আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প: কবি ও দার্শনিক

মন চাই কৈতর হয়ে উড়ি আমি আসমানে আজ অথবা মাছ হয়ে সাতার কাটি জলের গহীনে।

দার্শনিকের কথা
আমার কথা কাল শোন, নয়তো আর এক দিন। আজ কবির কথা বলি।
ব্রহ্মপুত্রের বুকে বর্ষার কাঁদা ধোয়া জল নেমেছে। কিশোর বয়সে ভাবতাম, ব্রহ্মপ্রত্রে নৌকা ভাসালে মেঘালয়ে যাওয়া যাবে।

যাবে কিনা আজও জানিনা তা। তবে সে পথেই চলেছি। কবি আমার পাশে বসা। দাড়ি, চুলে কামাখ্যার কাপালিকদের মতো অবস্থা হয়েছে। এটা গল্পের শেষের দিকের কথা।

শুরুর কথা বলি।
মফস্বল শহরের উপকন্ঠে কবির বাসা। আভিজাত্যের সিঁড়ি মাড়িয়ে উপড়ে উঠলেই দু তলা উঁচু থেকে আকাশ দেখা যায়। এটা কবির বাসার ছাদ। বেশে কয়েকটা ফুলের টব বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে এখানে সেখানে।

ডানপিটে কবি প্রায়ই এখানে এসে সময় কাটায়। বিশেষ করে মনটা যখন খারাপ থাকে। তখন কবির মনটা কেমন যেন মেঘলা আকাশের মতো থমথমে হয়ে যায়। কবি সবার ছোট। অথচ ভাই-বোনের সাধ্য নেই ওর মুখের উপর কথা বলে।


সকালে রোদের কমতি ছিল না। হঠাৎ করে হেসে ওঠা কোনো রমনীর মতোই রমনীয় ছিল সে রোদ। এখন আষাঢ় মাস। অতএব আকাশের চরিত্র বোঝা সহজ নয়। মাঝারি তালে বৃষ্টি নেমে পড়ল।

রেলিং ঘেরা বারন্দায় চেয়ার পাতা ছিল। কবি বিষন্ন মনে ভারিক্কি চালে চেয়ারে বসে পড়ল। হাতে পত্রিকা। পরপর কয়েকটা কাগজের ঢিল এসে রেলিংয়ের বাঁধা পেড়িয়ে নিচে পড়ল। শেষেরটা আশ্রয় নিল কবির পাশে এসে।

ঢিলের আশ্রয়স্থল অনুমান নির্ভর। ক কাগজের টুকরোটা সযত্নে খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল।

এমন বিজন বরিষণে হায়
মন যে হারিয়ে যায়
তোমার হৃদয় গহনে...


এতো কবির কবিতা। এ নিশ্চয়ই রিপার কাজ। রাস্তার ওপাড়ে কবির ঘরের ঠিক বিশ-বাইশ ফুট দূরে দু তলায় রিপার শোয়ার ঘর।

ভীষণ দুষ্ট আর আমুদে মেয়ে রিপা। সবার অবাধ্য। বাসায় কেউ নেই তো দরজা বন্ধ করে নাচ শুরু করে দিবে। খাওয়ার বেলায় উদাসীনি-চড়ুই দানায় ভুড়ি ভোজ। কারো সাধ্য নেই রাতে খাওয়ায়, সকালে বৈষ্ণবী আহার।

তবুও শরীরটা বেশ রিষ্টপুষ্ট। জলে ধোয়া নিশুতি রাতের চাঁদের আলোর মতো গায়ের রং। বয়স এই আষাঢ় মাসে পনেরোয় পা দিল।
জন্ম দিন উপলক্ষ্যে রিপাদের বাসায় বেশ জোড়েসোড়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল সেদিন। কিন্তু কি আশ্চর্য, কেক কেটে জন্ম দিন পালন হলো না।

