আমাদের গাড়িটি যখন একটি নিঝুমপুরীর লৌহফটকের সামনে থামলো তখন রাত সাড়ে বারোটা। ফটকের গায়ে লেখা শ্রী অরবিন্দ আশ্রম, দিল্লী ব্রাঞ্চ।
ঢাকা থেকে দিল্লীর উদ্দেশে রওয়ানা দেবার পর সব মিলিয়ে প্রায় পঁচিশ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। বলতে গেলে তখন মধ্য রাত। সব কিছু শুনশানই থাকার কথা।
কিন্তু আমরা যারা রাজধানী ঢাকার অধিবাসী, তাদের কাছে রাত বারোটাÑ বলতে গেলে সবে রাতের শুরু। আর ঢাকার রাস্তাঘাটÑ বিশেষ করে যে সব এলাকায় দোকানপাট হোটেল রেস্টুরেন্ট এসব থাকে সেখানে তো বলতে গেলে বারোটা হলো সন্ধ্যে-রাত। যাই হোক আশ্রমের লৌহ ফটকের সামনে গাড়ি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমরা ভেতরে ঢোকার ছাড়পত্র পেলাম। দীর্ঘ পথশ্রমে প্রচণ্ড ক্লান্ত আর নানা কারণে তিতিবিরক্ত মন নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে প্রাঙ্গণে পা রাখতেই একটা নির্মল বাতাসের ঝাপটার সাথে তেজস্ক্রিয় কোন ভেষজ যেন আমাদের শরীরের ভেতর ঢুকে পড়ে। আমাদের দেহ ক্লান্ত, কিন্তু মন সতেজ হয়ে ওঠে অরবিন্দ আশ্রমের নিসর্গের ছোঁয়ায়।
অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতা আর প্রশান্তির ছায়ামাখা খোলা প্রাঙ্গণটি এক ধরনের উদার ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে আমাদের স্বাগত জানায়।
ঢাকা থেকে দু হাজার দশ সনের তেইশ মার্চ রাত বারোটার বাসে রওয়ানা হয়ে পরেরদিন বেলা তিনটার সময় আমরা কোলকাতা পৌঁছি। দলে আমরা পাঁচজন। আমি ছাড়া আছেন কবি কাজী রোজী, কবি ও প্রাবন্ধিক মাসুদুজ্জামান , কথাসাহিত্যিক পাপড়ি রহমান ও কবি ও সাংবাদিক নিতুপূর্ণা। সার্ক রাইটার্স ফাউশেনের সভাপতি অজিত কৌরের আমন্ত্রণে আমরা এসেছি সার্ক লেখক উৎসবে যোগ দিতে।
আমাদের মধ্যেকার একজন সদস্যের গোঁয়াতুর্মির কারণে কোলকাতা থেকে কালকা মেলের যাত্রী হয়ে আমাদের দিল্লী আসতে হয়। প্রায় তিরিশ ঘণ্টার এক দীর্ঘ যাত্রা। সেই একজন ছাড়া বাকি সবারই আমাদের ঢাকা টু দিল্লী কালকা ট্রেনের প্রথম অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য ছিলো খুবই তিক্ত আর বিরক্তিকর। অনভ্যাস আর অনভিজ্ঞতার কারণে আমাদের যথেষ্ট কষ্ট হয়েছিলো, তবে পরবর্তী সময়ে মনে হয়েছে কালকা মেলের এই ভ্রমণটা না হলে আমাদের প্রতিবেশী দেশের সাধারণ মানুষের রেলভ্রমণ সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেকখানিই অজ্ঞ থেকে যেতাম।
