আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘অরবিন্দ কেজরিওয়াল’—ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন ঝড়



যদিও দিন তারিখের এখনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয় নি, তবে খুব সম্ভবতঃ মে মাসে ভারতে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে তাই বেশ কিছুদিন থেকেই নির্বাচন ঘটিত সংবাদ ই প্রাধান্য পাচ্ছে। আর নির্বাচন নিয়ে আলাপ আলোচনার মধ্যে প্রধান যে আলোচনা হয়, তা হচ্ছে, কে জিতবে? অর্থাৎ কোন দল। তবে এবার সেখানে, আলোচনা অনেকটাই ব্যক্তি কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। কোন দল জিতবে, এই আলোচনার চেয়ে অনেক বেশি আলোচনা হচ্ছে, কে প্রধান মন্ত্রী হচ্ছে।

কট্টর হিন্দুবাদী নেতা হিসেবে পরিচিত নরেন্দ্র মোদীকে এবার বিজেপি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে ‘প্রোজেক্ট’ করছে। ওপর দিকে এখনও কংগ্রেস প্রার্থী ঠিক না হলেও, রাহুল গান্ধীর সম্ভাবনা প্রবল।
কিছুদিন আগে পর্যন্তও নির্বাচনী আলোচনার মুখ্য বিষয় বা ব্যক্তিত্ব ছিল, ‘নরেন্দ্র মোদী। আলাপ আলোচনায় মূল টপিক ছিল ‘তিনি কি প্রধান মন্ত্রী হতে যাচ্ছেন?’ তাঁর সম্ভাবনা প্রবল কিংবা বলা যায় রাহুল গান্ধীর সম্ভাবনা বেজায় ক্ষীণ হওয়ায়, পত্র পত্রিকা আর টিভি চ্যানেল গুলোতেও তিনি বেশ ভালো রকমের ‘কাভারেজ’ পাচ্ছিলেন। প্রধান মন্ত্রীর সম্ভাবনার ওপর করা প্রায় সব ‘জনমত জরিপ’ এ তার জয় ছিল একচেটিয়া।

জরিপে অপর বৃহৎ রাজনৈতিক দল কংগ্রেস এর নেতা সোনিয়া গান্ধী কিংবা রাহুল গান্ধী বেশ অনেকটাই ছিলেন পিছিয়ে। ‘ডিসট্যান্ট সেকেন্ড’ বলতে যা বোঝায়। বর্তমান প্রধান মন্ত্রী মনমোহন সিং কিছুদিনে আগে জানিয়ে দেন তিনি তৃতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হচ্ছেন না। ফলে তিনি সরে গেলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী প্রত্যাশী, তা কংগ্রেস এখনও জানায় নি। এদিকে কোন কংগ্রেস প্রার্থী কে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী ভাবা লোকের সংখ্যা দিন দিন কমছিল।

অবস্থা এমন হওয়া শুরু হয়েছিল, একই সময়ে প্রধান মন্ত্রী আর নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ থাকলে, সংবাদ মাধ্যম গুলো নরেন্দ্র মোদীর ভাষণকেই সবাই গুরুত্ত্ব দিয়ে প্রচার করছিল।
যদিও ভারতের সকল রাজ্যে বিজেপির উপস্থিতি নেই। তারপরও যেগুলোতে আছে, সেখানে থেকে অধিকাংশ সিটে জয়ী হলে দুইশত র কাছাকাছি জুটে যেতে পারে। ৫৪৩ আসনের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে প্রয়োজনীয় ২৭২ হতে বাকী যে সাংসদ প্রয়োজন তা হয়তো বিভিন্ন সমমনা দলের কাছ থেকে জুটে যাবে বলে বিজেপির ধারণা। যদিও এই মুহূর্তে তাঁদের সঙ্গে জোট বদ্ধ অবস্থায় থাকা দলের সংখ্যা বেশ কম, তারপরও তাঁদের ধারণা, সরকার গঠনের সম্ভাবনা দেখা দিলে, অনেক আঞ্চলিক দল তাঁদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

তখন প্রয়োজনীয় ২৭২ জন সাংসদ পাওয়া সমস্যা হবে না। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, দুর্নীতির অভিযোগে বর্তমান ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের পর্যুদস্ত অবস্থা। ‘টু জি’ ‘কয়লা খনি বণ্টন’ সহ বেশ কিছু সরকারী সিদ্ধান্তে বিভিন্ন ধরনের কেলেঙ্কারির খবরে তাঁদের অবস্থা এখন বেশ নাকাল। তাই ভোটে খুব বেশি সাফল্য তাঁদের আসবে এমনটা অনেকেই ভাবছে না।
বাকী সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে খুব বেশি ঐক্য না থাকায় এবং কারো পক্ষেই একক ভাবে খুব বেশি আসনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায়, ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশ প্রবল।

সেক্ষেত্রে একক সংখ্যা গরিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা, বিজেপির। আর তেমনটা হলে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদী র সম্ভাবনা অনেকেই উজ্জ্বল ভাবতে শুরু করেন। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার আকর্ষণীয় বাচন ভঙ্গী। দারুন টিভি কাভারেজ। কিছুটা তাঁর গুণে, কিছুটা ওপর পক্ষের দুর্বলতার কারণে।

ফলে গুজরাট দাঙ্গা র কলঙ্ক গায়ে থাকলেও অনেকে ভাবছিলেন, তিনি হয়তো সেই অতীতকে পেছনে ফেলতে পারবেন। উন্নয়ন, সুশাসন এজাতীয় কথা বলে অনেকের কাছে, বিশেষ করে যুব সমাজের কাছে জনপ্রিয় হয় উঠছিলেন। এমন সময় উদয় হন নতুন এক নক্ষত্র। মূল দুটি বৃহৎ দলের জন্য ঝড়-- অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের উত্থানকে ঠিক হঠাৎ বলা ঠিক হবে না।

