আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টেনিস কোর্টের ম্যান্ডেলা!

নামের পাশে মাত্র তিনটি গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা। এমন একজন টেনিস খেলোয়াড়কে কি মনে রাখবে ইতিহাস? রাখবে অবশ্যই। তাঁর কীর্তিটাই এমন, যদি বলা হয়, একদিক দিয়ে তাঁর আসন রজার ফেদেরার, পিট সাম্প্রাস, রড লেভারদের মতো কিংবদন্তিদেরও ওপরে, মিথ্যে বলা হবে না। টেনিস কোর্টে ফেদেরার-সাম্প্রাসরা লড়াই করেছেন নেটের ওপাশের প্রতিপক্ষের সঙ্গে। কিন্তু যাঁর কথা বলা হচ্ছে, সেই আর্থার অ্যাশ লড়েছেন আরও বড় এক প্রতিপক্ষের সঙ্গে।

যার নাম ছিল বর্ণবাদ! বর্ণবাদের সেই আগুনটিকে নিঃশেষ করে আক্ষরিক অর্থেই ছাই করে ফেলেছেন অ্যাশ!
অ্যাশকে তাই জয়-পরাজয়ের পরিসংখ্যানের চেয়ে বিচার করতে হবে সেই সময়ের জাতিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর দিয়ে, যখন শুধু গায়ের রং কালো হওয়ার কারণে একজন মানুষের অধিকার ছিল না সব খেলায় অংশগ্রহণের, যেকোনো মাঠে অনুশীলন করার। এমনকি ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠেয় দক্ষিণ আফ্রিকা ওপেনে অ্যাশকে ভিসা দেওয়া হয়নি কেবল তিনি কালো ছিলেন বলে! পরে সেই অ্যাশই এই দক্ষিণ আফ্রিকাতেই ৩১ জন প্রভাবশালী আফ্রিকান-আমেরিকানের একজন হয়ে গিয়েছিলেন রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর্যবেক্ষক হিসেবে!
মার্টিন লুথার কিংয়ের ভাবশিষ্য অ্যাশ প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা জেতেন কিংয়ের মৃত্যুর বছরেই। ১৯৬৮ সালে যাত্রা শুরু করা উন্মুক্ত যুগের প্রথম ইউএস ওপেনের শিরোপাটিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে জিতে নেন অ্যাশ। ১৯৭০-এর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন এবং ১৯৭৫ সালের উইম্বলডনও জেতেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবেই। তিনিই এখন পর্যন্ত ইউএস ওপেন, অস্ট্রেলিয়ান ওপেন বা উইম্বলডন জেতা একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ এবং ফ্রেঞ্চ ওপেন জেতা ইয়ানিক নোয়াসহ যেকোনো গ্র্যান্ড স্লাম বিজয়ী কৃষ্ণাঙ্গদের অতি সংক্ষিপ্ত তালিকার দুজনের একজন।

প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে টেনিস র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষেও ওঠেন অ্যাশই। সেই কীর্তি গড়েছিলেন ১৯৬৮ সালের আজকের এই দিনেই। ১২ ডিসেম্বর দিনটাকেই টেনিস ইতিহাসে স্মরণীয় করে রেখেছেন অ্যাশ। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে আমেরিকার পক্ষে ১৯৬৩ সালের ডেভিস কাপেও অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৩, ১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭০ এবং ১৯৭৮ সালে আমেরিকার ডেভিস কাপ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৮১-এর ডেভিস কাপে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে শিরোপা যেতে যুক্তরাষ্ট্র।

লুথার কিংয়ে অনুপ্রাণিত কালো আমেরিকান অ্যাশ নিজেকে শুধু টেনিসেই আবদ্ধ রাখেননি। নিজেই বলেছেন, ‘যদি আমি শুধু টেনিস নিয়েই মেতে থাকতাম, আমি আরও ভালো একজন প্রতিযোগী হতে পারতাম। ’ কিন্তু একই সঙ্গে তিনি আবার তাঁর কথা এবং কাজের দ্বারা প্রমাণ করেছেন তিনি কেবলই একজন ‘প্রথম’ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকতে চাননি, তিনি পুরোপুরি পালন করতে চেয়েছেন একজন আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাও। এই দায়বদ্ধতার দায় পালন করতে গিয়ে জেলও খেটেছেন একাধিকবার।

১৯৪৩ সালের ১০ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় বাবা আর্থার অ্যাশ সিনিয়র এবং মা ম্যাটি কর্ডেলের ঘরে জন্ম নেওয়া অ্যাশ জুনিয়র সংক্ষিপ্ত জীবনে পেয়েছেন অনেক ঈর্ষণীয় সাফল্য এবং বিরল সম্মান। সমাজ, জাতি ও দেশকে দিয়ে গেছেন অনেক কিছুই। প্রতিদানে পেয়েছেনও তত্কালীন প্রেক্ষাপটে সর্বোচ্চ সম্মান। কিন্তু প্রকৃতি অনেক সময়ই কোনো একজন মানুষকে দুই হাত উজাড় করে দেয় না। অন্য কোথাও কমতি দিয়ে চেষ্টা করে অভাবনীয় সাফল্যের একটা ভারসাম্য তৈরি করার।

