এর দক্ষিণে আটলান্টিসের রাজারা গড়ে তুলেছিলেন অনুপম এক শহর। তার নামও আটলান্টিস। একের পর এক সাজানো জলপথ আর স্থলপথ দিয়ে ঘেরা ছিল এই শহর। আর এই নগরের প্রধান আকর্ষণ ছিল রাজপ্রাসাদটি। ছোট্ট একটি টিলার উপর গড়ে তোলা হয়েছিল এই সুরম্য প্রাসাদ।
প্রাসাদ ঘিরে ছিল তিনটি খাল। প্রাসাদ চত্বরের একেবারে কেন্দ্রে ছিল একটি মন্দির।
এই মন্দিরে নিয়মিত বসতেন আটলান্টিসের মহাক্ষমতাধর রাজা এ্যাটলাস আর তার নয় ভাই । পাঁচ-ছয় বছর পর পর তারা আসতেন এখানে। তাদের গায়ে থাকতো কালো রংয়ের পবিত্র পোশাক।
প্রথমে দেবতাদের উদ্দেশ্যে বুনো ষাঁড় বলি দিতেন তারা। দেবতাদের তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতেন ষাঁড়ের রক্ত। আর তারপর শুরু হত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় আলোচনা। সবশেষে আলোচনার সারসংক্ষেপ লিখে নেওয়া হত সোনার ফলকে আর তা সংরক্ষণ করা হত পরের বৈঠকের জন্য।
এই রাজাদের সুশাসনে দীর্ঘদিন সুখে-শান্তিতে বসবাস করে আটলান্টিসবাসী।
আর তারপর একদিন হঠাৎ ধ্বংস হয়ে যায় আটলান্টিস। আকস্মিক দুর্বিপাকে নিমেষে গায়েব হয়ে যায় আটলান্টিসের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ। শক্তিশালী ভূমিকম্প দু-টুকরো করে দেয় আটলান্টিসকে। পাহাড় সমান ঢেউ এসে ভাসিয়ে দেয় আটলান্টিসের নগরগুলোকে। ভেসে যায় ক্ষেত-খামার আর বন-বনানী।
সবার শেষে যে ভূমিকম্পটি হয়েছিল, সেটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। আর সেই ভূমিকম্প মহাদেশটিকে ডুবিয়ে দেয় সাগরতলে। মাত্র একদিন একরাতের মধ্যে গোটা মহাদেশ বিলীন হয়ে যায় সাগরের গভীরে।
কিংবদন্তীর এই বিশাল দ্বীপ আটলান্টিক মহাসাগরে তলিয়ে যাওয়ার পর আর দেখা যায়নি কোনো দিন। এরও প্রায় নয় হাজার বছর পর প্রথমবারের মতো আটলান্টিসের গল্প বলেন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো।
তখন এসব খটমট বই খটমট ভাষায় লেখা হত না; নাটকের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলাই রীতি ছিল। এই নাটকগুলোকে বলা হত ‘ডায়ালগ’। প্লেটোর প্রথম ডায়ালগটির নাম ‘রিপাবলিক’। পরবর্তীতে তিনি আরও দুটি ডায়ালগ রচনা করেন— কাক ‘টিমিউস’ এবং ‘ক্রিটিয়াস’। এ দুটি ডায়ালগেই তিনি বিশদভাবে বর্ণনা দেন আটলান্টিসের।
তবে ক্রিটিয়াসের বর্ণনায়ই আটলান্টিসের ছবি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। সেই বর্ণনা অনেকটা এরকম।
সে একদম সৃষ্টির শুরুর দিকের কথা। দেবতারা তখন পৃথিবী ভাগাভাগি করে নিচ্ছিলেন। এসময় সাগরদেবতা পসাইডন ভাবলেন, তিনি নেবেন বিশাল এক মহাদেশ আর তার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কতগুলো দ্বীপ।
যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। তার ছিল পাঁচ জোড়া যমজ সন্তান। প্রথম সন্তানের নাম রাখেন এ্যাটলাস। এই বিশাল ভূ-খণ্ডের নামও রাখলেন এই এ্যাটলাসের নামেই— আটলান্টিস। রাজা পসাইডন আটলান্টিসকে মোট দশ ভাগে ভাগ করলেন।
সবচেয়ে বড় আর ভালো অংশটির প্রধান বানালেন এ্যাটলাসকে।
কেবল প্লেটোই যে এই হারিয়ে যাওয়া আটলান্টিসের বর্ণনা দিয়েছেন, তা কিন্তু নয়। পরে আরও অনেকেই এর উল্লেখ করেছেন। যেমন মাদাম বাভাৎস্কি। রাশিয়ান এই মহিলা ছিলেন অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী।
