অশুভ ১৩ বা আনলাকি থার্টিন বলে একটা কথা রয়েছে। তবে জ্যোতিষীরা বলে থাকেন, ১৩ কখনো কখনো অশুভ হলেও সবসময় শুভ হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের জন্য শুভ হয়নি ইংরেজি ২০১৩ সাল। বছরের শেষ দিন, বর্ষবিদায়ের ক্ষণে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, জাতি সত্যিই পার করল একটি অশুভ বছর। আজ বেলা শেষে কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্তরেখার ওপারে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে কালের অতল গহ্বরে চিরতরে হারিয়ে যাবে ঘটনাবহুল এই ২০১৩ সাল। এ মাসে বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচির সময় সীতাকুণ্ডে পিকেটারদের দেওয়া আগুনে ঝলসে যাওয়া ট্রাকচালক ইয়াসিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতর কণ্ঠে জানতে চেয়েছিলেন, 'আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের এখন কী হবে?' বর্ষবিদায়-লগ্নে সেই প্রশ্ন দেশবাসীরও, আমাদের কী হবে? ১৬ কোটি মানুষের এই আর্তিকে নতুন বছরের হাতে তুলে দিয়ে বিদায় নিচ্ছে ২০১৩। বর্ষশেষে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, কেমন গেল বছরটি? কুয়াশার চাদর জড়িয়ে থাকা নিসর্গের দিকে তাকিয়ে নির্দ্বিধায় বলা যায়- না, মোটেই ভালো কাটেনি ২০১৩। এই যে ভালো না কাটা, এর বিশদ বিবরণ বিস্তৃত হয়ে আছে সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়। বছরের ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে তাকালে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠবে। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে আজ চারদিকে কান্না, আর্তনাদ আর দীর্ঘশ্বাস। রাজনৈতিক সহিংতা, অরাজকতা আর নাশকতার দাপটে মৃত্যুর মিছিল দেশজুড়ে। জাতি একটি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় দাঁড়িয়ে। সহসা কোনো সমাধান হবে কি না কেউ জানে না। তবে সবার কথা, সরকার ও বিরোধী দল সমঝোতার পথে না হেঁটে গোঁয়ার্তুমি ও একগুঁয়ে অবস্থান নেওয়ায় দেশের আজ এই হাল। নভেম্বর-ডিসেম্বরে অব্যাহত রাজনৈতিক সহিংসতায় এমনও প্রশ্ন উঠে আসে মানুষের মুখে যে ২০০৭ সাল কি ফিরে আসছে? বিয়ালি্লশ বছর আগে ১৯৭১-এ মুক্তিসংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা দিনগুলো বাদ দিলে ২০১৩-এর মতো এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, সহিংসতা ও রক্তাক্ত ঘটনা এ দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেনি। ১৯৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার পর বিগত ৩৮ বছরে কখনো অনিশ্চয়তার কালো মেঘ রাজনীতির আকাশকে এমন গভীরভাবে আচ্ছন্ন করেনি। বলতেই হবে, বড় দুই দলের অনমনীয়তা ও অদূরদর্শিতার ফলে সৃষ্টি হওয়া রাজনৈতিক সংঘাত এক সর্বনাশা পরিণতির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। তবে রাজনীতি সেই অন্ধকার গর্তে না পড়লেও দেশবাসীর মন থেকে তা নিয়ে সংশয়, শঙ্কা, দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তা কাটেনি। এখনো গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষ। তাই বছরের শেষ প্রান্তে এসে অনেকেরই মনে প্রশ্ন, শেষ পর্যন্ত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তো? আর নির্বাচন হলেও মানুষ নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারবে তো? এ রকম একরাশ জিজ্ঞাসা রেখে বিদায় নিচ্ছে ২০১৩। বিদায়ী বছরে আমাদের জাতীয় জীবনে অর্জন থাকলেও দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল বেশির ভাগ সময়ই অস্থির, নানান সহিংস ঘটনায় টালমাটাল। শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেক সময় খাদের কিনারে নিয়ে ফেলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে। নাগরিকদের কাটাতে হয় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কে। ফেব্রুয়ারি থেকে এই ডিসেম্বর পর্যন্ত মাঝেমধ্যেই প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে ভয়াবহ দুঃসংবাদ। বছরের শেষ প্রান্তে এসে মূলত নির্দলীয় সরকার, সংসদ নির্বাচন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় কার্যকরকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের অব্যাহত হরতাল-অবরোধে শুধু জনদুর্ভোগই বাড়েনি, নাশকতার শিকার হয়েছে অসংখ্য নিরীহ নাগরিক। হরতাল-অবরোধের আগুনে অকালে প্রাণ হারিয়েছে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ বহু মানুষ। কেবল নভেম্বরে-ডিসেম্বরে ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচির সময় প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক মানুষ। সম্পদহানি হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার। অবনতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে সার্বিক অর্থনীতিতে। নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমেছে ধস। হরতাল-অবরোধে বিপন্ন শিক্ষাজীবন। অবস্থা দেখে মনে হয় যেন শিক্ষার্থীদের জন্য রাজনীতিকদের কোনো দায়িত্ব নেই। এ সময় ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে পাঁচ বছরের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক এমপি-মন্ত্রীর নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের সম্পদের অকল্পনীয় স্ফীতি দেখে বিস্মিত হয়েছে দেশবাসী।
বছরের শেষে দশম সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হয়েছে। বিরোধী দল সহনীয় ও গণতান্ত্রিক আচরণ ছেড়ে হঠাৎ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ছত্রছায়ায় ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত জামায়াতে ইসলামী দেশের বিভিন্ন জেলায় সন্ত্রাস, নৃশংসতা, নাশকতা, খুন, অগি্নসংযোগ, ধ্বংসযজ্ঞের পথ বেছে নেয়। জামায়াতের অনিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাসের থাবায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতবিক্ষত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নামে পরোক্ষে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। রেললাইন উপড়ে ফেলে; ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে আগুন ধরিয়ে নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মেরে আতঙ্কবাদীরা গণনিষ্ঠুরতার মাধ্যমে দেশজুড়ে সৃষ্টি করে ভীতিকর পরিস্থিতি। প্রতিহিংসার রাজনীতির আগুনে সংখ্যালঘু ও প্রতিপক্ষের বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়ে ছাই হয়েছে। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটগুলোয় এখন দগ্ধ মানুষের আহাজারি। প্রকৃতপক্ষে দেশকে একটি দীর্ঘমেয়াদি সহিংসতার পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আর এ রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধের দাবিতে দিনমজুর থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন।
বিদায়ী বছরে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিদেশি কূটনীতিকদের দূতিয়ালি সত্ত্বেও সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো বোঝাপড়া হয়নি। দুই নেত্রীর টেলিফোন আলাপ ও জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফারনান্দেজ তারানকোর উপস্থিতিতে দুই দলের শীর্ষ নেতাদের একাধিক গ্রুপ বৈঠক হলেও সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরবিরোধী অবস্থানেই থেকে গেছে। বিদায়ী বছরে সরকারের ব্যর্থতা হচ্ছে তারা বিরোধী দলকে নির্বাচনের পথে নিয়ে আসতে পারেনি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৌশলের মাধ্যমে প্রায় প্রতিকূলে যাওয়া রাজনৈতিক পরিবেশকে নিজের অনুকূলে নিয়ে এসে দেশবাসীকে ভোটের দোরগোড়ায় পেঁৗছাতে সক্ষম হয়েছেন। বিদায়ী বছরে বাংলাদেশ পেয়েছে দুটি সরকার। নির্বাচিত সরকার এবং মেয়াদান্তে সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আরেকটি নির্বাচনী সরকার। বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে সাভারের রানা প্লাজা ধসে সহস াধিক গার্মেন্ট কর্মীর করুণ মৃত্যু দেশবাসীকে ব্যথিত করেছে। আবার '৭১-এর যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের ঘটনায় সন্তুষ্ট হয়েছে জাতি। দেশজুড়ে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধকরণে গণজাগরণ মঞ্চের প্রয়াস ছিল বিদায়ী বছরের অন্যতম আলোচিত-আলোড়িত ঘটনা।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।