাধনা করে আইনজীবীর অফিসের জুনিয়রের কাছ থেকে কেবল নামটা পাওয়া গেছে। প্রথমেই যে বিষয়টা সাংবাদিকরা খতিয়ে দেখেছিল তা হল এ মহিলা কে? এ প্রশ্নের কোন উত্তর পাওয়া যায় নাই।

কারন বিজ্ঞাপনটা দেয়া হয়েছিল ব্যারিষ্টার শফিক উল হকের অফিস থেকে। আইনজীবী এবং গ্রাহকের গোপনীয়তার শর্ত হিসেবে ব্যারিষ্টার সাহেবের অফিস থেকে এ ব্যাপারে কোন তথ্যই পাওয়া গেল না। ব্যারিষ্টার সাহেবের মোবাইলে কয়েক শত বার চেষ্টা করেও কেবল কয়েক শত বার দুঃখিত কথা ছাড়া আর কোন কথাই শোনা গেল না। ব্যারিষ্টার সাহেব দেশে নাই। এ মহিলা কি আগে কখনও খবরের সাবজেক্ট হয়েছিল? গুগল, পিপিলীকা সার্চ ইঞ্জিন অসংখ্য শবনম বারীকে হাজির করেছে কিন্তু সবগুলোই ফেসবুকের শবনম বারী।

ওর মধ্যে কোনটি নকল শবনম আর কোনটিই বা আমাদের বিজ্ঞাপনদাতা শবনম তার উত্তর গুগল বা পিপিলীকা কারও কাছেই নাই। বেশ কিছু পুরাতন খবরের কাগজ ঘেঁটেও কিছু জানা গেল না। হয়ত মহিলা সাবজেক্ট ছিল। হয়ত না। যদি কখনও হৈ-চৈ যদি বাঁধিয়ে থাকত তবে তা নিশ্চয়ই কেউ না কেউ মনে করতে পারত।

কেউ কেউ বলে মহিলা কি মানসিক রোগী? সেদিন শহরের বড় বড় পাগলের ডাক্তাররা রাতের অন্ধকারে চীৎকার করতে থাকা মোবাইল, টিএন্ডটির জ্বালায় পাগল হয়ে উঠলেন। ডাক্তার সাহেব আমি ওমুক পত্রিকা থেকে বলছি। শবনম বারীকে আপনি চেনেন? যে সব ডাক্তারমশাইরা নিজেরাই ফোন ধরলেন তারা ভদ্রভাষায় বললেন, না। চিনি না। ফোনটা রাখতে না রাখতেই আবার রিং।

এবার তমুক পত্রিকা করেছে। একই উত্তর দিতে দিতে ডাক্তারের ভদ্র মার্জিত গলা হিং¯্র আর অভদ্র হয়ে উঠে। কেউ কেউ মোবাইল অফ করে, টিএন্ডটির তার খুলে পুনরায় বিছানায় ফেরৎ গেলেন। আর যে জায়গায় ডাক্তার সাহেবের জায়গায় তার বেগমরা ধরলেন, তারা পুরো কথাটা শোনা আগেই ঠকাস করে ফোনটা রেখে দিয়ে বিছানা থেকে সাহেবকে তুলে থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করল, শবনম কে? পাগলের ডাক্তারীর ভেতর এসব লটর-পটর কবে থেকে করছ? বেচারা স্বামীরা ঘুম থেকে উঠে কি টেলিফোন সামলাবে না বৌ সামলাবে তা ভেবে পায় না । তাদের ব্যস্ততার ভেতর দিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় শবনম বারী নামের কোন মানসিক রোগীর চিকিৎসা তারা করাননি।

শবনম বারী কি নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন ? নাকি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন ? প্রতিবাদী তরুনী হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখাতে চাচ্ছেন? এ যাত্রায় যাদের সাথে যোগাযোগ করা হয় তারা অবশ্য যোগাযোগে বেশ খুশি হন। হ্যাঁ। শবনম বারীকে চিনি। তার পুরো বংশ সে প্রাচীনকাল থেকে আমাদের আর্দশের ধারক ও বাহক। সন্ত্রাসী, খুনীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে সে প্রমান করতে চলেছে ঢাকার রাজপথ আজও নিরাপদ।

