আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্রিকেট নিয়ে উৎকণ্ঠা দেশজুড়ে

ক্রিকেট নিয়ে সারা দেশে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটছে না। বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট খেলবে নাকি দ্বিতীয় স্তরের 'কন্টিনেন্টাল কাপ' খেলেই ক্রিকেট বিশ্বের 'টাইগার' খ্যাত দলটি লেজ গুটিয়ে থাকবে সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কালই। আগামীকাল মঙ্গলবার ও পরশু বুধবার দুবাইয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল আইসিসির সদর দফতরের ভোটাভুটিতে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও ভারপ্রাপ্ত সিইও নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সুজন এখন দুবাইয়ে। সেখানে আছেন বিসিবির সাবেক সভাপতি ও আইসিসির সহসভাপতি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও।

তাদের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের আগামী দিনের ক্রিকেটের ভাগ্য।

এদিকে দেশের কোটি মানুষের উদ্দাম আনন্দের ক্রিকেট বাঁচাতে ক্ষুব্ধ ক্রীড়ামোদীরা মাঠে নেমেছেন। শুক্রবার হাজার হাজার ক্রিকেটপ্রেমী শাহবাগে জড়ো হয়ে ক্রিকেট ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ জানান। তারা দ্বি-স্তরবিশিষ্ট ক্রিকেটের প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে বিসিবির প্রতি আহ্বান জানান। শুক্রবারের পর গতকালও শাহবাগে সমাবেশ করেছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা।

শাহবাগের পাশাপাশি প্রতিবাদে উত্তাল এখন সারা দেশ। বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট খেলতে পারবে না-এটাই মানতে পারছে না পুরো দেশ। ক্রিকেটপ্রেমীরা তাই নেমে এসেছে রাস্তায়। তারা মানববন্ধন করছেন। কুশপুত্তলিকা পোড়াচ্ছেন।

তাদের একটাই দাবি, আগের মতো ধারাবাহিক টেস্ট খেলা। ২৩ জানুয়ারির সভায় বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের অধিকাংশ সদস্যই প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিলেন। দেশবাসীর আন্দোলনের ফলে এখন অবস্থান পাল্টে বিবৃতি দিয়েছে, দেশের বিপক্ষে যায় এমন অবস্থার বিরোধিতা করবে বাংলাদেশ। তবে বিসিবির সত্যিকারের অবস্থান এখনো পরিষ্কার নয়। কাল ও পরশু দুবাইয়ে আইসিসির সভায় দ্বি-স্তরবিশিষ্ট টেস্ট চালু হবে, না আগের মতোই চলবে ক্রিকেট বিশ্ব, সেটা পরিষ্কার হবে।

আর সেটা জানতে দেশের ১৬ কোটি ক্রিকেটপ্রেমীকে অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও দুই দিন। অবশ্য বিসিবির সাবেক সভাপতি ও আইসিসির সহসভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামাল ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্রস্তাবটি পাস না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

সংকটের শুরু যেভাবে : গত ৯ জানুয়ারি দুবাইয়ে আইসিসির এক বিশেষ সভায় 'পজিশন পেপার' নামে একটি খসড়া প্রস্তাব ধরিয়ে দেওয়া হয় আইসিসির অন্য সব সদস্য দেশের হাতে। তার পরও বিষয়টি খুব একটা চাউড় হয়নি। সম্প্রতি একটি ওয়েবসাইট এটি ফাঁস করে দেওয়ার পরই ক্রিকেট বিশ্বে শুরু হয় তোলপাড়।

ওই 'পজিশন পেপারের' প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, আইসিসিতে ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া- এ তিন দেশের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। প্রস্তাবের শুরুতেই আছে, আইসিসির পূর্ণ সদস্য দেশগুলোর সমঅধিকার ক্ষুণ্ন করে 'এঙ্কো' নামে নতুন একটি কমিটি গঠন করা। এর স্থায়ী সদস্য থাকবে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ড। কমিটিতে বাকি সাতটি পূর্ণ সদস্য দেশের প্রতিনিধি হিসেবে থাকবেন শুধু একজন। আইসিসির বাকি সব কমিটির ওপর এটি কর্তৃত্ব করবে।

