আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধর্মের তত্ত্ব, তথ্য ও ব্যাখ্যার আধিপত্য

লেখার চেয়ে পড়ায় আগ্রহী। ধার্মিক, পরমতসহিষ্ণু। ধর্ম মানব সভ্যতার অপরিহার্য অংশ। একে অস্বীকার করে মানুষের সামগ্রিক ইতিহাস রচনা অসম্ভব। সকল ধর্মেরই মূল উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ-সাধন।

কিন্তু মানুষ তো ভুলের আকর; স্বার্থের গলি-ঘুঁজিতে সে সেঁধিয়ে থাকে নানা সময়ে, কখনো অবচেতনভাবে কখনো সচেতনভাবে। এর থেকে বের হয়ে সদা কল্যাণের পথে পরিচালিত হওয়া খুব কঠিন। পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে মাঝে মাঝে এ জন্য হতাশায় ভুগতে হয়। কিন্তু ধর্মের যে ভারসাম্যপূর্ণ চমৎকার অবস্থান, বিবৃতি ও স্বাধীন নির্দেশনা রয়েছে, তার দিকে তাকালে সকল হতাশা-ই আশায় রূপ নেয়। যেমন ধর্মীয় তত্ত্বের কথায় যদি আসি, দেখতে পাবো হানাফি-শাফিয়ি-মালিকি-হামবলি ভিন্ন ভিন্ন ঘরানা বা মাজহাব হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটি মাজহাবের প্রবর্তক, ঘরানার স্রষ্টা অপর ঘরানা বা মাজহাবের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

তাত্ত্বিক মতবিরোধের কারণে পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্কটি ক্ষতিগ্রস্ত হত না। যেমন ইমাম শাফেয়ি র.-এর অভিমত ছিল নামাজে রাফ-ই-য়াদাইন তথা বিভিন্ন তাকবিরের সময়ে হাত উঠানামা করার পক্ষে। কিন্তু তিনি ইমাম আবু হানিফার কবরের পাশে উপস্থিত হয়ে যে নামাজ আদায় করেন, তাতে এই রাফ-ই-য়াদাইন করেন নি। এর কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, ইমাম আবু হানিফার সম্মানের জন্য তিনি তা করেছেন। বোঝা যাচ্ছে, নিজস্ব যুক্তি ও মতামতের বাইরেও সম্মান প্রদর্শনের একটি অবস্থান আছে।

ভিন্ন মতের যুক্তি মানেই ধর্মবিরোধিতা নয়। তাই তাত্ত্বিকভাবে ভিন্ন মতাবলম্বী হলেই যে অন্যজনের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ করতে হবে, তা কিন্তু নয়। এজন্যই তত্ত্বভিত্তিক যে-ঘরানা ও মাজহাবগুলো আছে, সেগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি না করাই ভাল। বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে এ নিয়ে বাদানুবাদ হতে পারে, প্রয়োজন হলে তীব্র ভাষায়। কিন্তু অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি দেখানো, এ যেন নিজের হীনতাকেই বড় করে তোলা।

সুন্নিদের মাঝে স্বীকৃত চারটি মাজহাবসহ তাত্ত্বিক ঘরানার আরো একাধিক মাজহাব রয়েছে বা ছিল। আশআরিয়া, মাতুরিদিয়া, মুতাজিলা ইত্যাদি মাজহাব বা ঘরানার মাঝে সব-সময়ই পারস্পরিক সুসম্পর্ক বা ন্যূনতম শ্রদ্ধার একটি উদার জমিন ছিল। এমনকি বর্তমানের তীব্র পরস্পর বিরোধী শিয়া-সুন্নিদের নেতাদের মাঝেও তা বজায় ছিল, এখনো মধ্যপ্রাচ্যে তা বহাল আছে। হ্যা, খারেজি-রাফেজিদের গোঁড়ামি ও অতিরঞ্জনের জন্য এর বিপরীত ঘরানার মানুষজন কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। এর পেছনে তাত্ত্বিক অবস্থানের চেয়ে তৎকালীন রেষারেষির তীব্রতা ও চাপাচাপিটা কিন্তু কম ছিল না।

তাই এ বিষয়গুলোকে আমরা এখন, এই দূরবর্তী সময়ে, ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করতে পারি। মূল কথা হল, তাত্ত্বিকভাবে মতদ্বৈধতার জন্য পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি ও কঠোরতা অযৌক্তিক এবং অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য। যে-কোনো ধর্ম বা আদর্শের নানা রকমের তথ্য থাকে। এ তথ্য-সকল ধর্ম বা আদর্শের সম্পদ বা ঐতিহ্য। সকল তথ্য কিন্তু কাল পরম্পরায় সমানভাবে প্রচারের উপযোগিতা রাখে না।

