আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রেসিডেন্ট গুলের চিঠিটি কি সত্যিই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ কিংবা শিষ্টাচারপরিপন্থী?

অশুভ শক্তির মুখোশ উন্মোচনেই তৃপ্তি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট মি. আব্দুল্লাহ গুল কিছুদিন আগে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের কাছে একটি চিঠি লিখেছেন। সেই চিঠিতে কী ছিল, তা বাংলাদেশ সরকারের তরফে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয় নি। তবে প্রথম আলো এ সম্পর্কে যা লিখেছে, তার মূল অংশ হলো- চিঠিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অন্যদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের বিচার চলছে। প্রায় ৯০ বছর বয়সী এই নেতা মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি বলে শোনা যাচ্ছে। তিনিসহ আরও বেশ কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ ইসলামপন্থী নেতা বিচারের মুখোমুখি রয়েছেন, যা অত্যন্ত উদ্বেগের।

’ তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মতে, যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ার কারণে অর্থাৎ শীর্ষ ইসলামপন্থী নেতাদের শাস্তি দেওয়া হলে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আর্থসামাজিক অগ্রগতি ব্যাহত হতে পারে। এর ফলে সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও রক্তপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ন হতে পারে। গুল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে ‘ক্ষমা প্রদর্শন’ নীতি অনুসরণের অনুরোধ জানিয়েছেন। গোলাম আযমসহ অন্য নেতাদের মৃত্যুদণ্ড রোধ করার বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।

প্রথম আলো আব্দুল্লাহ গুলের এই চিঠিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’ বলছে। এই চিঠি কি সত্যিই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো রকম অযাচিত এবং অবৈধ হস্তক্ষেপ? সেটাই পরীক্ষা করে দেখা যাক। অনুরোধ আর হস্তক্ষেপ এক জিনিস নয় লক্ষ্যনীয় যে, প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুলের ওই চিঠিতে কোনো রকম কড়া ভাষা ব্যবহৃত হয় নি। পৃথিবীর পরাশক্তিগুলো তাদের মিত্র রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে যেরকম হঠকারি ও কঠোর শব্দ ব্যবহার করে থাকে, সেই তুলনায় প্রেসিডেন্ট গুলের চিঠির ভাষা ছিল অত্যন্ত শালীন, মার্জিত এবং বন্ধুভাবাপন্ন। চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতার পরিবর্তে বিবেচনার অনুরোধ জানানো হয়েছে চিঠিতে।

প্রথম আলো খবরটির শিরোনাম করেছে ‘গোলাম আযমদের ফাঁসি না দিতে তুরস্কের আবদার’। আবদার শব্দটি যদিও ব্যাঙ্গাত্মক, কিন্তু তবুও লক্ষ্যণীয় যে, আবদার কখনই চাপ প্রয়োগের পর্যায়ে পড়ে না। প্রথম আলোর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে: গুল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে ‘ক্ষমা প্রদর্শন’ নীতি অনুসরণের অনুরোধ জানিয়েছেন। গোলাম আযমসহ অন্য নেতাদের মৃত্যুদণ্ড রোধ করার বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। সুতরাং কমপক্ষে এতটুকু স্পষ্ট যে, কূটনৈতিক ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তুরস্কের শব্দচয়ন অত্যন্ত সতর্ক ও মার্জিত।

বাংলাদেশের মতো একটি দুর্বল রাজনীতি ও অর্থনীতির রাষ্ট্রকে ইচ্ছে করলেই তারা আরো শক্ত ভাষায় অ্যাড্রেস করতে পারত। কিন্তু তারা সেটা করে নি। প্রতিক্রিয়া দেখানোটা কি শিষ্টাচারের পরিপন্থী? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা আন্তর্জাতিক আইনে জ্ঞান রাখেন, এমন যে কেউই জানবেন যে, রাষ্ট্রগুলো এখন নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভোগ করে না। রাষ্ট্রগুলো স্বাধীন হলেও আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা তাদের সার্বভৌমত্ব এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। জাতিসংঘ সনদের অনুচ্ছেদ-২ দ্বারা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং তাতে হস্তক্ষেপ না করার নিশ্চয়তা যেমন দেয়া হয়েছে, অপরদিকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো কিছু বিষয়কে সংস্থাটির প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে আখ্যা দিয়ে এর লঙ্ঘনের দায়ে যেকোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপেরও সুযোগও রাখা হয়েছে এই সনদে।

