সুখে থাকতে ভুতে কিলায়, কথাটা প্রাচীন প্রবাদ। কিন্তু কাউকে সুখে থাকতে দেখলেও ইদানীং অনেকে ভুতের কিল খায়, কেন খায় জানি না।
সিমান্তে হত্যা নিয়ে অনেক দিন ধরে লিখবো লিখবো ভাবছিলাম। আবার চিন্তা করি লিখেই কি লাভ, লেখা দিয়ে কি হয়, দেশ চলছে ক্ষমতার জোরে। যাই হোক, ভনিতা না করে শুরু করি।
আজ পর্যন্ত আমাদের দেশের যতগুলো সিমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পড়েছি কিংবা শুনেছি, কোনটিতেই এমনটা শুনি নাই যে সিমান্তে প্রবেশ করতে গিয়ে কেউ মারা পড়েছে। বিএসএফ এর তো গুলির অভাব নেই, তাহলে প্রবেশ করার সময়ই যদি সতর্কতা মূলক ফাঁকা গুলির আওয়াজ করে, তাহলে তো মনে হয় অনেক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হত না। আসলে সমস্যা সেটা না, এমন না যে ওরা ভুল করে গুলি করে। আসলে ওরা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়েই গুলি করে। কয়েক মাস আগে আমার ক্লাসে সিমান্তে হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা উঠেছিলো, স্যার নিজেই তুলেছিলেন বিষয়টি।
এর মাঝে এক ছাত্র হঠাৎ বিএসএফ এর সাফাই গাইতে গিয়ে বলল, ওরা নাকি শুধু চোরাকারবারিদের হত্যা করে এবং তাদের সাথে নাকি সেটাই করা উচিৎ। আমার দেশের নাগরিক, আমার ক্লাসমেট যার পাশে বসে ক্লাস করি, সে এরকম চিন্তা করে জেনে পুরোপুরি নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। বলে কি এই লোক!!! হোক সে চোরাকারবারি, হোক সে অপরাধী, কিন্তু তার বিচার-শাস্তি যা করার আমার দেশ করবে, ভারত কে এই বিচার করার? কে দিয়েছে তাদের এই অধিকার? আর নিজেকে যদি এতোই ভালো মানুষ মনে করে, তাহলে সাহস নিয়ে সিমান্তে একটা মাস কাঁটিয়ে আসুক।
কোনদিন শুনলাম না কেউ ফেন্সিডিল খেতে গিয়ে মারা পড়েছে, মদ-বিয়ার অথবা অন্য কোন প্রকার নিষিদ্ধ মাদক সেবন কিংবা আনতে গিয়ে কেউ গুলি খেয়েছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, ২০০৭ এর শীতের সময়ে আখাউড়া-মোকোন্দপুর বেড়াতে গিয়েছিলাম একবার।
দুপুরে নিকটবর্তী সিমান্তে গিয়েছিলাম রাবার বাগান দেখতে। সাথে ক্যামেরা মোবাইল, ডিজিটাল ক্যামেরা, বেনসন এন্ড হেজেস এর প্যাকেট, গ্রামের লোকেরা একটু আলাদা চোখেই দেখে। হঠাৎ দুটি গুলির আওয়াজ শুনলাম, প্রথমে মনে করেছিলাম আমাদের উদ্দেশে কিনা, কিন্তু রাবার বাগানের শ্রমিকরা আমাদের আশ্বস্ত করলো। এর মধ্যে দেখলাম টহলরত অবস্থায় থাকা কিছু বিডিআর (তৎকালীন) সদস্য আসলেন, নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করলেন, ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছি জেনে কাছে আসলেন, এরপর আমাদেরকে একটা গণ্ডি দেখিয়ে সেটা অতিক্রম করতে নিষেধ করে দিয়ে তারা চলে গেলেন। সন্ধ্যায় রেল ষ্টেশনে বসে নিজেদের ট্রেন আসার প্রহর গুনছিলাম একটা চা এর দোকানে।
সেখানে দুপুরের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছিলাম, সেখানকার যেই বন্ধুর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম, সে ওই এলাকায় নিয়জিত আমাদের দেশের সীমান্ত প্রহরীদের সাহসিকতার বিষয় নিয়ে গল্প বলছিল। আওয়াজ পেয়ে দোকানী আমাদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করলেন, আর দুপুরের সেই ফাঁকা আওয়াজ যার উপর করা হয়েছিল তাকে দেখালেন। উঠতি বয়সের এক যুবক, প্রান চঞ্চল, সমস্যা একটাই, ফেন্সিডিল আনা নেয়ার কাজে নিয়জিত। জিগ্যেস করলাম কত দিন ধরে এই কাজ করে, বলল ছোটবেলা থেকেই। ফাঁকা আওয়াজ যদিও তাকে উদ্দেশ্য করেই করা, কিন্তু ফাঁকা আওয়াজের উদ্দেশ্য আলাদা, আর মানে আওয়াজকারি সন্তুষ্ট এবং অন্য কোন টহল গ্রুপ যাতে সেখানে নাক গলানো থেকে বিরত থাকে।
অনেকটা নিজের টেরিটোরি ঘোষণা দেয়ার মত। তখন এতোটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে এরা সবাই একটা বিশেষ সিণ্ডিকেটের অন্তর্ভুক্ত, সবাই একটা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে, সেটা আইনি হোক আর বেআইনি হোক।
