আত্মমাঝে বিশ্বকায়া, জাগাও তাকে ভালোবেসে
সাহিত্যে আপনি কার দ্বারা প্রভাবিত? একজন ভারতীয় লেখক হিসেবে আপনি কী তা সনাক্ত করতে পেরেছেন? প্রশ্নটি করা হয় ভারতীয় লেখক অরবিন্দ আদিগাকে। প্রত্যুত্তরে তিনি জানান, ‘আমার ওপর নয়, বইটি লেখার পেছনে কাদের প্রভাব ছিল সেটা বলাই বোধ করি ভালো। ‘দ্য হোয়াইট টাইগার’ রচনার পেছনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর তিন কালো আমেরিকান লেখকের প্রভাব ক্রিয়াশীল ছিল। তাঁরা হচ্ছেন, রালফ এলিসন, জেমস বাল্ডউইন ও রিচার্ড রাইট। আমি ল্য করি ‘দ্য হোয়াইট টাইগার’ কী ভীষণ ভাবে তাদের কাছে ঋণী।
তবে একজন লেখক হিসেবে কোনও একজনের পরিচয় চেপে বসুক তা চাই না, আমি আমার অনুভূতিকে আঁকতে পেরেই খুশি, তা সে যেখান থেকেই আসুক না কেন। ’ অরবিন্দ’র এই উত্তর থেকে তাঁর স্বতন্ত্র হয়ে ওঠার একটি পর্যায় আমাদের কাছে ধরা দেয়।
ভারতীয় সাংবাদিক ও লেখক অরবিন্দ আদিগা তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য হোয়াইট টাইগার’ এর জন্য ২০০৮ সালের ম্যান বুকার পুরস্কার জয় করেছেন। ১৯৭৪ সালে মাদ্রাজ- এ জন্ম নেয়া অরবিন্দ ভারতে জন্ম নেয়া চতুর্থ লেখক যিনি সাহিত্যের অন্যতম সম্মানজনক এই পুরস্কার পেয়েছেন। ইতোপূর্বে তিন ভারতীয় সালমান রুশদি, অরুন্ধতি রায় ও কিরন দেশাই বুকার পেয়েছেন।
এবারের বুকারের সংক্ষি্প্ত পাঁচ উপন্যাসের তালিকায় অপর ভারতীয় অমিতাভ ঘোষের ‘সি অব পপিস’ ছিল।
‘দ্য হোয়াইট টাইগার’ এর মূল কাহিনী আবর্তিত হয়েছে বলরাম হালাওয়ি নামে একজন মানুষকে কেন্দ্র করে। শ্রমজীবী মানুষ থেকে কীভাবে দুর্নীতি আর অপরাধের মাধ্যমে একজন মানুষ ব্যবসায়ী উদ্যোক্তায় পরিণত হয় সেই কাহিনী চিত্রিত হয়েছে ‘দ্য হোয়াইট টাইগার’ এ। সাতরাতে লেখা একটি ধারাবাহিক চিঠির আদলে নির্মিত হয়েছে ‘দ্য হোয়াইট টাইগার’ এর শরীর। তবে চিঠিটি হচ্ছে অজুহাত মাত্র।
প্রকৃত অর্থে বলরাম যে শহরে বাস করে, সে শহরের একজন সফল ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা সে। সেই ব্যাঙ্গালোর পরিদর্শনকালে চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও এর কাছে লেখা চিঠির মাধ্যমে ভারতের দারিদ্র, দুর্নীতি, শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা প্রভৃতি চিত্রই উঠে এসেছে। সেই দীর্ঘ ধারাবাহিক চিঠিতে বলরাম নিজের জীবনের কথা বলে, নিজের অপরাধের স্বীকারোক্তিমূলক বয়ানও রয়েছে শব্দের দীর্ঘ কাফেলায়।
প্রথম দিকে বর্ণনায় আমরা জানতে পারি, বলরাম একটি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কিছুকাল সে স্কুলে পড়াশোনা করেছে।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিলেও ছোট থেকেই বলরাম ছিলেন সপ্রতিভ। আর এ বিষয়টিই ধরা পড়ে স্কুল পরিদর্শকের চোখে, যিনি বলরামকে ‘হোয়াইট টাইগার’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ‘হোয়াইট টাইগার’ অর্থাৎ শাদা বাঘ, প্রাণীজগতে যা বিরল। স্কুল পরির্দশক কথা দিয়েছিলেন স্কুলে যথাযথভাবে পড়াশোনার জন্য বলরামের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তার পরিবার তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটি চায়ের দোকানে কাজে লাগিয়ে দেয়।
পারিবারিক বন্ধন এখানে অনেক বড় আর শক্ত যা দায়িত্বের ঘেরাটোপে বন্দি। ফলে এখানে কর্মক্ষম প্রত্যেককেই পরিবারের দেখভালের দায়িত্ব নিতে হয়। বলরাম ধীরে ধীরে পরিবারের সাথে তার দূরত্ব তৈরি করে। কিন্তু তা মাত্র ক্ষণিকের। পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে ড্রাইভিং শেখার ব্যবস্থা করা হয়।
