মোটাসোটা - গোলমুখ - চোখ ছোট একজন মানুষ
ঘড়িতে পৌনে নয়টা বাজার মিনিট দুয়েক পর শাহেদ সাহেব একটানে দোতালা থেকে নিচ তালায় নেমে পড়েন। নিজ বাড়িতে থাকতে সময় মত অফিসে যেতে তার যতটা অনীহা ছিল এখন ঠিক ততটাই আগ্রহ। ঠিক ন’টায় সময় কাঁটায় কাঁটায় মিলিয়ে অফিসে বসে পড়বেন তিনি। আজ তিনি ন’টার সময়ে অফিসে গেলেও সরাসরি চেয়ারে বসলেন না। তার জুতো জোড়া কাদায় ভরে আছে।
ওটা পরিষ্কার না করে অফিসে ঢোকা যাবে না
পিয়ন কাম চৌকিদার ফিরোজ মিয়া এ মূহুর্তে শাহেদ স্যারের জুতো জোড়া পরিষ্কার করছে। সে বড় বিপদে আছে। গত বিশ বছর ধরে কখনই সাড়ে ন’টার আগে তাকে অফিসের তালা খুলতে হয় নাই। জরুরী কাজ এমনকি সেবার যখন ডিসি সাহেব অফিস ইন্সপেকশানে আসে সেবারও সে সাড়ে ন’টার আগে অফিস খুলে নাই। কিন্তু নতুন এ সাহবকে নিয়ে বড় বিপদ।
স্যার যদি ন’টার সময় অফিসে বসেন তবে তাকে সাড়ে আটটায় চলে আসতে হয়। দরজা-জানালা খোলাই তো কেবল একমাত্র কাজ না। সেই সাথে আছে চাপাকলের পানি আনা, টেবিল মুছে ঝকঝকে করে রাখা, স্যারের চেয়ারের তোয়ালেটা সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা এগুলো তো করতে হয়। স্যাররা নতুন আসলে সবাইই কিছু না কিছু খেয়ালী কাজ করে। সময়ে খেয়ালের রোগগুলো সেরে যায়।
কিন্তু এ স্যারের রোগ সারছে না। প্রতিদিন কাঁটায় কাঁটায় ন’টা বাজে আসবেনই। আর ওদিকে যদি বিকেলে আগে ছাড়া পাওয়া যেত তবুও হত। কিন্তু ইনি বেরও হন সেই সাড়ে পাঁচটা , ছ’টা করে। ফিরোজ মিয়াকে তালা মারার জন্য বসে থাকতে হয়।
ফিরোজ মিয়ার এত সমস্যা হত না যদি শাহেদ সাহেব ব্যাচেলর না হতেন। ব্যাচেলর মানুষের সময় কাটানো বড় মুশকিলের কাজ। তাও যদি কোন শখ থাকত তার তাহলেও সময়টা কেটে যেত। শাহেদ সাহেবের সত্যিকার অর্থে কোন শখ নাই। সে খেলাধূলা করে না।
বই পড়ে না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়ে না। দেখার মধ্যে যা একটু সিনেমা দেখে মাঝে-মধ্যে। টিভি দেখে। টিভিতে নাটক-ফাটক কম দেখে সে।
কেবল খুব মন দিয়ে টিভির খবরগুলো দেখে। টক-শো দেখে। যাদের যুক্তি তার সাথে মিলে যায় তাদের কথায় মাথা ঝাঁকায়। যাদের যুক্তিগুলো মেলে না তাদের কথা শুরু হলেই চ্যানেল পাল্টে দেয়। মাঝে মাঝে কারও কথা শুনলে তার মনে হয় লোকটা ভালই বলছে কিন্তু যত কথাই বলুক এগুলো সব ষড়যন্ত্র।
এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে কেউ খুব একটা মাথা ঘামাতে চায় না আজকাল। তারপরও যে মেস বাসায় শাহেদ থাকে ওতে আড্ডা জমে উঠে এক সময়। তারপর দ্রুতই ভেঙ্গে যায়। সবার এক কথা। বেল পাকলে কাকের কি? আসলে বাসার বাকীরা সবাই বিবাহিত ব্যাচেলর।