এটিই হবে বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। প্রস্তাবটি সম্পর্কে উলি্লখিত তিন দেশের বোর্ডপ্রধান ছাড়া বাকি ছয় সদস্যের কেউই কিছু জানতেন না।

টাকার ভাগাভাগি নিজেদের আয়ত্তে রাখতেই এমন প্রস্তাব আনা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এত দিন আইসিসির বড় টুর্নামেন্টগুলো থেকে আয়ের অঙ্কের ভাগ টেস্ট খেলুড়ে সব দেশের জন্যই ছিল সমান। 'পজিশন পেপার' উপস্থাপনকারী ওই তিন দেশের দাবি, এ আয়ের সিংহভাগেরই জোগান তারা দেয় বলে তাদেরই বেশি ভাগ দিতে হবে।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এ দাবির সামনের সারিতে। কারণ তাদের দাবি, আইসিসির রাজস্বের ৮০ শতাংশই আসে ভারত থেকে। তাহলে কেন তারা বেশি পাবে না? শুধু বেশি দাবি করেই ক্ষান্ত হয়নি ভারতীয় বোর্ড। ওয়ার্কিং কমিটির সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তকে হুমকির আকারে জানিয়েও দিয়েছে, এ প্রস্তাব গৃহীত না হলে আইসিসির টুর্নামেন্টগুলোয় ভারত অংশ নেবে না। প্রস্তাব অনুযায়ী, টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে ৯ ও ১০ নম্বর দল অবনমিত হয়ে আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে চার দিনের ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে খেলবে।

সেটিতে চ্যাম্পিয়ন হলে সুযোগ পাবে র্যাঙ্কিংয়ে ৮ নম্বর দলের সঙ্গে প্লে-অফ খেলার। হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে দুটি করে টেস্ট ম্যাচ খেলার পর জয়ী দল টিকে যাবে টেস্ট ক্রিকেটে।

বাংলাদেশের শঙ্কা-আশঙ্কা : গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে এগোতে থাকা বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন ত্রিদেশীয় কৌশলের কাছে জিম্মি হতে যাচ্ছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) প্রকাশ্য কিছুই বলছে না। এর কারণ, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে বাংলাদেশে এশিয়া কাপ ও টি-২০ ক্রিকেটের আসর বসবে।

বাংলাদেশের নিরাপত্তার অজুহাত দিয়ে পাকিস্তান বোর্ড যখন বাংলাদেশে আসতে অস্বীকৃতি জানায়, তখন ভারত বিসিবির পাশে দাঁড়ায়। বিসিবির আশঙ্কা, প্রস্তাবের বিরোধিতা করলে ভারত যদি এশিয়া কাপ ও টি-২০ খেলতে বাংলাদেশে না আসে। গত ২৩ জানুয়ারির সভায় বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের অধিকাংশ সদস্যই প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিলেন। দেশবাসীর আন্দোলনের ফলে এখন বিসিবি বিবৃতি দিয়েছে, দেশের বিপক্ষে যায় এমন অবস্থার বিরোধিতা করবে বাংলাদেশ। দুবাইয়ে অবস্থানরত বিসিবি সভাপতিকেও জানানো হয়েছে, দেশের ভেতরে এ নিয়ে ক্ষোভ উৎকণ্ঠার কথা।

ক্রিকেট নেতারা যা বললেন : এদিকে দ্বি-স্তর ক্রিকেটের ব্যাপারে ক্রিকেট নেতাদের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। দ্বি-স্তর ক্রিকেটের পক্ষে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড অবস্থান নিলেও বিপক্ষে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও বিরোধিতা করবে বলে জানা গেছে। দুবাইয়ে আগামীকাল আইসিসির সভায় যোগ দিতে গেছেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও ভারপ্রাপ্ত সিইও নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সুজন। বিসিবির সাবেক সভাপতি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও আছেন দুবাইয়ে।