কোন শবনমের কথা বলছিলেন জানি? সুন্দরী শবনম না কৃষাঙ্গ শবনম? শবনম ওদের চর। আমাদের শান্তি প্রিয় পিকেটারদের উস্কানী দিয়ে গাড়িতে আগুন জ্বালাবার প্ররোচনা দেবার জন্য শবনমের উপযুক্ত বিচার চাই। কোন শবনমের কথা জানি জিজ্ঞেস করলেণ? মোটা শবনম না স্লিম শবনম? শবনম বারী আমাদের রাজপথের সৈনিক। রাস্তায় গাড়ি নামিয়ে সে এটাই প্রমান করবে এদেশের মানুষ আজ রাস্তায় গাড়ি চায় না। চায় না।

চায় না। এক ফুট রাস্তা পেরুবার আগেই শবনমের গাড়ি পুড়িয়ে জনতা এটাই প্রমান করবে গাড়ির চাকা ঘুরবে না। তা কোন শবনম গাড়ি চালাবে? বেঁটে শবনম? লম্বা শবনম? বুর্জোয়া প্রতিনিধির খামখেয়ালীপনার এক চূড়ান্ত উদাহরন শবনম। আপনি যদি সেই বাস্তিল দুর্গ পতন থেকে এখন পর্যন্ত মেহনতি মানুষের যে আন্দোলন হয়েছে তা খেয়াল করেন তবে দেখবেন যুগে যুগে শবনমরা সব সময় তাদের আভিজাত্যের প্রতীকগুলো দিয়ে শ্রমজীবীদের অপমান করে চলেছে। লক্ষ্য করলে দেখবেন এ শহরের হাজার হাজার মানুষ যখন পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরছে তখন শবনমরা পুলিশ প্রহরায় গাড়ি চালিয়ে সুবিধাভোগী শ্রেনীর ভোগবাদিতার চূড়ান্ত উদাহরন তৈরী করবে।

কোন শবনম জানি? উত্তরার শবনম না ইংলিশ রোডের শবনম? শবনম বারীর কোন পরিচয় বের না হওয়ায় পরদিন সবাই অবরোধ, হরতালের ভেতর সাদা গাড়ির দিকে খুব সাবধানে নজর রেখেছিল। অন্যদিনের তুলনায় সেদিন বোধ করি ও বিজ্ঞাপনটার জন্যই সাদা গাড়িতে আগুন দেবার ঘটনাও বেশী ঘটে। এসব ঘটনায় সেদিন মৃতের সংখ্যা দশ। এর ভেতর দুজন মহিলা। পুলিশ , সাংবাদিক সবাই তন্ন তন্ন করে মহিলা দুজনের পরিচয় বের করে।

একজনের নাম রোকেয়া আক্তার। আরেক জন হোসনে আরা বেগম। হোসনে আরা বেগমের নাম আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। অন্তঃসত্ত্বা একজন মহিলা যে মাত্র সেদিনই বিদেশ থেকে দেশে এসে আগুনে মারা গেল সে সংবাদের মানবিক দিকটা কি ভয়াবহ ভাবে আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছিল সে স্মৃতি তো একেবারে তরতাজা। শবনম বারী নামে কেউ ছিল না।

তবে কি শবনম বারী বেঁচে গেলেন? এমন বিজ্ঞাপন ছাপার জন্য আমাদের পত্রিকাগুলোর সাংবাদিকতার রীতি নিয়ে বেশ সমালোচনা আপনারাই করেছেন। ব্যারিষ্টার শফিক উল হককে এবার মোবাইলে পাওয়া গেল। প্র্যাকটিকাল জোক। কেউ আমার নাম দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্র্যাকটিক্যাল জোক করেছে। পুরো ব্যাপারটাই একটা ধাপ্পাবাজী।

তবে গোপন সূত্রে আমরা জানি এটা ধাপ্পাবাজী না। বিরাট অংকের অর্থেও লোভে সম্পাদক মশাইয়রা যেমন কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে বিজ্ঞাপনটা ছাপিয়ে ছিলেন ঠিক তেমনি লোভে ব্যারিষ্টার সাহেবের মত ঝানু মানুষও জড়িয়ে পড়েছিলেন। ব্যাপারটা ওখানেই চাপা পড়ে যেত। দু’চারদিন টক অব দ্যা টাউন থাকার পর অন্যান্য খবরের ভিড়ে এটা হারিয়ে যেত। আমিও সচরাচর অন্যান্য ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত পড়তাম।