তত্ত্বীয় কথায় সময় না কাটিয়ে বৌয়ের সাথে দুটো কথা বললেও লাভ। তাই শাহেদ সাহেব আড্ডাবাজী করে সময়টা খুব একটা কাটাতে পারে না। অফিসে এসে পত্রিকা পড়ে, দু’চারটা ফাইলের খোঁজখবর করলেও তাও কিছুটা হাঁফ ছাড়া যায়। তাছাড়া পিয়ন আছে। ঘন্টায় ঘন্টায় চা-নাস্তা খাওয়া যায়।
সময়টা ভালই কেটে যায় তার।
ইদানীং অবশ্য ফিরোজ মিয়ার কাজ একটু বেড়েছে। স্যারের জুতো প্রায় প্রতিদিনই তাকে পরিষ্কার করতে হয় না। স্যারের বাসার ঠিক সামনেই একটা নালা বন্ধ হয়ে আছে আজ অনেকদিন হয়। মাঝে মাঝেই রাতে নালা উপচে ময়লা পানিতে ভরে যায় বাসার সামনের ছোট উঠোনটা।
যে কোন একজন শ’দুয়েক টাকা দিয়ে একটা লোক ডেকে নালাটা পরিষ্কার করে দিলেই হয়। সমস্যাটা থাকে না। কিন্তু পৌরসভার যে কাজ করার কথা সে কাজে আমাদের পয়সা খরচ করা কেন? ফিরোজ মিয়া অবশ্য স্যারকে বলেছে পৌরসভার ইঞ্জিনিয়ার স্যারকে ব্যাপারটা জানালেই সমস্যাটা শেষ হয়ে যায়। তিনি ঠিক করিয়ে দেবেন। কিন্তু কেউ জানায় না।
জানাবার জন্য সবচেয়ে ভাল অবস্থায় আছে শাহেদ সাহেব। তার অফিসের ঠিক অপরদিকেই ইঞ্জিনিয়ার অফিস। কিন্তু আজ যাচ্ছি, কাল যাচ্ছি বলে যাওয়াটা হয় না।
আজ অবশ্য শাহেদকে যেতে হল না। ইঞ্জিনিয়ার নিজেই তার রুম এসে বসে।
সেই সাথে আরও চার-পাঁচজন। কোন কাজ থেকে ফিরছে সবাই। একবার শাহেদের অফিসে ঢুঁ মারা।
কি ব্যাপার শাহেদ সাহেব আছেন কেমন? এত করি বলি একদিন আসেন চা খেয়ে যাবেন কিন্তু আসলেন না তো!
ফিরোজ মিয়া সবার পেছন দিয়ে জুতো জোড়া ধুয়ে এনে রাখার আগেই হুকুম -চা নিয়ে আস। সেই সাথে পেঁয়াজু।
আড্ডা জমে উঠে।
আরব বিশ্বের অবস্থা দেখছেন? কি অনাচার! ইহুদী-খ্রিষ্টান ষড়যন্ত্রে সব ধ্বংস হল। আমরা ভাই মুসলমানরা কোন কাজের মানুষ না। নিজেরা নিজেরা মারামারি করি আর ইহুদী-খ্রিষ্টানরা জিতে নেয় সব কিছু। দেশের অবস্থা দেখছেন? সব শেষ ।
কি যে হবে! এই জন্যই কি দেশ স্বাধীন হয়েছিল? এর জন্য সরকারই দায়ী। কি দরকার ছিল ওসব হাঙ্গামার। খালি সরকারের দোষ দেখেন কেন? বিরোধীদের দোষ নাই? তার মানে আপনে বলতাছেন সরকার যা করতাছে ঠিক করতাছে? না। তা তো বলি নাই। কিছুটা বাড়াবাড়ি হইছে।
বাড়াবাড়ি? বুঝছি ভাই কার মনে কি কথা।
এর ভেতর ইঞ্জিনিয়ারের খোঁজে দু’জন ঠিকাদার এসে যাওয়ায় কথা-বার্তা মেপে বলতে হয়েছে তাদের। কোন কথা বলে কি বিপদ হয় তাই এ সর্তক অবস্থা। ঠিকাদার দু’জন রাজনীতিক। তবে অনেকটা শখের ।
রাজনীতি না করলে টেন্ডার পাওয়া যায় না। তাই করা। তবুও কার মনে কি কে জানে। শাহেদদের আড্ডায় তারা প্রথমে চুপ করে থাকে। রাজীনীতি নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা নাই।
এক সময় তারাও জমে যায় আড্ডায়। হাসতে হাসতে একজন বলে আমাদের এই ছোট এলাকাতে রাজনীতি তো টিকিয়ে রেখেছেন আপনি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব।
কিভাবে?