যাই হোক, কালকা মেলের ভ্রমণ বৃত্তান্ত এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে আপাতত থাকছে না।
‘অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার’ বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁর ভাব শিষ্যত্ব গ্রহণ করে আপন অধ্যাত্মচেতনা ও অতীন্দ্রিয় অনুভূতিকে এক গভীরতর জীবনবোধের সংরাগে রাঙিয়ে নিতে পেরেছিলেন, সেই মহর্ষি শ্রী অরবিন্দের কর্মজীবন ও অধ্যাত্ম সাধনার কথা কিছুটা জানা আছে। শুধু ভারতবর্ষেই নয় সারা বিশ্বের মনীষীদের মধ্যেই ঋষি অরবিন্দ অন্যতম। উচ্চ শিক্ষা ও বিশাল পাণ্ডিত্যের অধিকারী অরবিন্দ ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, দার্শনিক, কবি ও মানবতাবাদী ঋষি। ১৮৭২ সালের ১৫ আগস্ট কোলকাতায় এক শিক্ষিত বনেদী পরিবারে শ্রী অরবিন্দের জন্ম।
কেম্ব্রিজ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করে আইসিএস হয়েও তিনি সরকারী চাকুরির গণ্ডিতে আবদ্ধ হননি। কিছুদিন বরোদার রাজস্ব বিভাগে চাকুরি, দীর্ঘ তের বছর সেখানেই ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করার পর অরবিন্দ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন সংক্ষিপ্ত হলেও ঘটনাবহুল ছিলো। আলিপুর বোমা হামলার আসামী হয়ে এক বছর জেল খেটেছেন। জেল থেকে মুক্তি পাবার পর তিনি আধ্যত্মিকতার পথে পা বাড়ান।
পণ্ডিচেরিতে গড়ে তুললেন অধ্যাত্ম ও যোগসাধন কেন্দ্র। স্থাপন করলেন আশ্রম। দিল্লীর আশ্রমটি পণ্ডিচেরির ‘সাধনা’ কেন্দ্রের একটি স¤প্রসারিত শাখা। অরবিন্দের শিষ্যা ও সাধনসঙ্গিনী মাতা মীরা ১৯৫৬ সালের ১২ ফেব্র“য়ারি এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।
রিসিপশনে মিনিট পনেরর আনুষ্ঠানিকতার পর আমরা রুম পেলাম।
প্রশস্ত রুচিশীল তবে অনাড়ম্বর, আর এক অদ্ভুত শুচিতায় পরিপূর্ণ ঘর। দেয়ালে ঝোলানো ফ্রেমে মীরা মাতার চোখ থেকে ঝরে পড়ছে প্রসন্ন স্নেহদৃষ্টি।
দীর্ঘ পথের যাত্রায় আমরা ক্লান্ত অবসন্ন। কাজেই আমাদের প্রথম কাজটিই হলো একটি নিটোল গোসল সারা। এবার পেটের দায়।
দল বেঁধে আমরা নিচে নেমে এলাম খাদ্যের সন্ধানে। পেটে তখন ছুঁচোর কেত্তন চলছে। রাত তখন প্রায দেড়টা। চারপাশ শুনশান। নিশাচর পাখি-প্রহরী ছাড়া কারো তখন জেগে থাকবার কথা নয়।
কিন্তু তবু আমরা নৈঃশব্দ্যের শতরঞ্চি মাড়িয়ে টুকটুক করে হাজির হই ডাইনিঙে। এত রাতে কে আমাদের জন্য পাত সাজিয়ে বসে থাকবে?
