আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে এমন প্রতারণা!

সাভারে রানা প্লাজা ধসে স্বজনহারা, ক্ষতিগ্রস্ত ও কর্মহারা মানুষকে সরকারি জমি ইজারার আশ্বাস দিয়ে তাঁদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই টাকা আদায় করছেন ‘রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন সোসাইটি’ নামের একটি নামসর্বস্ব সংগঠনের কর্মকর্তারা।
সাভার উপজেলা প্রশাসন বলেছে, রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের খাসজমি ইজারা দেওয়ার বিষয়ে তাদের বা জেলা প্রশাসনের জানা নেই। মন্ত্রণালয়েরও এমন সিদ্ধান্ত নেই। তাই এই টাকা আদায় প্রতারণা।


চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৪ জন নিহত হন। আহত হন দুই সহস্রাধিক। নয়তলা ওই ভবনে পাঁচটি তৈরি পোশাক কারখানা ছিল। ধারণা করা হয়, ভবনটিতে ওই সময় প্রায় চার হাজার লোক ছিলেন।
এমন প্রতারণার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জমি ইজারার আবেদনের কথা বলে রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন সোসাইটি প্রাথমিকভাবে গত জুন মাস থেকে জনপ্রতি ৬৪৮ টাকা আদায় করছে।

এর মধ্যে সংগঠনের ভর্তি ফি বাবদ ১২০ টাকা, কার্যালয় ফি ৩০০, প্রকল্প উন্নয়ন ফি ২০০ ও রেভিনিউ স্ট্যাম্পের মূল্য বাবদ ২৮ টাকা নেওয়া হচ্ছে। ওই টাকা দিলে ইজারার আবেদন ফরমে আগ্রহী ব্যক্তির সই নেওয়া হচ্ছে। জমি পাওয়ার আশায় কেউ কেউ একাধিক ফরমও পূরণ করেছেন। এ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার আবেদন ফরম পূরণ হয়েছে। এভাবে মোট আদায় হয়েছে প্রায় ২৬ লাখ টাকা।

রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্ত এই আবেদনকারীদের কাছে ইজারার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ বাবদ আরও ১০ হাজার টাকা দাবি করা হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংগঠনটির উদ্যোক্তা আবদুল করিম সাভার পৌর এলাকার ডগরমোড়ার মুক্তিযোদ্ধা ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি জেনারেল। রানা প্লাজা ধসের পরপরই তিনি ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং খাসজমি ইজারা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে তাঁদের কাছে চাঁদা দাবি করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে তিনি প্রশাসনিক চাপে পড়েন। এরপর গঠন করেন রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন সোসাইটি এবং রানা প্লাজার বিভিন্ন পোশাক কারখানার ১৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে এই সোসাইটির কমিটি গঠন করেন।

মুক্তিযোদ্ধা ফাউন্ডেশন এবং এই সোসাইটির কার্যালয়ের ঠিকানাও এক। ফাউন্ডেশনের একটি প্যাডে সোসাইটিকে অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

জমি পাওয়ার আশায় যাঁরা ৬৪৮ টাকা দিয়ে আবেদন করেছেন, তাঁদের মধ্যে আহত তাসলিমা বেগম এখনো বেকার। চাঁদপুর সদর উপজেলার দেবপুর গ্রামের তাসলিমা কাজ করতেন রানা প্লাজার সপ্তম তলার নিউ ওয়েব স্টাইলে। দুই মেয়েসহ চারজনের সংসারে তিনবেলা খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছেন তাঁর স্বামী দিনমজুর মোশাররফ হোসেন।

মাসে ঘরভাড়া দুই হাজার টাকা তো আছেই। তাসলিমা বলেন, জমি পাওয়ার আশায় এত অভাবের মধ্যেও তিনি জুলাই মাসে ধার করে আবদুল করিমকে ৬৪৮ টাকা দিয়েছেন। টাকা নিয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের বরাবর লেখা ইজারা পাওয়ার আবেদন ফরমে তাঁর সই নেওয়া হয়। কিন্তু জমির পরিমাণ বা বরাদ্দ কবে পাবেন, সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এখন জমি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আরও ১০ হাজার টাকা দাবি করা হচ্ছে।