রিপা বেঁকে বসল চানাচুর দিয়ে জন্ম দিন পালন করবে। ঘরে চানাচুরের কমতি নেই, হলেও তা অচ্ছুৎ। কবিকে বাধ্য হয়ে চানাচুর আনতে যেতে হলো মিস্টার খ্যাত চানাচুরওয়ালার কাছে। একজন মাধ্যমিক আর বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্র-ছাত্রীর এ ক্রিড়ায় অনেকেই অপমান বোধ করল। কানাঘুষা করল করল কেউ কেউ।

তবে রিপার বাবা রফিক সাহেব বেশ প্রীত হলেন।
রোদেলা বৃষ্টির দিনে ভাঙা ছাতা মুড়ো দিয়ে শেয়ালের বিয়ে করার মতো কবির মন উৎফুল্ল হয়ে উঠল। কাগজখানা দলা পাকিয়ে কবি ঘরে চলে গেল । বেড়িয়ে এলো বাতাসের টানে খুলে পড়া দরজার মতো। অপর পাশের দরজা বন্ধ হয়ে গেল ঠিক খুলার মতো করে।


অবশেষে নির্দিষ্ট হলো এটা রিপারই কাজ।
কবি জোরেসোরে আবৃত্তি করল:

চলে যাবো তোমা হতে বহুদূরে
ও চোখের দৃষ্টি, বুকের বাঁধন
আলগা হবে ক্ষীণ তালে,
তুমি তখন চেয়ে রবে
মোর শূন্য গৃহ পানে।


অনেক সময়ের কথা থাক। আকাশ ডাকলে বৃষ্টি হয়। দরজায় কপাট খোলার মতো করে রিপার দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়া শুরু করল।

কবি হাসল। রিপা চেচিয়ে বলে উঠল, পাজি, পেঁচা, শয়তান কোথাকার। আমায় কাঁদিয়ে দিলেন কেন। মাকে সব বলে দিব কিন্তু। কবি আর একটু হাসল।

বলল, বিকেলে চানাচুর খাওয়াব।
চোখের জল এবার জিহ্বায় চলে এল। ঠিক বললেন তো। মনে থাকে যেন। আপনার তো আবার ভুলো মন।


কবির মন দমে গেল। নি:ষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল রিপার না মুছা অশ্রু রেখা পানে। আকাশের গায়ে উদাস দৃষ্টি মেলে বলল, রিপা, আজ চলে যাচ্ছি।
চাইনা আপনার চানাচুর। - তারপর দরজার গায়ে মেঘ গর্জালো, চুরমুর করে ভেঙে পড়তে শুরু করল গাছের ডাল।

পরমূহুর্তে বাড়িময় হুলুস্থুল কান্ড বেঁধে গেল। অপর পাশে বিহ্বল নিরবতা।

কবির কথা
আমি তো হারাতে চাই নি তাকে
সকল বাঁধার দ্বারপ্রান্তে
সবল তেজে লড়েছি আমি
ব্যর্থ হলাম অবশেষে।

এই নিয়ে দুই পরিবারে একটা কুরুক্ষেত্র হয়ে গেল। আমার মা সেকেলে ধরনের মানুষ।

নাচ-গান জানা একটা মেয়েকে কিছুতেই পুত্রবধূ করতে চাইলেন না। বরঞ্চ মাথার দিব্যি দিয়ে আমাকে দূরে পাঠিয়ে দিলেন। কিছুই করার ছিল না আমার। রিপার মা মেয়েকে স্বামীর ঘরে পাঠানোর জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। বিদেশ্ ফেরত গ্রীনকার্ডওয়ালা বর পেয়ে গেলেন সত্ত্বর।

অতএব বিবাহ বিলম্ব করা চলে না।
রিপার সাথে দেখা হলো না আর। তবে যাবার শেষে কয়েক ছত্রের একটা পত্র পেয়েছিলাম তার:
হায়! আমি ছাড়াই
হাজার বছর ধরে
গোলাপ ফুটবে, বসন্তে রঙিন হবে প্রকৃতি;
কিন্তু যে আমার হৃদয়ের কথা শুনেছে
সে ঠিক আমার সমাধির পাশে এসে দাঁড়াবে।

শুরুতেই দার্শনিক এ গল্প শেষ করে দিয়েছে। অতএব আর কাজ কি কথনে।






অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।