এই নাকি আশ্রমের মেহমানদারী? চোঁ চোঁ পেটে আমাদের আর কোন কাব্যিক ভাবনা মগজে ঢোকার সাহস পায় না। টের পেলাম সজল উপবাস দেয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। প্রশান্ত বলে যে তরুণ আমাদের দিল্লী রেল স্টেশন থেকে নিয়ে এসেছিলো, রুমে ঢোকা পর্যন্ত যে আমাদের সার্বক্ষণিক সাহায্য করেছে, তাকেও আর দেখতে পেলাম না।
তখন আশ্রমের চারপাশ থেকে ঘন জালের মতো নেমে আসছে ঘুম আর ঘুম।
এর মাঝে প্রশান্ত কেন জেগে বসে থাকবে? ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে আমরা রুমে ফিরে আসতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলি পথ। সব দিকই একরকম। একরকম ঘোরানো সিঁড়ি, একরকম গোল প্যাটার্নের এক একটা উইং। অরবিন্দ আশ্রমে আমরা মোট তিনদিন ছিলাম। এই তিনদিনে বেশ কয়েকবার আমরা বাইরে আসা যাওয়া করেছি, কিন্তু অদ্ভুত গোলকধাঁধার মতো স্থাপত্য শৈলীর কারণে প্রত্যেকবারই আমাদের কেউ না কেউ ভুল করে অন্য দিকে চলে গিয়েছি অথবা নিজের রুমটি খুঁজতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়েছি।
যাই হোক সে রাতে আমরা আশ্রমের বিশুদ্ধ পানীয় জলের ট্যাপ থেকে জগ ভরে এনে ঢক ঢক গিলে ফেলে বিছানায় ধপাস করে আমাদের দেহখানা ফেলে দিই।
পরদিন সকাল আটটার মধ্যে নাশতা শেষ করে পৌনে নয়টার মধ্যে রেডি থাকতে হবে। আশ্রম থেকে নির্দিষ্ট বাসে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে অনুষ্ঠানস্থলে। দশটায় সার্ক সাহিত্য উৎসবের উদ্বোধন। রাতেই আমাদের এই সময়সূচি জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
সেই মোতাবেক আমরা ভোর সাতটার মধ্যেই নেমে আসি নিচে।
সারা রাতের নিরবচ্ছিন্ন ঘুম আমাদের দেহের ক্লান্তি দূর করলেও পেটের ক্ষুধা দূর করতে পারেনি। কিন্তু প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াতেই ভোরের আলোয় আশ্রমের শান্ত স্নিগ্ধ উদার পরিবেশ আমাদের ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা যেন ভুলিয়ে দিলো। পরিপাটি পোশাক পরা কয়েকজন মেয়ে স্মিতমুখে সম্মার্জনী হাতে প্রাঙ্গণের মাঝখানের বিশাল গোল জলাধারের চারপাশ থেকে ঝরাপাতা পরিষ্কার করছে। আশেপাশে ময়লা বলতে ঝরাপাতা।
আশ্রমের এখানে সেখানে বড় ছোট নানা জাতের গাছ। তবে সবই সুরচিত। ভোরের হালকা বাতাসে ঝুরঝুর করে ঝরে ঝরছে পাতা। আমার মনে হলো ঐ ঝরাপাতার শব্দ ছাড়া আর কোথাও যেন কোন শব্দ নেই। রাত শেষ হবার সাথে সাথে জেগে উঠেেেছ কর্মচাঞ্চল্য, কিন্তু শব্দহীন এক সাধন ক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেন চলছে সব কাজ।
প্রশান্ত তপোবনের ভেতর প্রকৃতির সামগানই শুধু ভোরের শব্দ।
প্রথম দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এক যান্ত্রিক প্রাণহীন নিয়মতান্ত্রিকতায় বুঝি সবাই আবদ্ধ। এখানে বসা যাবে না। ওখানে দাঁড়ানো যাবে না। ফুল তো দূরের কথা একটা পাতাতেও হাত দেয়া যাবে না।
কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই আশ্রমের নিঃশব্দ প্রকৃতি আর তপশ্চর্যার পরিবেশ আমাদের রীতিমতো বশীভূত করে ফেলে।
