আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাম্প্রদায়িক আক্রমণঃ সুদূর অতীতের শৌর্য-বীর্যের নিস্ফল কথনে বাড়বে বই কমবেনা

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।

বাংলাদেশে গত ৪২ বছরে সংঘটিত বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক আক্রমণের ব্যাখ্যা - বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেকেই সচেতন - অসচেতন উভয়ভাবেই এই ভূখন্ডের হাজার বছরের ইতিহাসকে সেই আলোচনা - বিশ্লেষণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেননা । ফলশ্রুতিতে মৌলবাদ , সাম্প্রদায়িকতা , রাজনীতিতে ধর্মের প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণাসমূহ শুরুতেই অনেকটা বস্তুনিষ্ঠতা হারিয়ে বাগাড়ম্বরসম্পন্ন মুখস্থ বাক্যমালায় পরিণত হয় ।

এই ভূখন্ডের ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যে কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষণের সময় যেই বিষয়টি লক্ষ্য রাখা দরকার তা হলো এই ভূখন্ডের মুসলমান শাসকগোষ্ঠীর ' ধর্ম ' এবং বৌদ্ধ থেকে নীম্ন বর্ণের হিন্দু অতঃপর বর্ণপ্রথার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দলে দলে নীম্নবর্ণের হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা বিষয় দুটি পৃথক মনোযোগের দাবী রাখে । আমরা যদি এই ভূখন্ডের মুসলমান শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক চরিত্রের দিকে লক্ষ্য করি তবে দেখা যাবে তারা চারিত্রিকভাবেই তীব্র আত্মপরিচয় সংকটের কারণে নিজেদের আরব , ইরানী , তুর্কী এদের বংশধর হিসাবে পরিচিত হতে চাইতো ।

এই ভূখন্ডের জল , মাটি , এসবের কিছুর সাথেই তাদের সম্পৃক্ততা ছিলোনা তার কারণ ভারতবর্ষের হাজার বছরের অনড় , অচল অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক কাঠামোর কনামাত্র কোন পরিবর্তনও ব্রিটিশপূর্ব অন্যান্য শাসকগোষ্ঠীর মতো মুসলমান শাসকগোষ্ঠীরা করতে সমর্থ হয়নি । স্পষ্ট কথায় বললে সেই সদিচ্ছাও তাদের ছিলোনা । একদিকে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠদের অনেকাংশই পূর্বে নীম্ন বর্ণের হিন্দু , তারও আগে বৌদ্ধ ছিলো বলে তারা সমাজে ' নেড়ে ' ( বৌদ্ধরা মুন্ডিত মস্তকে থাকতো বিধায় এই নামকরণ ) বলে পরিচিত ছিলো । অন্যদিকে মুসলমান শাসকগোষ্ঠীরা ছিলো নিজেদের আরব , ইরানী , তুর্কীদের বংশধর বলে পরিচয় দেওয়া আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগা লুন্ঠণকারী চরিত্রে । শ্রদ্ধেয় গবেষক ও লেখক বিনয় ঘোষের বর্ণনানুসারে মুসলমান শাসকগোষ্ঠীদের আমলে স্থাপত্যকলায় প্রভূত উন্নতি সাধিত হলেও নগরপরিকল্পনায় কোন প্রকারের চিন্তাশীলতার জায়গা সেই শাসকগোষ্ঠীর ছিলোনা ।

কারণ সেই সময়কার সমাজের রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক কাঠামোর কনামাত্র পরিবর্তন করবার সদিচ্ছাও তারা রাখেনি ।

ব্রিটিশদের এই ভূখন্ডে আগমনের পরবর্তী সময়ের বিশদ ব্যাখ্যায় না গিয়ে যদি এতোটুকুই বলা হয় যে ব্রিটিশপূর্ব সময়ের মুসলমান শাসকগোষ্ঠীর তথাকথিত শৌর্য-বীর্যের প্রতি মোহগ্রস্ততা সেই সময়কার মুসলমান শাসকগোষ্ঠীর ও মুসলমান সমাজের অপেক্ষাকৃত নিঁচু শ্রেণীর একাংশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিলো তবে বোধহয় খুব একটা অত্যুক্তি হবেনা । এই পরিস্থিতিরই সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী এবং এক সময়ে হিন্দু শাসকগোষ্ঠীরা মুসলমানদের নিপীড়িত অংশ যারা অতীতে নীম্ন বর্ণের হিন্দু ছিলো তাদের পদানতই রাখে । ব্রিটিশরা তাদের শাসনের সুবিধার্তে বিভাজন এবং শাসন নীতিতে হিন্দু - মুসলমানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখে । ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান নামক দুইটি রাষ্ট্রের উৎপত্তির পেছনেও সেই ধর্মীয় বিভাজন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো ।



