কিছুই বলার নেই
এনামুল সাহেব তার পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলে রাতুলকে নিয়ে ছাদে বসে আছেন। সন্ধ্যা ৭-৮ টার দিকে এই কাজটি তিনি নিয়মিতই করে থাকেন। ছাদে বসে রাতুলের মনে জমে থাকা হাজারো প্রশ্নের উত্তর দেন এনামুল সাহেব। প্রশ্ন করার ব্যাপারে রাতুলের যেমন কোনো ক্লান্তি নেই, তেমনি উত্তর দেওয়ার বাপারে এনামুল সাহেবেরও কোনো ক্লান্তি নেই।
'আচ্ছা বাবা, তারাগুলো এত ছো্ট কেন?' আকাশের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে রাতুল প্রশ্নটা করে।
'ওগুলোও আসলে অনেক বড় বাবা। আমাদের এখান থেকে অনেক দূরে তো তাই দেখতে ছো্ট মনে হয়। '
'মা কি ওইখানে থাকে বাবা'?
'হ্যাঁ বাবা, তোমার মা ঐখানে থাকে ।
'এতগুলো বড় তারার মধ্যে মা কি করে বাবা?'
'তোমাকে বসে বসে দেখে । তুমি ভালো ছেলের মতো চলছ কি না, ঠিকঠাক সময় মতো সব কিছু করছো কি না!'
'মা কি বোকা !! এত দূরে না থেকে বাসায় থাকলে তো আরো ভালো করে আমার দিকে খেয়াল রাখতে পারে'. একথা বলেই বাবার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠে রাতুল।
কিছুক্ষণ পর আবার প্রশ্ন করে-
'বাবা মা কি আর ফিরে আসবে না?
'আসবে বাবা, আসবে। '
'কবে আসবে?
'যেদিন দেখবে তুমি খুব ভালো ছেলের মতো চলছো সেদিন ফিরে আসবে। '
এনামুল সাহেব আসলে ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না কি করে তিনি ছেলেকে বোঝাবেন রাতুলের মা রাতুলের জন্মের ১ বছরের মাথায় মারা গেছে।
*****
রাতুলকে স্কুলের সব শিক্ষক খুব আদর করেন । এমন ভালো ছেলে নাকি খুব কম হয় ।
স্কুলে রাতুলের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মোটকা পাপলু । মোটকা পাপলু রাতুলকে জিজ্ঞেস করে,
'কি রে? আন্টি এসেছে?'
'না রে, এখন আসে নি । বাবা বলেছে খুব দ্রুতই চলে আসবে ।
'হুম, আমারো তাই মনে হচ্ছে । '
আম্মু তারার দেশে থাকে - রাতুলের এই কথা স্কুলের কেও বিশ্বাস করে না।
তার সব সহপাঠিরা বলে রাতুলের মা মারা গেছে। রাতুলের তখন অনেক রাগ হয় । খালি এই মোটকা পাপলুটা রাতুলের কথা বিশ্বাস করে। তাই নাদান টাইপের এই ছেলেটাকে রাতুলের অনেক ভালো লাগে। স্কুল ছুটি হতেই মোটকা পাপলুর মা চলে আসেন পাপলুকে নিতে।
রাতুল তখন চেয়ে থাকে । পাপলুর মা আদুরে গলায় পাপলুর সাথে কথা বলেন । গালে চুমু দেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দেন। রাতুল উদাসীনভাবে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
তার ছোট্ট বুকের কোথাও যেন এক গভীর শুন্যতা এসে গ্রাস করে নেয় সব কিছু।
*****
রাতুল মার ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আম্মুর চেহারা কি সুন্দর। চোখ্গুলোতে কেমন যেন একটা দুষ্টু দুষ্টু ভাব। আম্মু নিশ্চয় অনেক দুষ্টু।
খালি কাতুকুতু দেয়। তারার দেশ থেকে ফিরে এসেই নিশ্চয় আমাকে খালি কাতুকুতু দেবে। ব্যাপারটা চিন্তা করতেই রাতুল হাসতে থাকে। হঠাৎ বাবার ডাক শুনে। 'রাতুল বাবা, খেতে আসো।
' 'আসছি বাবা'। রাতুল কথাটা বলে মায়ের ছবিটা তার বিছানার বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখে।
খাবার টেবিলে খেতে খেতে বাবার সাথে রাজ্যের গল্প জুড়ে দেয় রাতুল। স্কুলে কি হয়েছে সব কিছুই খুলে বলে। এনামুলও অসীম ধৈর্যের সাথে ছেলের কথা শুনতে থাকেন।
'জানো বাবা আজকেও চিকনা রিয়াদ বলেছে আমার আম্মু নাকি মারা গেছে। আর ফিরে আসবে না।
'রিয়াদ ছেলেটা অনেক পাজি না?'