আই আই টি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার পাশ করা মানুষটি কিছুদিন টাটা স্টিল এ এবং আরও পরে ইনকাম ট্যাক্স অফিসার হিসেবে কাজ করেন। পরিবর্তন নামের এক এন জি ও র মাধ্যমে, ঘুষ ছাড়া কাজ করানোর এক পরিকল্পনা শুরু করেন। এরপর তিন বছর আগে আন্না হাজারে যখন ‘রাইট টু ইনফরমেশান’ এর আন্দোলন শুরু করেন তখন তিনি এর সঙ্গে যুক্ত হন। একসময় চাকরী ছেড়ে দিয়ে আন্না হাজারের সঙ্গে ‘জন লোকপাল’ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ‘অনশন’ সহ সব ধরনের আন্দোলনের আন্না হাজারের সঙ্গেই তিনি ছিলেন।

সরকার লোকপাল বিল নিয়ে গড়িমসি করায় তিনি একসময় সিদ্ধান্ত নেন, তিনি নিজেই রাজনৈতিক দল গঠন করবেন। সমমনা কয়েকজন কে নিয়ে তৈরি করলেন ‘আম আদমী পার্টি’।
প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের দেশে নতুন একটি রাজনৈতিক দল তেমন কিছু করতে পারবে না ভেবে কেউই তাঁকে প্রথমে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেয় নি। প্রাইভেট কোম্পানির হাতে দিয়ে দেয়া বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা দুর্নীতি গ্রস্থ বলে বিদ্যুৎ বিল বেশি আসছে। এই দাবিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু করেন দিল্লি তে।

সোনিয়া গান্ধী র জামাতা রবার্ট ভদ্র এর এক দুর্নীতির পুরো বিবরণ প্রমাণ সহ হাজির করে কংগ্রেস দলকে দারুণ সমস্যায় ফেলে দেন। বিজেপির দলীয় প্রধান নিতিন গাডকারীর বিরুদ্ধে আনা তাঁর দুর্নীতির অভিযোগের কারণে তাঁকে দলীয় প্রধানের পদ থেকে সরে যেতে হয়। এভাবে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তিনি প্রদপ্রদীপের নীচে আসতে থাকেন। বিভিন্ন টক শো তে তাঁর ‘আম আদমি পার্টি’র সরব উপস্থিতি তাঁদের সম্পর্কে সকলকে আগ্রহী করে তোলে।
গত ডিসেম্বরে ভারতের চার রাজ্যে প্রাদেশিক নির্বাচন হয়।

সেখানে দিল্লীতে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেন। একেবারে ভিন্ন ধারার রাজনীতির সুচনা করেন। প্রধান দুই বড় দলের বিরুদ্ধে একাই লড়তে মাঠে নামেন। দুর্নীতি কে দেশের প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন। আগে যেখানে, সাম্প্রদায়িকতা নির্বাচনী ইস্যু হত সেখানে এবার জনগণের সঙ্গে জড়িত বিষয় নির্বাচনী ইস্যু হতে শুরু করল।

পরিস্কার পানি, বিদ্যুতের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি র মত জনগণের প্রতিদিনের ইস্যু, প্রাধান্য পেল তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহারে। প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক যোগ দিতে লাগলো তাঁদের দলে। এলাকায় যে জানতে চাইলেন, নির্বাচনে কাকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান। এভাবে নির্বাচিত হল, তাঁদের প্রার্থী।
এমন সব নতুন প্রচারণার ওপর ভর করে দিল্লীর অ্যাসেম্বলি ইলেকশানে পেয় গেলেন ২৮ টি সিট।

৭০ সদস্যের বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও, তাঁরা সংখ্যালঘু সরকার গঠনের জন্য আস্থা ভোটের সম্মুখীন হলেন। কংগ্রেস দল সমর্থন করল। এরপর থেকে প্রতিনিয়ত নতুন সব রীতিনীতি চালুর মাধ্যমে ভারতিয় রাজনীতির খোল নালচে বদলানোর কাজ শুরু হয়ে যায়। আর সব সাধারণ মানুষের মত, রাস্তায় চলাচল শুরু করলেন দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী। ট্রাফিক লাইটে থামা, কোন ‘সিকিউরিটি’ না নেয়া সহ দারুন কিছু ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনীতির নিয়ম পাল্টে দিতে শুরু করলেন।

রাজনৈতিক ভাবনায় সবচেয়ে বড় যে আঘাতটি করলেন তা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত বৃহৎ দলগুলোকে খুব সাধারণ একজন মানুষও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে।
দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি থেকে বেরিয়ে না আসলে জনগণ তাদেরকেও আস্তাকুড়ে ছুড়ে দিতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর যে চিরাচরিত ভাবনা ছিল, ‘জনগণ যাবে কোথায়, আমাদেরকেই ভোট দিতে হবে’ তাঁর মুলে কুঠারাঘাত করতে পেরেছেন। ক্ষিপ্ত সাধারণ মানুষ এক হতে পারলে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর হাড়ে কাঁপন ধরাতে পারে, তা তিনি প্রমাণ করে দিলেন। ভারতীয় রাজনীতিতে ওঠা এই ঝড়, তাঁদের সাধারণ নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা হয়তো সময় বলে দেবে।

তবে ক্রমাগত জনগণ থেকে দূরে সরে যাওয়া, দুর্নীতিতে নাক ডোবানো এসব প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোকেও যে চ্যালেঞ্জ করা যায়, তা তিনি প্রমাণ করে দেখালেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।