কিন্তু হোসনে আরার ব্যাপারটা আমিই আপনাদের ভুলতে দেই নাই। হোসনে আরা বেগম আমার বন্ধু পতœী। বন্ধু সাজ্জাদ বিয়ে করেছিল দু’বছর হয়। ভাবী অসম্ভব ভাল মানুষ। শাররীক ভাবে একটা খুঁত ছিল ভাবীর।

ভাবী কানে শুনতেন না, কথা বলতে পারতেন না। ব্যাপারটা বংশগত। তাদের নতুন অতিথির খবর আমি জানতাম। খবরটা জানার পর সাজ্জাদ এমন খুশি যে একেবারে মিষ্টি নিয়ে অফিসে হাজির। ভাবী মেডিকেল চেকআপ শেষে সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার সময় এমন একটা হৃদয়বিদারক ঘটনা।

এমন ঘটনা তো ভোলা যায় না। ওদের জন্য বুকে পাথর বেঁধে শোক গাথা লিখলাম। লেখাটা ভালই হয়েছিল। কারন সেদিন পত্রিকার বিক্রি হয়েছিল প্রচুর। অনলাইনেও লাইক, শেয়ার কম পেলাম না।

ঘটনার দু’মাস পর আপনাদের কাছে আবার কেন পুরানো ব্যাপার তুলে ধরছি তা ভাবছেন? একটু আগে রমনা থানার ওসি এসেছিল বাসায়। চুপচাপ বসে থেকে উঠে যাবার সময় একটা চিঠি রেখে গেল। তিনি চলে যাবার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব পালন করার জন্য লেখতে বসেছি। কিভাবে লিখব তা বুঝে উঠতে পারছি না এখনও। তাই দু’মাস আগে থেকেই শুরু করলাম।

আমার সামনে একটা খোলা চিঠি। চিঠিটা আপনাদের জন্য হুবহু তুলে দিলাম। রাশেদ, তোকে কখনও চিঠি লেখি নাই। সত্যি বলতে চিঠিটা যে তোকে লিখব তাও প্রথমে ভাবি নাই। শেষমেষ দেখলাম তুই ছাড়া আর কেউ এ চিঠির কথা সবাইকে জানাতে পারবে না।

সবাই যখন জানবে তখন অবশ্য আমি থাকব না। তোর হাতে চিঠিটা পৌঁছাবার আগেই আমি দেশ ছেড়ে চলে যাব। আজ তোকে একটা সত্য কথা বলি। আমাকে লোভে পেয়ে বসেছিল। লোভে না পরলে কেউ কি জেনে শুনে হোসনে আরা বেগমের মত মেয়েকে বিয়ে করতে পারে? আমি একজন কানে না শোন শাররীক প্রতিবন্ধীকে জেনে-শুনে বিয়ে করছি তাতে তোদের চোখে হয়ত দু-চার সেকেন্ডর এর জন্য মহান মানুষ হতে পারি কিন্তু আমার চোখে তো আমি একজন লোভী মানুষ।

হোসনে আরার বাবার কোটি কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স আমি জানতাম। ব্যাংকে চাকুরি করার সুবাদে তিনি যখন প্রায়ই আমার টেবিলের সামনে এসে বসত তখন থেকেই তার টাকার প্রতি আমার নজর। তার সব টাকার উত্তরাধিকারী ছিলেন কেবল একজন। হোসনে আরা বেগম। একমাত্র মেয়ে।

পাশের টেবিলের গফুর সাহেবকে তো তুই দেখেছিলি। ওই যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি আর মুনাফার কাজটা যিনি দেখতেন। তিনি মাঝে মাঝে বলতেন আমজাদ সাহেব বড় ভাগ্যবান। হোসনে আরার বাবার নাম আমজাদ হোসেন। কিভাবে ভাগ্যবান? আরে ভাই আমজাদ সাহেব আগে একটা প্রাইমারী স্কুলে মাষ্টারী করত।