কোনো তথ্যকে সাধারণ জনতার মাঠে খোলা না রেখে সযত্নে বিশেষ মনের মানুষদের মাঝে গচ্ছিত রাখাটাই মঙ্গলজনক। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, রাসুল সা. একবার বলেন, ‘যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই) বলবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। ’ আবু হুরায়রা এমন সুসংবাদ পেয়ে মোটামুটি উত্তেজিত হয়ে বেরিয়ে গেলেন। পথেই দেখা হল পরবর্তীর খলিফা উমর রা. এর সাথে। উমর কুশল বিনিময় করার সঙ্গে সঙ্গে আবু হুরায়রা বলেন যে, ‘যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে, সে জান্নাতে যাবে।

’ হাদিসটা শুনে উমর কিন্তু আবু হুরায়রাকে প্রচারের সুযোগ দেন নি। বরং পাল্টা তাকে একটা ঘুষি মারেন। আবু হুরায়রা উমরের পেছনে পেছনে রাসুলের কাছে এসে এ বিষয়ে নালিশ করেন। রাসুল সা. এ হাদিসের সত্যতা স্বীকার করেন। তখন উমর বলেন, তাহলে তো মানুষ কর্ম-বিমুখ হয়ে যাবে।

রাসুল সা- তখন নীরবতা অবলম্বন করেন। এখানে দুটি বিষয় মনে রাখার মতো। (ক) ইসলামে অনেক কিছুই সহজ এবং সরল। আমাদের মোল্লা-মাওলানারা যে-ভাবে কথায় কথায় আমাদের জাহান্নামে পাঠিযে দেন, ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। (খ) ধর্মের সকল জিনিশ সব-সময় প্রচারের অবকাশ রাখে না।

তাই যদি না হত, তাহলে রাসুল সা. কিন্তু উমরকে তিরস্কার করতেন এই বলে যে, যেখানে আমি বলেছি, সেখানে তোমাকে এ কথা বলার অধিকার কে দিয়েছে? রাসুল সা. কিন্তু তা বলেন নি। তাই আমাদের যে-সব মাওলানারা তত্ত্বের কারবারি, তারা নিজেদের অভিরুচি অনুসারে সে-কারবারে নিয়োজিত থাকতে পারবেন। কিন্তু এর প্রচারে, বিশেষত অশিক্ষিত, অসচেতন, অন্ধ জনতার মাঝে তা প্রচারে এবং আলোচনা করার ব্যাপারে অবশ্যই হিতাহিত বিবেচনা করতে হবে। তত্ত্বের কারবারিরা সেখানে নিয়োজিত থাকবেন, সে কিন্তু ভাল কথা। ধর্মবিষয়ক চর্চার মতো মজার কোনো বিষয় তো সত্যিই হয় না।

তথ্যের কারবারি যারা, তাদেরও একই রকম অবস্থা। কিন্তু ধর্মের তথ্য ও তত্ত্বের সঞ্চয়ে-সংগ্রহে অগ্রাধিকার ও প্রাধান্যবোধের একটি মাপকাঠি থাকতে পারে। যেমন এ ভারত উপমহাদেশে বাহ্যিক পোশাক-আশাকের গুরুত্ব অপরিসীম। কেউ যদি ধর্মীয় লেবাস ধারন করেও সুদ-ঘুষের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে আমাদের মোল্লা-মাওলানারা একে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন। তখন বলেন, বাহ্যিকতা আল্লাহ পাল্টে দিয়েছে, অভ্যন্তরও পাল্টে দেবেন।

এসব পোশাকধারী লোকের সঙ্গে তাদের আচরণ হয় আন্তরিক। বিপরীতে নামাজি ব্যক্তি যদি দাড়ি না রাখে, তাতে তারা ভীষণ সমালোচনামুখর হন। সুদঘুষমুক্ত দাড়িহীন ব্যক্তির চেয়ে তাদের কাছে সুদখোর ঘুষখোর দাড়িওয়ালার মূল্য অনেক বেশি বেশি, অন্তত তাদের আচরণ ও ব্যবহার তাই বলে। কিন্তু প্রশ্ন হল, দাড়ির রাখাল মূল্য বেশি, না সুদ-ঘুষমুক্তির বিষয়টির গুরুত্ব বেশি? এখানে হাসান বাসরি রা. এর একটি ঘটনার উদধৃতি দেওয়া যেতে পারে। তাকে ইরাকের এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলো, ‘মশার রক্ত পবিত্র না অ-পবিত্র?’ তিনি প্রশ্নকর্তার অবস্থান সম্পর্কে জানতেন।