ডাইনিঙে ঢুকে দেখি কাজী রোজী, মাসুদুর রহমান আর সেলিনা হোসেন একটা টেবিলে বসে গল্পে মশগুল গেছেন। সেলিনা হোসেনও গত রাতে এসে পৌঁছেছেন এখানে। সারা হলরুমে এরই মধ্যে অনেক লোকজন এসে গেছেন। কেউ কেউ সামনে একখানা ট্রেতে কিছু খাবার নিয়ে খাওয়াও শুরু করেছেন।
নানা জাতের মানুষ। এর মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা লেখক-উৎসবের সাথে সম্পৃক্ত নন। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে এখানে অতিথিদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
আশ্রমের ডাইনিং আত্মসেবামূলক। নিজের থালাবাটি গেলাশ সব তাক থেকে তুলে নেয়া থেকে শুরু করে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নেয়া, খাওয়া শেষে এঁটো থালাবাটি ধুয়ে মুছে আবার নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে আসা পর্যন্ত সব নিজেকেই করতে হবে।
কেউ কারো ওপর নির্ভর করতে পারবে না। খাবারও খুব সাধারণ, নিরামিষ। মাছ মাংস তো বটেই, এমন কি ডিমও খাবারের তালিকায় থাকবে না।
প্রথম সকালে আমরা খিচুড়ি মনে করে আনন্দের সাথে যে খাবারটি পাতে তুলে নিলাম মুখে দিয়ে দেখি বিজাতীয় স্বাদের এক তণ্ডুল সেদ্ধ, পরে বুঝতে পারলাম তা ছিলো বাজরার খিচুড়ি। আর ডিমের আশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে সোনামুখ করে খেয়ে নিয়েছিলাম সবজি সেদ্ধ।
অবশ্য ভুট্টার পাঁউরুটি আর দুধ ছিলো প্রতিদিনই কমন। পরের দিনের সকালের নাশতায় ইডলি আর রাইতার ঝোল দেখে রোজী আপার যখন কেঁদে ফেলার যোগাড় তখন ঐ দুধ আর ভুট্টার পাঁউরুটিকেই মনে হয়েছিলো ‘এক পাত বাংলাদেশ। ’
মাঝখানে প্রশস্ত গোল প্রাঙ্গণের চারপাশে সাজানো বাগানের পরিচর্যা চলছে। এই প্রাঙ্গণের একপাশে ডাইনিং, একদিকে প্রশাসনিক ভবন, উত্তর দক্ষিণ দুদিকে আবাসিক ভবন আর লাইব্রেরি। ‘তপস্যা’ আর ‘নলেজ’।
সেলিনা হোসেন আগেও এসেছিলেন এখানে। তাঁর সবই চেনা। তবুও তিনি মুগ্ধ চোখে চারপাশে চেয়ে বলে উঠলেন, তপস্যা আর জ্ঞান এই দুয়েরই তো সম্মিলন এখানে। কী সুন্দর নামকরণ!
উৎসবের কর্মসূচিতে আমাদের সারাটা দিন একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। ফলে অরবিন্দ আশ্রমের সব কিছু ঘুরে দেখার বাসনা ধামাচাপা দিয়ে আমরা দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠলাম।
সার্ক সাহিত্য উৎসবের মূল ভেন্যু ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার। সেখানে আমাদের নয়টার মধ্যে পৌঁছানোর কথা। তবে সবাইকে গুছিয়ে নিয়ে আইসিসিতে যেতে যেতে বাজলো দশটা, আর ততক্ষণে হলঘরে অজিত কৌরের বক্তৃতা শুরু হয়ে গিয়েছে। অডিটোরিয়াম পরিপূর্ণ। স্টেজে বসে আছেন সার্ক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং সার্ক পুরস্কার প্রাপ্ত ধীমান পণ্ডিতবর্গ।