আন্তর্জাতিক আইনে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা বর্তমানে 'সার্বভৌমত্ব'কে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছেন- যেখানে নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা ও নিরাপত্তা বিধানে রাষ্ট্রের দায়িত্বকে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এই দায়িত্ব ঠিকমতো পালন না করলে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রটিকে 'ব্যর্থ' হিসেবে আখ্যা দেয়ার হুমকি পর্যন্ত রয়েছে। কোনো দেশ যদি মনে করে যে, তার দেশের বা আদর্শের মিত্র কোনো শক্তি অন্য কোনো দেশে নির্যাতিত হচ্ছে বা ন্যায়বিচার পাচ্ছে না বা ধরুন অপরাধের কারণে বড় রকমের সাজা হয়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে পূর্বোক্ত দেশটি পরবর্তী দেশকে সদয় হবার অনুরোধ করতেই পারে। তুরস্ক তো সেটাই করেছে। দেশটির ক্ষমতাসীন দল একে পার্টি ইসলামি মূল্যাবোধে বিশ্বাসী। তারা যদি জামায়াতকে ইসলামী আদর্শের দল মনে করে এবং সেই দলের বন্দি নেতাদের পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সদয় হবার আহ্বান জানায়, সেটাকে কোনো ভাবেই কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী বলা যায় না।

পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশই তাদের মিত্রদের পক্ষে এধরনের তৎপরতা চালায়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এধরনের ভূরি ভূরি নজির দেখানো সম্ভব। রাষ্ট্রপতির কাছে অনুরোধ রাখার তাৎপর্য এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, প্রেসিডেন্ট গুল তার অনুরোধপত্র পাঠিয়েছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কাছে। এটিকে বিচারকার্যে কোনো রকমের প্রভাব বলা চলে না। কেননা, বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার পর যেকোনো সাজাপ্রাপ্ত আসামীকে ক্ষমা করে দেয়ার অধিকার রাখেন রাষ্ট্রপতি।

আমাদের সংবিধানের ৪৯ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা রয়েছে। সেই সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রয়োগ যেন তিনি করেন, সেজন্যে তাকে অনুরোধ জানানোটা মোটেও অন্যায় কিছু নয়। তুরস্ক যদি বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করত, সেক্ষেত্রে সেটাকে অনৈতিক বলার সুযোগ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, এরকম কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক পদক্ষেপই তুরস্ক গ্রহণ করে নি বা গ্রহণের হুমকিও দেয় নি। যে চিঠিটি দেয়া হয়েছে, সেটি কেবল এক প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে আরেক প্রেসিডেন্টের প্রতি এমন কিছু করার অনুরোধ, যা সংবিধানসম্মত।

বিদেশি হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করেছে সরকার নিজেই একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, বিচারপতি নাসিমের স্কাইপ সংলাপ ফাঁস হওয়ার আগে কোনো দেশের পক্ষ থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে এরকম কোনো বক্তব্য আসে নি। বিচারপতি নাসিমের ফাঁস হওয়া ওই সংলাপে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এতদিন পর্যন্ত এই বিচারকাজ নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের হয় নি। এখানে রাজনৈতিক প্রভাব যে প্রকট ছিল, সেটিও উঠে আসে সেই সংলাপে। সর্বশেষ বিচারপতি নাসিমের পদত্যাগে সেই সংলাপের সত্যতা এবং ট্রাইব্যুনালের বেহাল দশার দিকটা সকলের সামনে উন্মোচিত হয়। ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ প্রশ্নবিদ্ধ হবার পরই তুরস্ক কথা বলার সুযোগ পেয়েছে।