'হ্যাঁ বাবা,ক্লাসে খালি দুষ্টুমি করে। '
'হুম, এই ধরনের কথা তো পাজি ছেলেরাই বলবে। তুমি এইসব শুনবে না,কেমন?
'আচ্ছা বাবা।
' সজোড়ে মাথা নাড়ায় রাতুল।
*****
আজ রাতুল একটা ব্যাপার জেনে গেছে! টিভিতে সে দেখেছে তারার মধ্যে কোনো মানুষ থাকে না। আরো কীসব কঠিন কঠিন কথা বলেছে। সব কথা রাতুলের মাথায় ঢুকে না। রাতুল টিভির সব কথাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে।
তার মানে বাবা আমার সাথে মিথ্যা বলেছে!ক্ষোভে রাতুলের ফর্সা মুখ লাল হয়ে যায়।
'বাবা, তুমি আমাকে মিথ্যা বললে কেন?মা তো তারার দেশে থাকে না। আমি আজ টিভিতে দেখেছি। তারার মধ্যে কোনো মানুষ থাকে না। '
'ইয়ে।
মানে তোমার মা আগে থাকত, এখন মনে হয় অন্য কোথাও চলে গেছে। '
'কোথায় গেছে এখন?'
'মনে হয় চাঁদে চলে এসেছে। আমার তাই মনে হয়।
'চাঁদ তো আরো কাছে . তুমি আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো'. বলেই নিষ্ফল আক্রোশে বাবার দিকে এলোপাতাড়িভাবে হাত পা ছুঁড়তে থাকে। হঠাৎ রাতুল খেয়াল করে বাবা র চোখ্ দিয়ে পানি পড়ছে।
বাবা কি কাঁদছে? সে মারায় বাবা কি ব্যথা পেয়েছে? ব্যপারটা চিন্তা করতেই রাতুলের মুখ অপরাধীর মতো হয়ে যায়। বাবা তাকে কতো আদর করে। সেই বাবাকে সে এইভাবে জোরে জোরে মেরে কষ্ট দিলো। 'বাবা, আমাকে মাফ করে দাও। আমি আর কখনো তোমার সাথে এই রকম করব না' লজ্জিত কণ্ঠে মাথা নীচু করে কথাটা বলে রাতুল।
ছোট্ট রাতুল তো বোঝে না বাবা কেন কাঁদে। বাবা কাঁদে তাকে মার কাছে নিয়ে না যেতে পারার ব্যর্থতায়!!
এনামুল সাহেব বললেন-
'বাবা তোমাকে একটা কথা বলি?'
'বলো বাবা। '
তুমি আর কখনো তোমার আম্মু কোথায় আছে এই কথা আমাকে জিজ্ঞেস করবে না।
'কেন বাবা?'
'আম্মু কোথায় আছে জিজ্ঞেস করলে তোমার আম্মু কষ্ট পায় আর কষ্ট পেলে তোমার আম্মু আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। তুমি কি সেটা চাও?'
'না বাবা,কখনোই না।
আমি আর তোমাকে আম্মু কোথায় আছে এ কথা জিজ্ঞেস করব না।
'তুমি ঠিকমতো ভালোমানুষ হও। সব সময় লক্ষ্মী ছেলের মতো থাকো। তাহলে একসময় তুমি চাঁদে গিয়ে তোমার আম্মুকে নিয়ে আসতে পারবে। '
'আচ্ছা বাবা।
ঠিক আছে। '
এনামুল সাহেব রাতুলকে বুকে চেপে ধরে কাঁদতে থাকেন। রাতুল এই কান্নার মানে বোঝে না। তবে সেদিনের পর থেকে রাতুল আর কখনো মা কোথায় আছে এই কথা বাবাকে জিজ্ঞেস করে নি পাছে মা যদি আর ফিরে না আসে!
পরিশিষ্টঃ
আজ দেশে ফিরছে রাতুল। সাথে তার স্ত্রী আর এক বছরের বাচ্চাটা।
বাবাকে সে বিদেশ নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু বাবা রাজি হন নি। তাই সে নিজেই চলে এসেছে। বিদেশ ফিরে যাবে না। সব সময় বাবার কাছেই থাকবে।
'বাহ, নাতনি দেখি তার দাদির মতই হয়েছে। ' এনামুল সাহেবের মুখে এমন কথা শুনে রাতুল গভীর মনযোগ দিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে দেখতে থাকে। এনামুল সাহেব রাতুলের চোখ্ দুটোতে স্পষ্টই একটা শুন্যতা আর বিষাদের ছায়া লক্ষ করলেন। যেই ছায়া মাড়ানো কিংবা দূর করা কারো পক্ষেই সম্ভব হবে না কোনোদিন.......
উৎসর্গ; পৃথিবীর সকল মমতাময়ী মা কে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।