তিনি বর্তমানে আইসিসির সহসভাপতি। দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথাও জানেন তিনি। দুবাই থেকে আইসিসির সহসভাপতি মুস্তফা কামাল গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রস্তাবটি আগে আইসিসির সভায় আলোচিত হতে হবে। এরপর পাস-ফেলের বিষয় আসবে। আমি মনে করি, এ সভায় প্রস্তাবটি পাস হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে পুরো দেশ শঙ্কিত। বিসিবির উচিত ছিল, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানানো। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে জানালে আমরা একটি ভালো সিদ্ধান্তে আসতে পারতাম। বিসিবির সাবেক সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, এটা দেশের মানসম্মান ও স্বার্থের বিষয়। তিনি বলেন, এমন ক্রান্তিকালে একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বিসিবি।

এ প্রস্তাব পাস হলে আগামী আট বছরে কোনো টেস্ট খেলতে পারবে না বাংলাদেশ। এমনটা হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের ক্রিকেট। প্রস্তাবটির বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হয়নি বিসিবির।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমও শেষ পর্যন্ত মুখ খুলেছেন। মুশফিক বলেন, দ্বি-স্তরের ক্রিকেট হলে তা আমাদের জন্য হবে হতাশার।

খুব খারাপ লাগবে। যদিও বিষয়টি আমাদের হাতে নেই। টাইগার অধিনায়ক বলেন, বিষয়টি নিয়ে অন্য দেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে আলোচনা করিনি। তবে সহসাই আলোচনা করব। আমি আশা করব, এ বিষয়ে যিনি আইসিসিতে প্রতিনিধিত্ব করবেন, তিনি দেশের কথা ভাববেন।

'পজিশন পেপার' পাস রোধ করতে মান্নার আহ্বান : নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না আইসিসিতে উত্থাপিত তিন দেশের 'পজিশন পেপার' নামের প্রস্তাবনা পাস রোধ করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। গতকাল দেওয়া এক বিবৃতিতে মাহমুদুর রহমান মান্না এ প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, এ প্রস্তাব পূর্ণ সদস্য দেশগুলোর সমঅধিকার ক্ষুণ্ন করে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থায় তিনটি দেশের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং অর্থপ্রাপ্তির উৎকট উৎসব ছাড়া কিছু নয়। এ বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা সামগ্রিক ক্রীড়াঙ্গনকে কলুষিত ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের মূল্যবোধে চরমভাবে আঘাত হানবে।

শাহবাগ আন্দোলন চলবে : বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বন্ধ এবং এর বিরুদ্ধে বিসিবির শক্ত অবস্থানের দাবিতে গতকালও উত্তাল ছিল শাহবাগ। ক্রিকেটের তিন আগ্রাসী দেশ ভারত, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে স্লোগানমুখর ছিল পুরো এলাকা।

রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ব্যানার, ফেস্টুন, পতাকা নিয়ে মানববন্ধন এবং সন্ধ্যায় মশাল মিছিল করেছে ক্রিকেটপ্রেমী সর্বস্তরের মানুষ। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা ৫ দফা দাবি তুলে ধরেন এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। আজ বিকাল ৪টায় শাহবাগে মানববন্ধন এবং বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে বলেও জানানো হয়। দাবির মধ্যে রয়েছে-খসড়া প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিসিবির শক্ত অবস্থান, আগামীকাল ও পরশু দুবাইয়ে আইসিসির সভায় বিসিবির অবস্থান কী হবে তা জনগণের সামনে তুলে ধরা, ক্রিকেট নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করা, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীর হস্তক্ষেপ। গতকাল বিকালে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়।

এতে বিভিন্ন ছাত্র-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন অংশ নেয়। এ ছাড়া খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে যোগ দেন তরুণরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে যোগ দেন। ক্রিকেটের 'তিন জমিদারের' বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করার প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জানান বিক্ষোভকারীরা। তারা 'এক দাবি এক দেশ, টেস্ট খেলবে বাংলাদেশ', 'তিন দেশের মাতব্বরি থেকে ক্রিকেটকে রক্ষা কর', 'ক্রিকেট প্রাণের দাবি, ক্রিকেট নিয়ে ষড়যন্ত্র চলবে না', 'তিন শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেব না', 'বিসিবি সে নো টু আইসিসি' নানা স্লোগান দেন।

সন্ধ্যায় বের করা হয় মশাল মিছিল। মিছিলটি শাহবাগ থেকে শুরু হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ঘুরে পুনরায় শাহবাগে এসে শেষ হয়।

 

 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.