এবার ফিরে আসি বিডিআর ম্যাসাকার পরবর্তী বিজিবি নিয়ে বর্তমান ও বিগত বছরগুলোতে। আজ ৭ই জানুয়ারি, ২০১৪। ২০১১ এর এই দিনে ফেলানী নামের এক হতভাগ্য কিশোরী আমাদের প্রতিবেশী ও পরম বন্ধু দেশ ভারতের সীমান্ত রক্ষীদের বর্বরতায় প্রান হারা।
শুধু তাই নয়, তার মৃতদেহকেও চরম অবমাননা করে ফেলে রাখা হয় সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়ার উপর। তার নামে অনেকে আজকের দিনটি একটি দিবস হিসেবে পালন করতে চায়। কিছু দিবস কলঙ্কের, কিছু দিবস লজ্জার, আজকের এই ফেলানী দিবসটিও চরম লজ্জা ও গ্লানির। না, শুধু মাত্র একজন ফেলানী কে নিয়ে বেশী কথা বলার নেই, আরও হাজারো ফেলানীর আত্মা কাঁদছে আজ। যে ভারতে এক হরিণ শিকার নিয়ে একজন সুপারস্টারকে শাস্তি পেতে হয়, কারাবরণ করতে হয়, তারাই আজকে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে চাক্ষুষ হত্যাকারীদের বেকসুর খালাস দিয়ে দেয়।
মনে হচ্ছে একটা হরিণ যে দেশে ন্যায় বিচার পায়, সেখানে হরিণরাই মানুষের চাইতে বেশী মূল্যবান। অবশ্য ধর্ষণের দেশ থেকে এর বেশী আর কিছু আশাও করি না।
এখন আরেকটা সমস্যা নিয়ে বলি, বিগত বছরগুলোতে এই অভ্যাস চলে আসছে। ভারতের বিরুদ্ধে কিছু বললে কিছু মানুষের চুল্কানি বৃদ্ধি পায়, ঘাড়ের উপর পাকিস্তান প্রীতি চাপিয়ে দিতে চায়। তারা যে কেন বুঝে না, ভারতকে ঘৃণা করার মানেই পাকিস্তানকে ভালোবাসা না, আবার পাকিস্তান ভালো না, এর মানে এই না ইন্ডিয়া ভালো।
পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক তালাক দিয়ে দেয়ার মত, আর তালাক দেয়ার পর সেখানে বলার মত কিছুই থাকে না। বাকশাল নিয়ে কথা বললে যারা বলেন অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে দেশ সামনে আগাবে কি করে, তাদেরও উচিৎ দ্বৈতনীতি পরিহার করে, বর্তমানকে নিয়ে চিন্তা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু কিছু কথা পরিষ্কার করা দরকার। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত ভারত, বাংলাদেশকে কোন সাহায্য করে নাই। কারন তখনও বাংলাদেশের জন্ম হয় নাই।
ভারত তার চির শত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বভাবগত যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে ছিল। এরপর শুরু হয় সাহায্য, যা ফারাক্কা বাধ দিয়ে শুরু করে এখন টিপাই মুখে বাধ দেয়া পর্যন্ত বিদ্যমান। প্রায় প্রতিদিনই সিমান্তে মানুষ মেরে নিয়ন্ত্রণ করে, এটাও কম সাহায্য নয়। মজার ব্যাপার সিমান্তের হত্যাগুলোও, কেউ সিমান্তে প্রবেশ করার সময় গুলি খায় না, কারন তখন সাথে টাকা থাকে। সেই টাকাটা ভারতে খরচ করে ফিরে আসার সময় গুলি খেয়ে মারা যায়।
যার ফলে ভারতীয়রা এক গরু পাঁচ বার বিক্রয় করতে পারে। এছাড়াও ছোটোখাটো আরও কত সাহায্য যে করে তার কোন ইয়ত্তা নাই। আবার এর মধ্যে বর্তমান সরকারকে ভারত যে নির্লজ্জ ও অবৈধ ভাবে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে, তার কারন হিসেবে তারা বলছে এই সরকার না থাকলে নাকি এ দেশে জঙ্গিদের অপততপরতা বেড়ে যাবে, সীমান্ত অরক্ষিত থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি। যে দেশের সীমান্ত নীতি এতো জঘন্য, তারা আবার কিসের চিন্তা করে। তারা সাধারণ মানুষ নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে, জঙ্গিদের বেলাতেও তো একই ঘটনা ঘটবে, তাহলে তাদের ভয় কিসের?
আজকে সীমান্তে বিজিবির করুন আর অসহায় অবস্থা দেখে কেন জানি মনে হয়, বিডিআরদের শুধু নামই পরিবর্তন করা হয়নি, আরও অনেক কিছুই করা হয়েছে।
তারা আজকে সীমান্ত অরক্ষিত ফেলে রেখে নির্বিচারে সিমান্তের ভিতরের মানুষগুলোর উপরে গুলি চালায়। আর এই অবস্থায় বিএসএফ সুযোগ বুঝে বিজিবিদের সাহায্য করে, দেখে মনে হয় দুজনের উদ্দেশ্যই এক, নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের হত্যা করা। কিন্তু ভারতকে সম্পূর্ণ ক্রেডিট দেয়াটা আসলে উচিৎ হবে না, কারন সমস্যা হচ্ছে নিজের দেশের মীর জাফরদের। যারা নিজের ঘরের দরজা খুলে দিয়ে বিদেশীদের আমন্ত্রণ জানায় নিজের মা বোনের সম্ভ্রমহানী করার জন্য, নিজের বাপ ভাইয়ের বুকে গুলি চালানোর জন্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।