বিশ্বাস করেন, আমি আপনাকে ভালবাসি :)
১.
ভোররাতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় আবিরের। সেই একই স্বপ্ন আজ আবারো দেখেছে সে। কি ভয়ানক, কি বীভৎস! এরকম স্বপ্ন মানুষ দেখে কেন? আবির ভেবে পায়না।
চোখ ডলতে ডলতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সে। বাইরের আবছা অন্ধকারটা ভয় ধরিয়ে দেয় মনে।
দৌড়ে চলে আসে ভেতরে। নাহ! ব্যাপারটা আম্মুর সাথে শেয়ার করতে হবে।
বিছানায় শুয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করে সে। কিন্তু বারবার সেই বীভৎস স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায়। একটু পরই ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়।
স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা আজ। মঞ্চে সঞ্চালকের দায়ীত্ব পালনে ব্যাস্ত রাফাত স্যার। আবিরের প্রিয় টিচার তিনি। অনেক আদর করেন আবিরকে। অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদেরকে পড়া না পারলে পিটিয়ে তক্তা বানান তিনি,অথচ আজ অবধি আবিরের গায়ে হাত তুলেননি তিনি কখনো।
মঞ্চে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেছেন চেয়ারম্যান মোঃ হামিদুর রহমান। খুবই ভাল মানুষ এবং পরোপকারী হিসেবে এলাকায় তার বিশেষ সুনাম আছে। মধ্যবয়স্ক লোকটার কালো গোঁফ, মুখে নির্মল হাসিতে সাধাসিধে মানুষটিকে ভাল লেগে যায় আবিরের। তার পাশের চেয়ারটিতে বসে আছেন প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম এবং অন্যান্য শিক্ষকগন।
একে একে অংশগ্রহনকারী ছাত্রছাত্রীরা তাদের পারফরম্যান্স প্রদর্শন করছে।
রাফাত স্যার তাদের নাম বলছেন এক এক করে। দৌড় প্রতিযোগীতায় নাম আছে আবিরের। সবার সাথে সেও লাইনে গিয়ে দাড়ালো।
রাফাত স্যার তিন পর্যন্ত গোনা শেষ করতেই দৌড়াতে শুরু করল সবাই।
হঠাত বিকট গর্জন।
তাদের পেছনে ধাওয়া করছে একঝাক হায়েনা। ধেয়ে আসছে তো ধেয়ে আসছে। উর্দ্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে শুরু করে আবির, একটুও এগোতে পারে না। প্রচন্ড ভয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলবে মনে হয়,পা দুটো অসাড় হয়ে আসে। হায়েনার তীক্ষ্ণ থাবা যখন ঠিক এক ইঞ্চি দূরে ঠিক তখনই তাদের বাঁচাতে সামনে এসে দাড়ান চেয়ারম্যান মোঃ হামিদুর রহমান।
আবির দৌড়ে এসে একটা উচু ঢিবির পেছনে লুকায়। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে কি বীর বিক্রমে হামিদুর রহমান একাই যুদ্ধ করছেন হায়েনাদের বিরুদ্ধে। দুটো হায়েনাকে মুহূর্তেই ধরাশায়ী করে ফেললেন খালি হাতেই। কিন্তু পেছন থেকে একটা হায়েনা হিংস্র থাবা বসিয়ে দিল তার পিঠে, ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল তার শরীর। কি ভয়ংকর, কি বীভৎস !!
প্রচন্ড ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠে আবির।
হায়েনারা এগিয়ে আসে তার দিকে, একসাথে। থাবা উঁচু করে ধরে সবাই। প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে জেগে যায় আবির। পানির তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে।
চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে মা দৌড়ে আসে।
ছেলেকে প্রচন্ড ভয়ে কুকড়ে থাকতে দেখে কেঁদে ফেলেন মা।
-তোমার কি হয়েছে আবির? চিৎকার করছো কেন বাবা?
মায়ের কাছে সব খুলে বলে আবির। স্কুলের দৌড় প্রতিযোগীতার কথা, হিংস্র হায়েনাদের পিছু ধাওয়ার কথা, চেয়ারম্যান হামিদুর রহমানের কথা, সব।
২.