এর মধ্যে রয়েছেন ভারতের প্রখ্যাত পণ্ডিত চিন্তাবিদ ড: করণ সিং, বিখ্যাত গীতিকবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা গুলজার, স্বনামধন্য ভারতীয় লেখক কবি ও কূটনীতিক আবিদ হুসেইন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পাকিস্তানী সাংবাদিক হামিদ মীর, আরও রয়েছেন পদ্মভূষণ খেতাবপ্রাপ্ত বিবিসি ব্যুরো চিফ মার্ক টালিÑ যিনি একাত্তরে বিবিসি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ খবর প্রচার করে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে জোরালো ভূমিকা পালন করেছিলেন। এঁরই সঙ্গে প্রেসিডিয়াম সদস্যবৃন্দের সারিতে সেলিনা হোসেনকে দেখে মন আনন্দে ভরে উঠলো। পরবর্তী দুদিনে সৈয়দ শামসুল হক, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুবা নাসরিন, কবি কাজী রোজী ও কথাসাহিত্যিক পাপড়ি রহমানও বিভিন্ন অধিবেশনে প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে উৎসব মঞ্চে আসীন ছিলেন।
যাই হোক প্রথম অধিবেশনে আমাদের দারুণ উত্তেজনা। একসাথে অনেক কিছু বুঝে শুনে জেনে নিতে চেষ্টা করছি।
দিনটি ছিলো ছাব্বিশে মার্চ। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি পাপড়ি আর নিতুপূর্ণা লাল সবুজের মিশেলে শাপলা দোয়েল আর রবীন্দ্রনাথ আর ডি এল রায়ের গানের বাণীর মোটিফ দেয়া শাড়ি পরেছি। প্রথম দিনে আমাদের মঞ্চে ডাক পড়লে আমাদের স্বাধীনতা দিবস ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী কী বলবো সব ঠিক করে রেখেছি। এমন একটা দিনে সার্ক সাহিত্য উৎসব শুরু হওয়াটা আমাদের সৌভাগ্য বলে মনে করছি।
উৎসব মঞ্চ তখন অজিত কৌরের অনবদ্য ভঙ্গির কথামালায় মুখর।
সত্তরোর্ধ্ব এই বাগ্মী নারী উৎসবের তিনটি দিন বলতে গেলে প্রতিটি অধিবেশনেই তাঁর অসামান্য বাকপটুতা দিয়ে উপস্থিত সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিলেন।
অজিত কৌরের স্বাগত বক্তব্য ও উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতার পর শুরু হলো সার্ক এ্যাওয়ার্ড প্রদান পর্ব। পুরস্কার প্রাপ্তদের তালিকায় আছেন হামিদ মীর। অজিত কৌরের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় অভিষিক্ত হয়ে পুরস্কার গ্রহণ করলেন হামিদ। আমার মনের মধ্যে তখন একটা অন্ধ আবেগ কাজ করছিলো।
ছাব্বিশে মার্চের এই সকালে আমার মনে চলচ্চিত্রের মতো দৃশ্যায়িত হচ্ছিলো মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকা, পাকিস্তানী সেনাদের বর্বরতার ঘটনা।
কিন্তু হামিদ মীরের বক্তব্য কানে যেতেই মন ভিন্নরকম অনুভূতিতে উদ্বেল হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, হামিদ বলছেন ছাব্বিশে মার্চের কথা। বলছেন একাত্তরের যুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের ওপর তাঁর দেশের সেনাবাহিনীর বর্বরতার কথা, বলছেন একজন পাকিস্তানী হয়ে তাঁরও সেই দুঃসহ স্মৃতির ভার বয়ে বেড়াবার কথা। গভীর সমবেদনায় স্পষ্ট কণ্ঠে তিনি বলেন তাঁর অনুভূতির কথা।
হাত জোড় করে তাঁর দেশের পক্ষে বাংলাদেশের মানুষের কাছে একাত্তরের অপরাধের জন্য ক্ষমা চান। মনে হলো আজকের দিনটি শুধুই আমাদের জন্য। শুধুই বাংলাদেশের।
