দুর্নীতি নির্মূলের অঙ্গীকার করে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদের হিসাব প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় গেলেও সরকারের চার বছরে তার বাস্তবায়ন দেখেনি দেশবাসী।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ‘দুর্নীতিকে’ সামনে এনে তার বিপরীতে মহাজোটকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানায় আওয়ামী লীগ। আর তাতে ব্যাপক সাড়াও মেলে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যে পাঁচটি ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়, তাতে ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠা অনুচ্ছেদে (৫.২) ছিল- “প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতি বছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। ”
সম্পদের হিসাব দেয়ার কথা গত চার বছরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কয়েকবার বললেও তার ফল দেখা যায়নি।
বরং ২০১০ সালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আয়কর বিবরণীতে দেয়া হিসাবই যথেষ্ট। নতুন করে আর সম্পদের হিসাব দিতে হবে না।
সরকারের এই সিদ্ধান্তে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা ওঠার পর ২০১১ সালে অর্থমন্ত্রী আবার বলেন, মন্ত্রী, মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য ও বিচারপতিদের সম্পদের হিসাব দিতে হবে।
কিন্তু এরপর দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও তার কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।
নির্বাচনী এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুঃখজনক হল এই কাজটিও আমরা করতে পারলাম না।
”
মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব প্রকাশের অঙ্গীকার ‘সাহসী’ ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই কাজটি করতে পারলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যেত। ”
মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাবের বিষয়ে জানতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি গত সপ্তাহে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা তাদের সম্পদের হিসাব সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দিচ্ছেন।
“আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, অনেকেই তাদের সম্পদের হিসাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দিচ্ছেন। ”
এই হিসাব জনগণের সামনে প্রকাশের বিষয়ে অবশ্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব কিছু বলতে পারেননি।
সংসদ সদস্যদের সম্পদের হিসাবের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে সংসদ সচিবালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মাহফুজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার জানা মতে, সংসদ সদস্যদের ইনডিভিজুয়াল (ব্যক্তিগত) ইনকাম ট্যাক্স ফাইল সংসদ সচিবালয়ে আছে।
সম্পদের হিসাব সংক্রান্ত কোনো ফাইল জমা হয়নি। ”
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, শুধু মন্ত্রী-এমপি নয়, তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাবও প্রতিবছর জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদের হিসাব জমা দিতে হবে।
এরপর এক বছর পেরিয়ে গেলেও এ কাজে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুহিত বলেন, আগামী জুনের (২০১০ সাল) আগেই মন্ত্রী-এমপি, বিচারপতি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব বিবরণী প্রকাশ করা হবে।
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রথম বছর সম্পদের হিসাব প্রকাশ করতে না পারায় ‘স্যরি’ও বলেছিলেন তিনি।
সম্পদের হিসাব প্রকাশের কারণ ব্যাখ্যা করে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, “যাতে দেশের মানুষ বুঝতে পারে, একজন মন্ত্রী বা এমপি হওয়ার আগে কী পরিমাণ সম্পদ ছিল, দায়িত্ব নেয়ার পর কী পরিমাণ সম্পদ হয়েছে। ”
কিন্তু এর তিন মাসের মাথায় মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের নতুন করে জনসমক্ষে সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করতে হবে না। নির্বাচনের আগে দাখিল করা তথ্যই এই জন্য যথেষ্ট।
সম্পদের হিসাব দেয়ার কথা বলায় মুহিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে অন্য সহকর্মীদের তোপের মুখেও পড়েছিলেন বলে বৈঠক সূত্র জানায়।
সরকারের ওই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।
বিশ্ব ব্যাংক-এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থাও এর সমালোচনা করে।
এরপর ২০১১ সালের জুন মাসে হঠাৎ করেই অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দেন, মন্ত্রী, মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য ও বিচারপতিদের সম্পদের হিসাব দিতে হবে।
ওই দিন জাতীয় সংসদের অধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের ডেকে তিনি বলেন, “সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার কথা বহুদিন বলেছি। আজ এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নের ভিত্তিতে এ সম্পদের বিবরণী জমা দিতে হবে।
”
কবে এই বিবরণী জমা দিতে হবে- জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে এক সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রীদের বিবরণী জমা দিতে হবে।
ওই বছরের ৪ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মন্ত্রী-উপদেষ্টারা তাদের সম্পদের হিসাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেবেন। সংসদ সদস্য এবং বিচারপতিদের বিষয়ে স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান মুহিত।
পরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক রাষ্ট্রপতির কাছে তার সম্পদের হিসাব দেন। অনেক বিচারপতিও তাদের সম্পদের হিসাব প্রধান বিচারপতিকে দিয়েছিলেন।
কিন্তু এরপর মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদের হিসাব নেয়ার উদ্যোগ থাকলেও তা দেশবাসীর সামনে প্রকাশ্য হয়নি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।