একদিকে পাহাড়সমান সাফল্য যেমন অ্যাশের পায়ে এসে লুটিয়েছে, অন্যাদিকে সেই অ্যাশকেই বয়ে বেড়াতে হয়েছে অপ্রাপ্তি-অতৃপ্তির সীমাহীন বেদনা।

আর্থার অ্যাশ ১৯৭৭ সালে ফটোসাংবাদিক জিন মৌটুসামির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের নয় বছর পর নিঃসন্তান এই দম্পতি ১৯৮৬ সালে একটা কন্যাসন্তান দত্তক নেন। মায়ের পেশার সঙ্গে মিলিয়ে মেয়ের নাম রাখা হয় ক্যামেরা অ্যাশ! সামাজিক বঞ্চনার যন্ত্রণা, সন্তানহীনতার যন্ত্রণার সঙ্গে একসময় যোগ হয় শারীরিক যন্ত্রণা। ভক্ত-শুভানুধ্যায়ীদের বিস্মিত করে চমত্কার ফিটনেসের আর্থার ১৯৭৯ সালে হূদরোগে আক্রান্ত হন এবং তাঁকে যেতে হয় শল্যবিদের ছুরির নিচে।

১৯৮৩ সালে আবার একই সমস্যা তাঁকে দ্বিতীয়বারের মতো নিয়ে যায় বাইপাস সার্জারিতে। এ রকম পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর পক্ষে খেলা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। অবসর-পরবর্তী জীবনে টাইম ম্যাগাজিনের জন্য লেখালেখি, এবিসি স্পোর্টসের ধারাভাষ্যকার, জাতীয় জুনিয়র টেনিস লিগের জন্য তহবিল সংগ্রহসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ছয় বছরের সাধনায় ১৯৮৮ সালে তিনি তিন কিস্তির একটা বইও লেখেন: ‘এ হার্ড রোড টু গ্লোরি: এ হিস্টোরি অব দ্য আফ্রিকান-আমেরিকান অ্যাথলেট’ নামে।

১৯৮৮ সালে আর্থার আবার হাসপাতালে ভর্তি হন ডান হাতে পক্ষাঘাত নিয়ে।

বিভিন্ন পরীক্ষার পর আবিষ্কার হয় আর্থার এইচআইভি পজেটিভ। ১৯৯২ সালে এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁর এইচআইভি নিয়ে আর্থার নিজেই বলেন, ‘আমরা শতভাগ নিশ্চিত যে আমার এই এইচআইভি ১৯৭৯ সালের বাইপাস বা ১৯৮৩ সালের অস্ত্রোপচারের সময় দেওয়া রক্তের মাধ্যমেই সংক্রমিত হয়েছে এবং আমরা ৯৫ শতাংশ নিশ্চিত যে এটা ’৮৩-এর অস্ত্রোপচারের সময়ই হয়েছে। ’

মৃত্যুর আগে মেয়ে ক্যামেরাকে উদ্দেশ করে লিখে যান আবেগময় এক চিঠি। যে চিঠি যেকোনো হতাশায় আচ্ছন্ন মানুষের জন্য হতে পারে প্রেরণা। অ্যাশ লিখেছিলেন, ‘এখন যেমন তোমার পাশাপাশি আছি, হয়তো সমস্ত পথ বা পথের অধিকাংশই আমি তোমার সঙ্গে এভাবে থাকতে পারব না।

যখন তোমার আমাকে প্রয়োজন, আমি যদি ব্যক্তিগতভাবে না থাকতে পারি বা সুস্থ বা বেঁচে থাকতে না পারি, রাগ কোরো না। সব সময় তোমার পাশে থাকার চেয়ে আমার কাছে প্রিয় আর কিছুই নেই। যদি আমি না থাকি, আমার জন্য মন খারাপ কোরো না। যখন আমরা একসঙ্গে ছিলাম, তোমাকে গভীর ভালোবেসেছি এবং তুমিও আমাকে যে ভালো লাগা উপহার দিয়েছ, সেই মূল্য আমি কোনো দিন শোধ করতে পারব না। ক্যামেরা, যখনই তোমার মন খারাপ হবে এবং জীবন নিরর্থক মনে হবে কিংবা তুমি চলার পথে হোঁচট খাবে এবং পড়ে যাবে এবং জানবে না কীভাবে উঠে দাঁড়াবে, শুধু আমার কথা ভেবো।

যেন আমার হাসি, আমার আনন্দ নিয়ে আমি তোমার পানেই চেয়ে আছি। ’

এ কথাগুলোই তিনি সারাজীবন বলতে চেয়েছেন স্বজাতি কালো ভাইবোনদের, বঞ্চিত, অবহেলিত মানবতাকে। ১৯৯৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্ক হাসপাতালে ৪৯ বছর বয়সে আর্থার মারা যান।

নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যু আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল বৈষম্যহীন আধুনিক বিশ্ব গড়তে অ্যাশের মতো মহামানবদের আত্মত্যাগের গল্প। অ্যাশ ছিলেন টেনিস কোর্টের ম্যান্ডেলা!



সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.