এরই মধ্যে অনেকের সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের শাড়ি যেন বাংলাদেশের পতাকা।
সারাদিনে অনেকেই শুধু শাড়ি দেখে আমাদের সাথে আলাপ করতে এসেছেন। আমাদের মন খুশিতে ভরে ওঠে। আমরা বলি দেখ, এই আমাদের দেশ। এই শাপলা, এই নদী, এই কবিতা এসবের স্বাধীনতার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি। আজ আমাদের সেই স্বাধীনতা দিবস।
প্রথম দিনেই আমাদের সাথে বন্ধুত্ব জমে গেল কাশ্মীরের গীতিকবি বিজয় রাজদান, নেপালের কবি সবিতা গৌতম, সুমন পোরখেল,গীতা ত্রিপাঠি, আসামের কথাসাহিত্যিক, কবি ইমরান হুসেন, কুশল দত্ত, সৌরভ শইকিয়া, মনিকুন্তলা, অন্ধ্রপ্রদেশের কবি রামকৃষ্ণ পেরুগু প্রমুখের সঙ্গে। পরবর্তী তিনদিনে উৎসবে আগত আরো অনেকের সঙ্গেই আমাদের সৌহার্দ্য হয়েছিলো। তবে প্রথম দিনের উচ্ছ্বাস কেটে যাওয়ার পরে মনে হয়েছে সার্কএর মর্মবাণী যতই হোক দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো ও বৈষম্য কমিয়ে চিত্তে ও বিত্তে একটা সমতা সৃষ্টি করা, কিন্তু আইসিসির সম্মেলন মঞ্চে ক্রমেই একটা বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে উঠলো পরবর্তী দুদিনে। সাহিত্যের উৎসবেও কেমন করে যেন ঢুকে পড়লো কুটনৈতিক সর্প। সকলের বোধগম্যতার জন্য পেপার অথবা স্বরচিত লেখা পাঠের জন্য ভাষা ইংরেজি হবে বলে আগেই নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছিলো।
কিন্তু দেখা গেল একসময় মঞ্চ দখল করে নিয়েছে হিন্দি আর উর্দূ। ভারতীয় কবিসাহিত্যিক পণ্ডিতের সাথে অন্যান্য দেশের রেশিওর বৈষম্যও চোখে পড়ার মতো
যাই হোক, তিনদিনের সাহিত্য উৎসবে আমরা যাঁরা বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলাম তাঁরা প্রত্যেকেই সাফল্যের সাথে অংশগ্রহণ করেছি। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন আপন মেধা ও প্রতিভা দিয়ে আগেই জয় করে নিয়েছিলেন সার্ক পুরস্কার। এবারে তিনি তাঁর পেপারে তুলে ধরলেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা। ভবিষ্যতের জনজীবন ও পরিবেশ সংকটের কথা।
সারাদিন একের পর এক অধিবেশন, খাওয়া দাওয়া, বিকেলে স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ আয়োজনে আমন্ত্রিত হয়ে দিল্লীস্থ বাংলাদেশী হাইকমিশনে গিয়ে একটা ভিন্ন আমেজের সন্ধ্যা কাটিয়ে ডিনার শেষে আমরা যখন ঘরে ফিরে আসি তখন অরবিন্দ আশ্রম আবার নিশীথ নিসর্গের নৈঃশব্দ্যে ডুবে যেতে শুরু করেছে। যদিও ঘড়ির কাঁটা তখনও নয়টার ঘর অতিক্রম করেনি। কিন্তু সন্ধ্যে সাড়ে আটটার মধ্যেই আশ্রমের মূল ফটক বন্ধ হয়ে যায়। কোন অবস্থাতেই আশ্রমের ্িনরবচ্ছিন্ন নিয়মতান্ত্রিকতার কোনরকম পরিবর্তন হবে না। ওখানকার সবার মধ্যেই শৃঙ্খলা আর নিয়মানুবর্তিতার প্রতি একটু অতিমাত্রায় প্রীতি কেমন যান্ত্রিক মনে হচ্ছিলো।