যে বাড়িতে লজিং থাকতেন তাদের ছিল একটি মাত্র মেয়ে। ও মেয়েকে বিয়ে করেই তো আজ তিনি শ্বশুরের সম্পদে কোটিপতি। দুঃখের কথা একটাই। বৌয়ের মত মেয়েটাও কানে শুনে না। অবশ্য বৌ যদি কানে শুনত তবে তার আর ও বাড়িতে বিয়ে হত না।

শ্বশুর নিজেই মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে আমজাদ সাহেবকে ঘরজামাই করে রাখলেন। সেই যে তার ভাগ্য ফিরল আর ওটা তাকে হতাশ করে নাই। এখন অবশ্য মেয়েটাকে নিয়ে বড় কষ্টে আছেন। কেন? বোবা- কালা মেয়ে নিয়ে সংসার করার কষ্ট তো তিনি জানেন। যার সাথে মেয়েটাকে বিয়ে দেবেন সে তাকে যতœ করবে তো? তাই বড় দুঃশ্চিন্তায় আছেন।

আপনি তো বিয়ে করেন নাই সাজ্জাদ সাহেব। করবেন নাকি? ব্যবস্থা করি। রাজকন্যা না পেলেও রাজত্ব পাবেন। ঠাট্টার সুরে শেষ কথাটা বলেছিলেন তিনি। তাকে অবাক করে আমি রাজী।

বিয়ে হয়ে গেল। সংসার শুরু হল। তোর ভাবীর ও শাররীক খুঁত ছাড়া আর কোন খুঁত নাই। আমরা সুখেই ছিলাম। সমস্যা একটাই।

তোর ভাবী বাচ্চা নিতে চাইত না। বলতে তো পারে না। লিখে দিত। আমি পড়তাম। যদি আমার বাচ্চাটাও যদি আমার মত হয়? কানে না শোনে।

কথা না বলতে পারে। আমার ভয় লাগে। আমি চুপ করে যেতাম। টের পেতাম ওর বাচ্চা নেবার ইচ্ছেটা ষোলআনা। কেবল ভবিষৎ্যতের চিন্তায় নিতে চায় না।

উপরওয়ালার ইচ্ছেটা অন্যরকম। একদিন ও টের পেল ওর শরীরে নতুন মানুষের অস্তিত্ব। কথাটা জানার পর আমি যে কি খুশি হয়েছিলাম তা তো তোর মনে আছে। দিন যায়। তোর ভাবীর উৎকন্ঠা বাড়ে।

আমার ভেতরও উৎকন্ঠার জন্ম হয়। বাচ্চাটা স্বাভাবিক হবে তো? নাকি ওর মত . . ? শেষটুকু চিন্তা করতে পারতাম না। আমি নিম্ম মধ্যবিত্ত থেকে বড় হয়েছি। আজ ঘর জামাই থেকে দুটো পয়সার মুখ দেখেছি কিন্তু তাই বলে মধ্যবিত্তের চিন্তাটা তো ত্যাগ করতে পারি নাই। এ কি ওর বংশের কোন পাপের ফল? ওদের জাত সম্পর্কে কতটুকু জানি আমি।

পয়সা আছে কিন্তু ওদের জাতটা কি? এসব চিন্তায় রাতে আমার ঘুম হত না। তোর ভাবী ব্যাপারটা টের পেয়েছিল। বোবাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নাকি খুব প্রখর। তাই হয়ত প্রস্তাব করেছিল অ্যাবরশন করবে। কিন্তু আমি রাজী হই নাই ।

অথচ মনের গহীনে আমিও চাইতাম অ্যাবরশন। জোর করে তোর ভাবীকে সিঙ্গাপুর পাঠালাম ওখানের ডাক্তাররা যদি আমাদের বাচ্চাটা নিয়ে কিছু ধারনা দিতে পারে। সেখান থেকেই জানলাম খবরটা। আমাদের বাচ্চাটাও বোবা হবে। তোর ভাবীর বংশের ডিএনএ এর জিনবাহিত কারনেই ওর বাচ্চাটা বোবা হবে।