তারা হয়তো এই ট্রাইব্যুানাল নিয়ে সন্দেহে পড়ে গেছে এবং ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হতে পারে এই আশঙ্কা থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে ওই আহ্বান রেখেছে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে সকল দেশ কথা বলার অধিকার রাখে মনে রাখতে হবে, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ। এই অপরাধগুলো পুরো পৃথিবীর সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ বলে মনে করা হয় বলেই এগুলোর নাম ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারকাজ সারা পৃথিবী গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে থাকে আর একারণেই এধরনের বিচারকাজ যদি অস্বচ্ছ ও বিতর্কিত হয়, সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সে ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারে এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সংশ্লিষ্ট দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপও গ্রহণ করতে পারে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ন্যায়বিচারের বিষয়টি এই মুহূর্তে এত বেশি বিতর্কিত হয়ে উঠেছে যে, এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সোচ্চার হওয়া শুরু করেছে মাত্র।

ট্রাইব্যুনাল যদি নিজেদের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে সকলের আস্থা অর্জন করার ব্যাপারে উদ্যোগী না হয়, তাহলে নিকট ভবিষ্যতে আরো বৃহৎ আকারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলো এই বিচারকাজ নিয়ে নানারকম হস্তক্ষেপের সুযোগ পাবে। তুরস্ককে তিরস্কার করার নৈতিক ভিত্তি এই সরকারের নেই দুটি কারণে বর্তমান আওয়ামী সরকার তুরস্কের এই চিঠির বিরোধিতা করার নৈতিক শক্তি হারিয়েছে। প্রথমত, যে সরকার এই ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যের ওপর শুরু থেকে অন্যায় হস্তক্ষেপ করেছে এবং ট্রাইব্যুনালকে রাজনৈতিক দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে (স্কাইপের সংলাপে এর সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ আছে), তাতে সরকারের ওপর কোনো দেশ চাপ প্রয়োগ করলে সেটা এই সরকারের নিজের অর্জন হিসেবেই ধরে নিতে হবে। কারণ, বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তারাই অন্যদের হস্তক্ষেপের রাস্তা তৈরি করেছে। দ্বিতীয়ত, যে সরকার রাজনৈতিক হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিকাশের মতো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীকে ছেড়ে দিয়েছে, অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামের হত্যাকারী ও পেশাদার খুনী বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড কয়েক দফা ক্ষমা করে দিয়েছে (শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে মৃত্যুদণ্ড ক্ষমা করার যে ২৫টি নজির রয়েছে তার ২১টিই আা’লীগের এই মেয়াদে), ১০০’র বেশি লোককে গুম করেছে (আইন ও সালিস কেন্দ্র’র মতে), সেই সরকারের মুখে অন্যের অনুরোধমূলক আহ্বানকে ‘শিষ্টাচারবহির্ভূত’ কিংবা ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ বলাটা মোটেও শোভা পায় না।

‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স’ নামের আন্তর্জাতিক আইনটির ৬ অনুচ্ছেদে গুমকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক (হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল) ও দেশীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর (অধিকার, আসক) মতে, বাংলাদেশে এই সরকারের মেয়াদে ১০০টিরও বেশি গুমের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে রাষ্ট্র জড়িত ছিল। এমনকি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আসামীপক্ষের একজন সাক্ষীকেও গুম করেছে এই সরকার। যে রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেই প্রতিনিয়ত ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে’ লিপ্ত, সে যখন অন্যের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে যায়, তখন সেটা যে কতটা অন্তসারশূন্য সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং, সব মিলিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ এবং বিরোধী মত দমনের জন্যে বাংলাদেশ সরকার যেসব অন্যায়ে জড়িয়ে পড়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরব হবে, এটাই স্বাভাবিকতা।

 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.