তিনি আটলান্টিস নিয়ে আস্ত একটি বই-ই লিখেছেন— ‘দ্য সিক্রেট ডকট্রিন’।
দুই খণ্ডের বইটিতে লেখক প্রাচীন আটলান্টিসকে উল্লেখ করেন হারিয়ে যাওয়া লেমুরীয় সভ্যতার উত্তরসুরী হিসেবে। মাদাম বাভাৎস্কি ও তার অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টির শুরুতে সাতটি মূল জাতি ছিল। আর লেমুরীয়রা তাদের মধ্যে তৃতীয়। দক্ষিণ গোলার্ধ জুড়ে ছিল তাদের মহাদেশ।
কথাও বলতে পারত না তারা। তবে তাদের চোখ ছিল তিনটি। তাদের এই তিন নম্বর চোখের এক বিশেষ ক্ষমতা ছিল। সেই ক্ষমতার মাধ্যমেই তারা যোগাযোগ করত একে অপরের সঙ্গে। বাভাৎস্কির মতে, আটলান্টিসবাসীরা এই লেমুরীয়দেরই বংশধর, চতুর্থ মূল জাতি।
লাখ লাখ বছর আগে ডুবে যায় লেমুরীয়দের মহাদেশ। উত্তর আটলান্টিকে কেবল জেগে ছিল সামান্য একটু অংশ। পরবর্তীতে সেখানেই গড়ে ওঠে আটলান্টিস সভ্যতা। একদিন ডুবে যায় সেটিও।
অস্ট্রিয়ার দার্শনিক রুডলফ স্টাইনারও বলে গেছেন আটলান্টিসের কথা।
তিনি গবেষণা করে দেখান, আটলান্টিসবাসীরা উড়তেও শিখেছিল। তবে ওদের আকাশযানগুলো এখনকার পৃথিবীতে ওড়ার উপযোগী নয় মোটেও। কারণ, তখনকার দিনে বাতাস ছিল অনেক ঘন আর ভারি।
আটলান্টিসকে নিয়ে লিখেছেন উইলিয়াম স্কট-এলিয়ট-ও। আর তার বর্ণনা প্লেটোর চেয়েও নিখুঁত।
দিব্যজ্ঞান পেয়েছিলেন তিনি। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তার বই ‘দ্য স্টোরি অফ আটলান্টিস’। ওই বইয়ের তিনি লিখেছেন, আটলান্টিস শাসন করত এক শ্রেণীর অভিজাত মানুষ। তাদের সমাজ ছিল সর্বগ্রাসী, সর্বনাশা। সব কিছুকেই নিজেদের আয়ত্তে নিতে চাইত তারা।
প্রযুক্তির দিক থেকেও উৎকর্ষতা লাভ করেছিল আটলান্টিয়ানরা। ঘণ্টায় একশ মাইল গতিতে চলতে পারে এমন উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেছিল তারা। আর সেই উড়োজাহাজ চালান হত ‘ভ্রিল’ নামের এক ঘরনের জ্বালানি দিয়ে। যার সঙ্গে মিল আছে আজকের জেট ফুয়েলের।
পরে ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয় তার আরেক বই ‘দ্য লস্ট লেমুরিয়া’।
১৯২৫ সালে দুইটি বই একত্র করে প্রকাশ করা হয় ‘দ্য স্টোরি অফ আটলান্টিস এন্ড দ্য লস্ট লেমুরিয়া’ নামে।
এরপর গড়িয়ে যায় বেশ কিছুদিন। এরপর আবার আটলান্টিস নিয়ে কথা বলেন ড. জার্মেন স্প্যানুথ। তিনি ১৯৫৩ সালে জানান, প্লেটো মাদাম বাভাৎস্কি আর স্কট-এলিয়ট যে আটলান্টিসের কথা বলেছেন, তা সত্যিই আছে। তিনি ইউরোপের মূল ভূখণ্ড এবং ব্রিটেনের মাঝামাঝি উত্তর সাগরে অভিযান চালান।
আশানুরূপ সাফল্যও পান। তাঁর অনুসন্ধানী দলের এক ডুবুরি সাগরতলের ত্রিশ ফুট নিচে বিস্ময়কর এক দেয়াল খুঁজে পায়। দেয়ালটি ১,০১২ গজ বৃত্তাকার সীমানা ঘিরে রয়েছে। প্রায় দশটা ফুটবল মাঠের সমান। আড়াআড়ি ৩২৮ গজ।
সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে ডুবুরিরা পরে আরও কিছু জিনিস নিয়ে আসে। এক ডুবুরি নিয়ে আসে চকমকি পাথর। ড. স্প্যানুথের ধারণা, এগুলো সবই আটলান্টিসের কোনো রাজপথের ভগ্নাংশ। আর চকমকি পাথরটি সম্ভবত ব্যবহৃত হত হাতিয়ার হিসেবে।
এই অভিযানে অবশ্য নিশ্চিত করে প্রমাণ হয় না যে, উত্তর সাগরের এই ধ্বংসাবশেষ আটলান্টিসই।
তবে সম্ভাবনাটুকুও তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তাই না?
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।