তখন একেবারে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি উত্তর দেন, মানুষের রক্ত নিয়ে যখন খেলা করো, তখন তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগে না? অর্থাৎ তিনি এখানে ইঙ্গিত করছেন যে, তোমরা হুসাইন রা. এর রক্ত নিয়ে খেলার করার সময় এর বৈধতা নিয়ে তো কোনো প্রশ্ন জাগে নি। এখন এই ছোট্ট বিষয় নিয়ে এত আগ্রহ কেন? এ তো গেল একদিক। অন্যদিকে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাসয়ালা-মাসায়েলের এত ছড়াছড়ি যে, পড়তে গেলে খেই হারানো ছাড়া গতি থাকে না। যেমন ঘুমানোর সময় ডান কাঁধে শুয়ে ওপরের বাম হাতটা পাছার ওপর থাকবে না মাথার উপর- এ নিয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচ হচ্ছে। আর যুক্তির কি বাহার! মানুষ মুরগি খায়, আর মুরগি মল খায়, সুতরাং মানুষ মল খায়- এই হল অবস্থা! এখানে পাল্টা প্রশ্ন করতে গেলে যে গুঁতো খেতে হয়, তা অরুচিকর।

তখন জোর গলায় এবং কুরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যার মিশেল দিয়ে বলা হয়, যিনি প্রশ্ন করছেন, তিনি ধর্মের ধ-টাও জানেন কি-না? অর্থাৎ ধর্মীয় ব্যাখ্যার সকল স্বত্তাধিকারী, মালিক ও হর্তাকর্তা একমাত্র তারাই! অন্য কেউ নন। আর কত রকম ব্যাখ্যা রে বাবা! ঠিক আছে, ব্যাখ্যার বৈচিত্র্যও উদারতার উপাদান। ব্যাখ্যা-বৈচিত্র্যের কারণে ধর্ম বা আদর্শের পরিসর অনেক বেড়ে যায়। এর শক্তিও তখন বেড়ে যায়। কিন্তু আমাদের সমাজে বা প্রতিটি ধর্মেই নিজ ব্যাখ্যাকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার একটি প্রবণতা আছে।

তখন ধর্মের উদার পরিসরটা স্বার্থান্ধ কিছু মানুষের কারণে সংকীর্ণ হয়ে ওঠে। এর জেরেই কিন্তু ইমাম আহমদ বিন হামবলসহ একাধিক ইমাম ও আলেমকে দুঃসহ দুর্ভোগের সেতু পার হতে হয়েছে। ধর্মের মূল বাণীটা ঐশ্বরিক। এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন চলে না, চলবে না। কিন্তু এর ব্যাখ্যা ঐশ্বরিক নয়, অবশ্যই তা মানব-সংযোজিত।

ঐশ্বরিক আদেশের যে প্রভাব থাকবে, যে মূল্যায়ন ও অবস্থান থাকবে, মানব-ব্যাখ্যার কিন্তু সে-প্রভাব, মূল্যায়ন ও অবস্থান থাকার কথা নয়। অথচ প্রতিটি ধর্মের, প্রতিটি ঘরানার ব্যাখ্যাকাররাই নিজেদের ব্যাখ্যাকে জোরপূর্বক সমাজে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং করেছেনও, যা অযৌক্তিক এবং নিন্দনীয়। তাই তত্ত্ব ও তথ্যের আলোচনায় এবং অনুসন্ধানের বেলায় যেমন আমাদের সতর্ক হতে হবে, তেমনই ব্যাখ্যার আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতাও ত্যাগ করতে হবে। কারণ বর্তমান সমাজে এগুলোই আন্তঃধর্ম বিভাজন ও ভুল বোঝাবুঝির জন্য সব চেয়ে বেশি দায়ী। শিয়া-সুন্নি, সালাফি-খালাফি, মাজহাবি-লামাজহাবি, রাজারবাগী-প্রজারবাগী, সায়েদাবাদী-ফায়েদাবাদী, চরমোনাই-দেওয়ানবাগী, মওদুদি-দেওবন্দি, ওহাবি-রেজভী-ভাণ্ডারি ইত্যাদি ব্যাপারে ওপরের সূত্রগুলো সামনে রাখলে সহজেই বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হবে বলে মনে হয়।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে হেদায়েত দান করুন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.