খবরটা শোনার পর আমি স্থির থাকতে পারলাম না। কোন কাজ করতে পারি না। আমার বাচ্চা বোবা হবে? একটা প্রতিবন্ধী সন্তানকে টেনে নিয়ে চলতে হবে আমার সারা জীবন? বাচ্চা ছেলে হোক বা মেয়ে, ওকেও তো বিয়ে করবে আমার মতই কোন সুযোগ সন্ধানী। অ্যাবরশন করে বাচ্চাটা ফেলে দেয়ার সময় এর ভেতরই পার হয়ে গেছে। পুরো ব্যাপারটার জন্য দায়ী করলাম হোসনে আরাকে।

ওকে সাথে নিয়ে সারাজীবন চলতে পারব না। তাই সরিয়ে দেবার প্ল্যান করলাম। তোর মনে থাকতে পারে মাস দুয়েক আগে পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন এসেছিল। অবরোধের ভেতর সাদা গাড়ি চলবে। যারা আগুন দিতে পারবে তারা পাবে পুরষ্কার।

ওটা আমার দেয়া বিজ্ঞাপন। শবনম বারী বলে কেউ ছিল না। আমার বিজ্ঞাপনে ঢাকা শহরের সাদা গাড়িগুলো পুড়তে শুরু করে। অনেকে টাকার জন্যই গাড়িতে আগুন দিয়েছিল। ওরা টাকাটা অবশ্য পায় নাই।

তবে আমি টাকাটা দিয়েছিলাম। পুরো দশ লাখ টাকা নিয়ে ওরা তোর ভাবীকে যে গাড়িটা আনতে গিয়েছিল ওতে আগুন দিল। পুড়ে শেষ হয়ে গেল হোসেনে আরা আর সেই সাথে নবাগত আপদটা। আমাকে পিশাচ ভাবতে পারিস কিন্তু নিজের পরিকল্পনায় সেদিন আমি নিজেই নিজেকে বাহবা দিয়েছি। কিন্তু হোসনে আরা আমাকে ছাড়ল না।

যে বাজীতে অন্যকে জিতিয়ে দিয়ে আমি জিতে গিয়েছিলাম বলে ভেবেছি সেই বাজীতে আমি আসলে হেরে গেলাম। প্রতি রাতে ও তার বাচ্চাটাকে নিয়ে আমার কাছে আসে। বলে, দেখ বাচ্চাটা তো কানে শুনে। কথা বলে। তুমি আমাকে মারবে ভাল কথা কিন্তু আমার সুস্থ বাচ্চাটাকে কেন পুড়িয়ে দিলে? সত্যিই কি বাচ্চা শুনতে পেত? কথা বলতে পারত? আমি ঘুমাতে পারি না।

কারও সাথে কথাগুলো বলতে হালকা হতে পারি না। গত দুমাস ধরে আমি খেতে পারি না। মাংস দেখলে চীৎকার করে উঠি। মনে হয় ওগুলো হোসনে আরার পোড়া শরীরের। আমার বাচ্চার পোড়া শরীরের।

দু’জন মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। ওরা সব শুনে চেম্বারের দরজা খুলে বলে দিয়েছে আর যেন না যাই। আমি আর পারছি না। আজ তোকে সব জানাতে পেরে ভাল লাগছে। নিজেকে হালকা লাগছে।

তুই আমাকে ঘৃণা করলে কর। কিন্তু হোসনে আরা আর আমাদের সন্তানের প্রতি যে নিষ্ঠুর কাজ আমি করেছি তা সবাইকে জানাবার মত সাহস আমার নাই। তুই জানিয়ে দিস। এ অমানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা যদি হোসনে আরা আর বাচ্চাটাকে যদি একটু সান্ত¦না দেয়! ইতি সাজ্জাদ। সিগারেটের আগুনটা কখন যে হাতে ছ্যাঁকা লাগিয়েছে তা খেয়াল করি নাই।

লাগতেই ঝাঁকি দিয়ে ওটা ফেলে দিলাম। আগুন বড় খারাপ জিনিষ। অনেকক্ষন ধরে ভাবছি কিভাবে শুরু করব। চিঠিটা প্রথমে তুলে দেব? দু’মাস আগের ঘটনার বিজ্ঞাপনের বাজীটা দিয়ে শুরু করব? নাকি কাল রাতে শহরের বিখ্যাত শিল্পপতি আমজাদ হোসেনের একমাত্র জামাই সাজ্জাদ হোসেনের আত্মহত্যার খবরটা দিয়ে শুরু করব?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।