১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্মলগ্ন থেকেই একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয়েছিলো সেটা হলো ধর্মকে ভিত্তি ধরে কোন রাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে টিকে থাকতে সমর্থ নয় । অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক , সাংস্কৃতিক যেই বৈষম্য সেই রাষ্ট্রে ক্রিয়াশীল ছিলো সেগুলো বিশ্বের যে কোন ভূখন্ডে , যে কোন সময়েই অনতিক্রম্য । ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের উদ্ভব সেই পরিস্থিতিরই একটি অনিবার্য পরিণতি ছিলো । এবং আরো বাস্তব হলো ভারত উপমহাদেশের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিই অপেক্ষাকৃত সবচাইতে বেশী আধুনিক যদি আমরা রাষ্ট্রগুলোর উৎপত্তি ও তাদের জন্মলগ্নের ধরণ বিশ্লেষণ করি ।

১৯৭১ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ নামক যেই রাষ্ট্রকে আমরা দেখি সেই রাষ্ট্রের শুরু থেকেও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতা পরিলক্ষিত হয় ।

সংবিধানে ' ধর্মনিরপেক্ষতা ' থাকলেও তার জন্য অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যেই বাস্তবিক ভিত্তি স্থাপন করার প্রয়োজন হয় তার অনেকাংশই করা হয়নি । এই কারণেই রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই হিন্দুদের সম্পত্তি লুটপাট , মাদ্রাসা খাতে দেদারসে বিনিয়োগ ইত্যাদি মুসলমানদের নিপীড়িত জনগণকে পরকালমুখী করে তোলে । প্রবল অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক বৈষম্য সেই পরিস্থিতিকে টিকিয়ে রাখবার পেছনে অপরিহার্য ছিলো বললে তেমন ভুল বলা হবেনা । শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস , ঘৃণ্য হত্যাকান্ডের পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ , ১৯৯০ পরবর্তী সময়ের তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারসমূহ প্রত্যেকেই অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক স্বার্থে যেভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে এসেছে তাতে ধর্মনিরপেক্ষতার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়না । দেখা যাবে এমন কোন কারণও নেই ।

সেই চিত্রই প্রত্যাশিত ছিলো ।

যারা ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ দেখবার স্বপ্ন দেখেন বা স্বপ্ন দেখেন বলে দাবী করেন তাদের একাংশ এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ পন্থা অবলম্বন করেন । সেটা হলো রাজনীতিতে ধর্মের প্রতিক্রিয়াশীলতার কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তারা " প্রকৃত " ইসলাম ধর্ম এমন নিপীড়ণমূলক নয় , সুদূরঅতীতের ইসলাম ধর্ম এমন ছিলোনা , আগের ইসলাম ধর্ম শৌর্য-বীর্যে অতুলনীয় ছিলো এমন কথা বলতে থাকেন । কিন্তু তার পরিবর্তে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতিক্রিয়াশীলতা , ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো কখনো সমাজের নিঁচুতম শ্রেণীর অর্থনৈতিক , সামাজিক , রাজনৈতিক স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করেনা এই বিষয়গুলো তুলে আনা অনেক বেশী জরুরী । মনে রাখা দরকার ব্রিটিশপূর্ব সময়ে যেই শ্রেণীটি নীম্নবর্ণের হিন্দু থেকে মুসলমান বনে কালের পরিক্রিমায় আজও মুসলমান সেই শ্রেণীর কোনকালেই অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক কোন ক্ষমতা ছিলোনা এবং আজও নেই ।

সাম্প্রদায়িকতা , মৌলবাদ , ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবার সময়ে ইসলাম ধর্মের অতীতের শৌর্য-বীর্যের কথন , গৌরবের বর্ণনা ইত্যাদি বিষয়সমূহ সেই শ্রেণীর মানুষকে এক পাও এগিয়ে যেতে সাহায্য করবেনা , বরং দুই পা পিছিয়ে দিবে । অতীতকালে ইসলাম ধর্মের অবদান , সাফল্য ইত্যাদি বর্ণনার চাইতেও বর্তমানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ভয়াবহতা , রাজনীতিতে ধর্মের প্রতিক্রিয়াশীলতা টিকিয়ে রাখবার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতা দ্বারা পীড়িতদের সচেতন করাটা অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক এবং সময়ের দাবী । ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ না হোক নিদেনপক্ষে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সফল না হলে সাম্প্রদায়িক আক্রমণকে প্রতিহত করবার স্বপ্ন অলীক কল্পনা মাত্র ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.