এই টাকা জোগাড় করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়।

প্রায় একই সময়ে নিউ ওয়েব স্টাইলের আরেক শ্রমিক আয়শা আক্তারও ৬৪৮ টাকা দিয়েছেন। তিনি জানান, একটি রসিদ দিয়ে তাঁর কাছ থেকে ৬২০ টাকা ও রেভিনিউ স্ট্যাম্প বাবদ ২৮ টাকা নেওয়া হয়। কিন্তু ১০ হাজার টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আবেদন ফরমে তাঁর সই নেওয়া হয়নি।

ভবন ধসে নিহত ব্যক্তিদের একজন চতুর্থ তলার পোশাক কারখানার কর্মী রেহানা আক্তার।

তাঁদের বাসা সাভারের ব্যাংক কলোনিতে। তাঁর বোন আয়েশা আক্তার ওই টাকা দিয়েছেন।

রানা প্লাজার বিভিন্ন পোশাক কারখানার অন্য অনেক শ্রমিক এবং নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের মতো ষষ্ঠ তলার ইথার টেকের শ্রমিক আনোয়ারা বেগমও টাকা দিয়েছেন। আনোয়ারা জানান, গত ২২ নভেম্বর সকালে আবদুল করিমের বাসায় জমির আবেদনকারীদের সভায় জমির দখল বুঝে পেতে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ বাবদ জনপ্রতি আরও ১০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। সভায় উপস্থিত অতি আগ্রহীরা তা দিতে সম্মতি জানালেও অধিকাংশই অপারগতা জানান।

জানতে চাইলে আবদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জমি দেওয়ার ও পুনর্বাসন করার আশ্বাস দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমি আবেদনপত্র সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। যাচাই-বাছাইয়ের পর তাঁদের নামে জমি ইজারা দেওয়া হবে। ’ তবে কবে নাগাদ তাঁরা জমির দখল পাবেন, তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। টাকা নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কাগজপত্র তৈরি ও আবেদন বাবদ প্রাথমিকভাবে ৬২৮ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। ওই টাকা আবেদন পাঠানোতে খরচ করা হয়েছে।

আর কোনো টাকা দাবি করা হয়নি।

রানা প্লাজা ধসে আহত নিউ ওয়েব স্টাইলের সুইং অপারেটর সাইফুর রহমান এই সোসাইটির সভাপতি। তিনি বলেন, ‘আবদুল করিম ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের কাছ থেকে টাকা আদায়ের পর একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটিতে আমাকে সভাপতির পদ দেওয়া হয়। তখন এত সব অনিয়ম আমার জানা ছিল না।

এখনো কর্মহীন সাইফুর বলেন, ‘করিম জমির ইজারা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের কাছ থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা আদায় করে প্রায় সবই আত্মসাৎ করেন। নানা অজুহাতে আরও টাকা আদায়ের চেষ্টা চলছে। যাঁরা টাকা দিয়েছেন, তাঁদের জমি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিষয়গুলো জানার পর আমি ওই সংগঠন থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছি। ’

সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান মোল্লা ২৩ নভেম্বর বলেন, রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের নামে খাসজমি ইজারা দেওয়া হবে—এমন বিষয় জেলা বা উপজেলা প্রশাসনের জানা নেই।

মন্ত্রণালয় থেকেও এ ধরনের সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, ‘আবদুল করিম ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। এ বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাভার মডেল থানাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম। এরপর কী হয়েছে, তা আমার জানা নেই। ’

জানতে চাইলে সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তফা কামাল কয়েক দিন আগে বলেন, ইউএনওর নির্দেশে ওই চক্রের দুজনকে আটক করা হয়েছিল।

কিন্তু কেউ লিখিত অভিযোগ না করায় তাঁদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। এখনো লিখিত অভিযোগ না থাকায় চক্রটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.