আরে ভাই স্বার্থ আর টাকা আছে কেবল আপনার অফিসে। এখন যদি ক্ষমতা দিয়ে স্বার্থ আদায় না করা যায় কবে সে ক্ষমতার দরকারটা কি ?
কেউ এ প্রশ্নের উত্তর দেয় না। সব কথার দেবার দরকারটা কি ? টেন্ডার পাবার জন্যই যে এ দুজনের রাজনীতিতে হাতেখড়ি তা এরা জানে।
এক সময় ইউরোপ আমেরিকা শেষ হয়। মধ্যপ্রাচ্য - দূরপ্রাচ্য শেষে দেশ আসে আবার। পেঁয়াজু আর চায়ের আড্ডায় এক সবাই যে যার মনের কথা খুলে বলছে। কে, কি বলছে তা অবশ্য ওত খেয়াল নাই তারা তবে কে, কোন দল করে তা বোঝা গেল। অন্যের কথা শুনতে হবে কেন? আমাদের বোঝার ক্ষমতা কি অন্যের থেকে কম? কিন্তু শেষ কথা হল আমরা সবাই হুকুমের চাকর ।
যা হুকুম আসবে তাই পালন করতে হবে।
ফিরোজ মিয়া চায়ের কাপ-পিরিচগুলো গোছাতে শুরু করে। টেবিল মুছে। শাহেদ স্যার খেতে গেছেন। চলে আসবে কিছুক্ষনের মধ্যেই।
স্যারের জুতো জোড়া বাইরে রোদে শুকাচ্ছে। ভেজা জুতোতে তো আর রাস্তায় যাওয়া যায় না। একটা প্রেস্টিজ আছে। স্যারের বাসা থেকে চামড়ার স্যান্ডেল জোড়া সেই এনে দিয়েছে। স্যার এবেলা অফিসে এসে কিছুক্ষন ঝিমুতে থাকে।
কি দরকার রে বাবা আপনার বিকেলে অফিস করা? আড়াইটা তিনটে করে গিয়ে একেবারে খেয়ে গড়িয়ে নিলেই তো হয়। এসব ভাবতে ভাবতেফিরোজ মিয়া খাবারের বাটি খুলতে শুরু করে। এমন সময় অফিসের বাইরে থেকে শাহেদের গলা শোনা গেল।
ফিরোজ মিয়া। ফিরোজ মিয়া।
খাবারের বাটি খোলা বাদ দিয়ে স্যার, স্যার করতে করতে বেরিয়ে আসে ফিরোজ।
আবার কাদায় পড়েছি ফিরোজ। একটু ধুয়ে দেও তো।
স্যান্ডাল জোড়া কলতলায় নিয়ে যায় সে। সকালে এক জোড়া- বিকেলে এক জোড়া।
নাহ। ইঞ্জিনিয়ার স্যারকে ড্রেনের কথাটা স্যারের এ জন্মে বলা হবে না। তাকেই মনে কাল গিয়ে ড্রেনটা কেটে দিয়ে আসতে হবে। প্রতিদিন কত আর কাদা মাখা জুতো পরিষ্কার করা যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।