পরের দুদিনও আমাদের একই রকম টানা কর্মসূচী ছিলো। তৃতীয় দিনের সেমিনারে সেলিনা হোসেন এবং মাহবুবা নাসরিন চমৎকার পেপার উপস্থাপন করে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করে নিলেন। পাপড়ি রহমান মাসুদুর রহমানও তাঁদের রচনা থেকে পাঠ করলেন একই মঞ্চে। বলতে গেলে উৎসবে আমাদের সবারই সফল অংশগ্রহণ ছিলো, তবুও সার্ক কমিটির কিছু কিছু অব্যবস্থা উৎসবে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সমতা ও ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে সমালোচনার সুযোগ করে দিয়েছিলো।
টানা কর্মসূচির বাধ্যবাধকতার মধ্যেও ইচ্ছার স্বাধীনতা সারাক্ষণ অডিটোরিয়ামের চারদেয়ালের মধ্যে নীরস পেপার বা অনাকর্ষণীয় উপস্থাপনার গল্প কবিতা শোনার জন্য আমাদের আটকে রাখতে পারেনি।
বাইরের প্রাঙ্গণে বা লাউঞ্জে এসে মাঝেমাঝেই নানা দেশের লেখক কবি পণ্ডিত বিজ্ঞজনের সাথে আমরা গল্পগুজবে মেতে উঠেছি। কাশ্মীরী কবি বিজয় রাজদান এবং তার স্বামী ওংকার রাজদান বন্ধুত্বের নিশানা হিসেবে ব্যক্তিগত ক্যামেরায় আমাদের সাথে নানা ভঙ্গির ছবি তুলে নিলেন, আমাদের শাড়ি তাঁর এত পছন্দ হলো, যে কীভাবে এসব জিনিস তাঁদের দেশে আমদানী করা যায় সে সম্পর্কেও চিন্তাভাবনা করতে শুরু করলেন। নিতুপূর্ণার ফটোগ্রাফিতে আগ্রহ আছে শুনে পাকিস্তানের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা,কবি ও নাট্যকার শারমাদ সেবাই নিতুকে স্বপ্রণোদিত হয়ে তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রের সিডি উপহার দিলেন। আসামের এক ঝাঁক তরুণ কবির অন্তরঙ্গ সাহচর্য, বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের ভালোবাসা আমাদের রীতিমতো অভিভূত করে রেখেছিলো। এদের মধ্যে গল্পকার ইমরান হোসেন, কবি কুশল দত্ত, কবি শৌভিক শইকিয়াÑ এরাও অরবিন্দ আশ্রমের অতিথি হয়েছিলেন।
আশ্রমের বিশ্রামের সময়গুলোতে আমরা কজন ক্ষুদ্র লেখক-কবি হাসি গান আর গল্পে মেতে উঠে যেন প্রাচীন ইতিহাসের এক অবিভক্ত বাংলাকে ডেকে নিয়ে আসতাম। তাঁরা সবাইই দারুণ সুন্দর বাংলা বলেন, পড়তেও পারেন, শুধু লিখতে পারেন না বলে কত দুঃখ!
নিতুকে দেখে কুশল দত্তের আত্মহননকারী ছোট বোনের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় তার বুক চাপা কান্না আর সেলিনা হোসেনকে বিদায় জানাতে গিয়ে অরবিন্দ আশ্রমের দীর্ঘশীর্ষ গাছগুলোর নিঃশব্দে ঝরে পড়া পাতার মতো ইমরানের অশ্রুপাতের স্মৃতিও আমাদের মনে চিরস্থায়ী দাগ কেটে বসে গিয়েছিলো।
আটাশ মার্চ সার্ক উৎসব শেষ হয়ে যাবার পরদিন লাঞ্চের পর আমরা অরবিন্দ আশ্রম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি কুতুব মিনার, বাহাই ধর্ম মন্দির লোটাস টেম্পল ও অন্যান্য দর্শনীয় স্থান দেখতে। পরের দিন রয়েছে আগ্রা যাওয়ার পরিকল্পনা।
ঊনত্রিশ তারিখে দুপুরের খাওয়ার আগের সময়টাতে আমরা যতটুকু পারি অরবিন্দ আশ্রমের শান্ত স্নিগ্ধ নিসর্গের ছায়ায় ঘুরে বেড়াই।
আর পাতার ফাঁক দিয়ে আলোছায়ার কারচুপি আমাদের গায়ের ওপর শ্রী অরবিন্দের জীবন বাণী মুদ্রিত করে দিতে থাকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।