আশরাফ চাচার চেম্বারে বসে আছে আবির। চোখে ইয়া মোটা ফ্রেমের চশমা,গম্ভীর মুখ।
আব্বুকে জিজ্ঞেস করতে উত্তর দিল তোমার আশরাফ চাচা একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। সাইকিয়াট্রিস্ট শব্দটার মানে না বুঝলেও বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ালো সে।
শান্ত ভঙ্গিতে চেয়ার টেনে বসলেন আশরাফ চাচা। চোখের চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখলেন। ড্রয়ার থেকে একটা ম্যাগাজিন বের করে আবিরের সামনে ধরলেন।
- আচ্ছা আবির, এখানে সাতটা ছবি আছে। তোমার স্বপ্নে দেখা চেয়ারম্যানের সাথে এদের কারো মিল আছে?
- না। ঠিক মনে করতে পারছি না।
- ভাল করে দেখ বাবা। খুব ভাল করে লক্ষ করে দেখ, কারো সাথে মিল আছে কিনা।
ছবিগুলো এক এক করে খুব ভাল করে দেখতে লাগল সে। হঠাত একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল তার। হ্যা,সেরকমই তো। মধ্যবয়সী,হালকা কালো গোঁফ,সাধাসিধে নির্মল হাসি।
- “চাচা পেয়েছি!” আনন্দে চিকচিক করে উঠল আবিরের চোখ।
- হুম। যা ভেবেছিলাম ঠিক তা-ই। ছবির নিচে খুব ছোট করে একটা নাম লেখা আছে। পড়ে দেখ।
- “বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান।
“
আবির, তুমি যা স্বপ্নে দেখেছো সেটা ছিল বিজয়ের গল্প, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গল্প। মুক্তিযুদ্ধের একজন মহান বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের গল্প, স্বভূমিকে রক্ষার জন্য,সহযোদ্ধাদেরকে রক্ষা করা জন্য একজন মহান মানুষের আত্মত্যাগের গল্প।
তোমার রাফাত স্যারের কাছে জানতে পারলাম, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, তার ইতিহাস নিয়ে তোমার অনেক আগ্রহ ছিল। তোমার বইতে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ নিয়ে অনেক রচনা পড়েছো তুমি। তাদের সাহসিকতা, একসাথে কাধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করা,দেশের জন্য আত্মত্যাগের স্লোগানকে বুকে ধারন করে জীবন উতসর্গ করার ইতিহাস পড়ে শিহরিত হয়েছো তুমি।
তোমার অবচেতনে সেই গল্প স্থান করে নিয়েছে। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হায়েনারূপে দেখেছো তুমি,ঠিক যেমন করে তারা নির্বিচারে হায়েনার মত হত্যা করেছিল এদেশের মানুষকে। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা ছিল একটা যুদ্ধক্ষেত্র,যেখানে জয়লাভ করাটা ছিল উদ্দেশ্য,সেখানে তোমার সাথে দৌড়ে অংশগ্রহন করেছে হায়েনারা। পার্থক্য হল তুমি দৌড়ে অংশ নিয়েছো ভালবাসা থেকে, অপরদিকে হায়েনারা তোমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে, ঠিক যেমনটা হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধে।
হামিদুর রহমানকে তুমি দেখেছো চেয়ারম্যান হিসেবে।
নেতা হিসেবে । আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান যেমন ছিলেন একজন নেতার মত। যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন করে তিনি উতসর্গ করেছিলেন তার জীবন।
তুমি দেখেছো কারন মুক্তযুদ্ধের চেতনা, দেশপ্রেম তোমার মনে স্থান করে নিয়েছে। দেখো, তুমি একদিন একজন বড় মানুষ হবে।
এখন থেকে তুমি এ স্বপ্নটা আর দেখবে না। কারন তুমি জেনে ফেলেছো কেন এ স্বপ্ন দেখছো। তোমার ব্রেইন এ স্বপ্নটা আর দেখাবে না। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারো। হা হা হা।
রিকশায় বাড়ি ফিরছিল আবির আর তার আব্বু। নিরবতা ভেঙ্গে আব্বুই প্রথম শুরু করল।
-আবির?
-জ্বী আব্বু।
-আই এম প্রাউড অফ ইউ।
*******
গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে আজ বাংলানিউজ২৪.কম এ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।