আর এটাই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এক আত্মীয়ের মাধ্যমে দিল্লিতে মি. অশোক ও তার স্ত্রী পিংকি ম্যাডামের ড্রাইভার হিসেবে চাকরির ব্যবস্থা করে। ফলে তার দরিদ্র পরিবার থেকে সে দুরে সরে আসার সুযোগ পায়। বলরাম ব্যাখ্যা করে কেন ভারতের ভৃত্যরা সৎ হয়। সুযোগ কোনও বিষয় নয়।
ভারতের একজন ভৃত্য তার মনিবের কাছ থেকে বাড়তি কোনও সুবিধা আদায় করে না, এমন কী সত্যিকার অর্থে তা হাতে ধরা দিলেও না। আর এ বিষয়টি চলে আসে পরম্পরাগতভাবে। ফলে একজন ভৃত্যেও কাছেও মিলিয়ন ডলার নিশ্চিন্তে গচ্ছিত রাখা যায়।
বলরাম দেখিয়েছে, কীভাবে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিকদের ঘুষ বা উপঢৌকন দিয়ে সন্তুষ্ট রেখে নির্বিঘ্ন তাদের সুবিধা আদায় করে, বর্তমান ভারতের অবস্থার সঙ্গে যা বেশ সঙ্গতিপূর্ণ। ভারতের নির্বাচনী রাজনীতি, স্কুল শিকদেও দুর্ণীতি প্রভৃতি নানা বিষয় উঠে এসেছে ‘দ্য হোয়াইট টাইগার’ এ।
বলরামের লেখা দীর্ঘ চিঠিগুলো কী চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও এর কাছে পৌঁছেছিল? কোনও সন্দেহ নেই পৌঁছেনি। কিন্তু এটি একটি কৌশল বটে। এর মাধ্যমে পাঠক বর্তমান ভারতের এটি অন্ধকার অংশের যথাযোগ্য চিত্র পর্যবেণ করতে পারেন নিঃসন্দেহে। অরবিন্দ আদিগার সাফল্য এখানেই। এসব কারণেই বুকারের বিচারক প্যানেলের প্রধান মাইকেল পরটিলো ‘দ্য হোয়াইট টাইগার’ কে পুরস্কতারের জন্য মনোনীত করার কারণ হিসেবে ভারতের অন্ধকার দিকের প্রতিনিধিত্বকেই মূল বলে উল্লেখ করেছেন।
তার মতে, ‘অসামান্য কৌশল প্রয়োগের ফলে এ উপন্যাসের নায়ক আমাদের সহানুভূতি আদায় করে নেন, যিনি শেষ পর্যন্ত আসলে খলনায়কই। ’ তিনি জানান, বিচারকেরা দীর্ঘ দুইঘণ্টা তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনার পর ‘দ্য হোয়াইট টাইগার’ কে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে। বিচারের ব্যাপারে পোরটিলোর বক্তব্য হচ্ছে, ‘বইটি কী আমার ভেতরে প্রবল আলোড়ন তুলেছে? এটি তাতে সফল হয়েছে। ’
অরবিন্দ আদিগার পড়াশোনার হাতেখড়ি মাদ্রাজের ডন বসকো স্কুলে। সেখানে তিনি কাস নাইন পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।
এরপর পরিবারের সাথে তিনিও ম্যাঙ্গালোর যান, সেখানে কানারা হাই স্কুলে ভর্তি হন। কিছুদিন পড়াশোনার পর সেন্ট অ্যালয়সিয়াস কলেজে ভর্তি হয়। ১৯৯০ সালে রাজ্যের মধ্যে প্রথম স্থান নিয়ে তিনি মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হন। অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসী হিসেবে পরিবারের সঙ্গে তিনিও সিডনি চলে যান। সেখানে তিনি জেমস রুসে এগ্রিকালচারাল হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন।
ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকেই ১৯৯৭ সালে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।
অর্থনীতি বিষয়ে সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন অরবিন্দ। তাঁর বেশকিছু প্রতিবেদন ‘ফিনান্সিয়াল টাইমস’ ‘মানি’ ও ‘ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল’ এ প্রকাশিত হয়েছে। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরুর প্রায় ৩ বছর আগে তিনি ‘টাইম’ ম্যাগাজিনেও কাজ করেছেন।
বর্তমানে অরবিন্দ আদিগা ভারতের মুম্বাই এ বসবাস করছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।