আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলা ভাষার কথা ///

ভাষা আন্দোলনের মাস। মহান একুশের মাস। আমাদের ভাষিক অস্তিত্বের স্পষ্ট স্ফুরণের মাস। বাংলাভাষীর জীবনে কর্মলগ্ন বাতিঘর সৃষ্টির মাস। এই মাসে মহান ভাষা আন্দোলনের পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানি বাংলাভাষীদের। এ দেশের হীরক সন্তান রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার এবং আরও অনেক নামের বাতিঘর হাতে নিয়ে ১৯৫২ সাল থেকে পথ চলেছে বাংলাভাষী। চলতে চলতে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেয়েছি বাংলা ভাষাকে। স্লোগান বদল করে উচ্চারণ করেছি- 'শিক্ষার মাধ্যম চাই বাংলা ভাষা'। আবারও বদল করেছি স্লোগানের ভাষা- 'জীবনের সর্বস্তরে চাই বাংলা ভাষা'। বাংলা ভাষা দাবির আগুন তখন ছড়িয়ে গেছে সবখানে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও শিক্ষানীতিসহ সার্বিক সংগ্রাম নীতিতে। ভাষিক চেতনাই আমাদের প্রথম বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, বিভাষী পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে একসঙ্গে চলা যাবে না। তারই ফল মুক্তিযুদ্ধ এবং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ অর্জন।

সবই ইতিহাস। নিরেট সত্য। স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রসহ জীবনের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন নিয়ে দারুণ আন্তরিক সচেতনতা ছিল। আমি তখন বিএড. পড়ি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে (১৯৭২-৭৩ ব্যাচ)। কোথায় পাব বাংলা বই? বসে বসে পড়ার অধ্যায়গুলো বাংলায় অনুবাদ করে পড়তাম এবং বাংলায় প্রশ্নোত্তর লেখতাম। আমাদের চার-পাঁচজনের একটা দল তৈরি হলো। যারা অনুবাদ করত এবং প্রয়োজনে অন্যদের সহায়তা করত। তখন কিন্তু সাধুরীতির বাংলায় লিখেছি। প্র্যাকটিস টিচিংয়ে স্কুলে পড়াতে গিয়েও দেখেছি 'বাংলা ভূগোল' (ওই দুটোই আমার স্পেশাল সাবজেক্ট ছিল) বইগুলোর ভাষাও সাধুরীতির। অবাক হইনি। অসুবিধাও হয়নি। সাধু বাংলায় লেখা পাঠ্যবই আমরাও পড়েছি বিএ পরীক্ষা পর্যন্ত সাধু বাংলায় পরীক্ষাও দিয়েছি। অসঙ্গত মনে হয়নি কখনো। তা ছাড়া আনুষ্ঠানিক লেখালেখির ভাষারীতি ওটাই ছিল। ভুল ভাঙল কয়েক বছর পরই। জাতীয় শিক্ষাক্রম কমিটিতে তিন বছর কাজ (১৯৭৭-৭৯) করার সুযোগ পেলাম। প্রয়াত প্রফেসর শামসুল হক ছিলেন ওই কমিটির চেয়ারম্যান। লক্ষ করলাম, সাধু বাংলা ছাড়া কেউ লেখতেই চান না। মানে কলমে আসে না। প্রাথমিক পর্বের বইপত্র সাধু ভাষায় লেখা। এক সময় সিদ্ধান্তের পালা এলো, প্রাথমিক পর্বের পাঠ্যবই সাধু বাংলায়, না প্রমিত বাংলায় লেখা হবে? শতকরা ৯৯.৫ জনের মত ছিল, 'সাধু বাংলায় লেখা হবে'। আমি ছিলাম, 'প্রমিত বাংলায়' লেখার পক্ষে। কারণ স্কুলে পড়ে সাধু বাংলা, শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে প্রমিত বাংলায় (ভুল ভালোই বলে), বাড়িতে আঞ্চলিক বাংলা। ফলে শিশুদের মুখের ভাষায় পরিশীলন আসতে চায় না। যেভাবেই হোক অবশেষে প্রাথমিক পর্বের পাঠ্যবই প্রমিত বাংলায় লেখার সিদ্ধান্ত হয়। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জানাই, আমার প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলেন তৎকালীন আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রয়াত প্রফেসর মুহাম্মদ মুহিয়্যুদ্দীন। ১৯৮৫ সালের পর থেকে প্রস্তাবটার বাস্তবায়ন শুরু হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে প্রমিত বাংলায় বইপত্র লেখার ইতিহাস এরকমই। খুবই সংক্ষেপে বললেও কাজটা কিন্তু খুব সহজ ছিল না। যাক।

পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন এবং বাংলা ভাষা সম্পর্কিত হাদিসি বয়ান। যে যেমন বোঝেন বা ভাবেন, তাই বলে যান। পরম আবেগে। মাসজুড়ে প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার বাম কলামে লেখাগুলো জ্বলজ্বল করে। যে ক'টা পত্রিকা রাখি, তার সব লেখাই পড়ি। আজ ভাষা সম্পর্কিত দু'একটা হাদিসি বয়ান সম্বন্ধে আলোচনা করতে চাই। যেমন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ভাষা মতিন বলেছেন, 'ভাষা রক্ষার খাতিরে আবারও বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কারণ বাংলা ভাষার অপব্যবহার দেখা যাচ্ছে।' বাক্য দুটোর অর্থই বুঝতে পারিনি আমি। প্রথম, রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ, দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতি, গুহা কেটে ব্যাংক লুট, রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর উদ্ধার কাজ, তাদেরকে পুনর্বাসনের নামে গড়িমসি, শ্রমিকদের শোষণ প্রক্রিয়ার ষড়যন্ত্র, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বনাম পুলিশ এবং ছাত্রলীগের ত্রিমুখী সহিংস রক্তাক্ত সংঘর্ষ, অসাংবিধানিক অবৈধ সংসদ কাঠামো গঠন, ঐক্যজোটের মধ্য থেকেই একদলকে বিরোধী দল সাজানো, নির্বাচনের প্রহসন এবং শতমুখে তার বৈধতা নিয়ে প্রশস্তি গাওয়া, টিভিতে প্রাক-নির্বাচনকালীন মিনমিনে কথার টকশো, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শেয়ার কেলেঙ্কারি এবং ১৬ কোটি লোকের জীবনাচারে আমাদের মধ্যে চরম ভাষিক ঐক্য তো আছেই। সবই হচ্ছে বাংলা ভাষায়। সবাই দেখে, শোনে, বোঝে। যেটা নেই, সেটা হলো, ভাষারীতির ব্যবহারিক ঐক্য। স্থান কাল পাত্র প্রয়োজন সৌজন্য আনুষ্ঠানিকতা ইত্যাদির জন্য ভাষারীতির নূ্যনতম নিয়ম আমরা মানতে চাইছি না। একই বাংলা ভাষা প্রেমে রণে একরকম নয়। যুদ্ধ সন্ধিতে একরকম নয়। রাজনীতি আর সমাজনীতিতে একরকম নয়। আবৃত্তি গান উপস্থাপনায় যে চর্চিত সজ্জিত পরিশীলিত বাংলা, তা আর ময়দানি বক্তৃতা এবং আত্দপ্রশংসার বাংলা একরকম নয়। মিথ্যাচার এবং কূটনীতির বাংলাও একরকম নয়। অথচ সবই বাংলা ভাষায় হচ্ছে। এই ঐক্যের মধ্যে ভাষারীতির তথা শব্দ চয়ন এবং দুর্বল বাকশৈলিতে যে অনৈক্য সেটা আমরা বুঝতেও পারি না অনেক সময়।

অথচ ভাষিক দুর্বোধ্যতাই সবরকম নষ্টের গোড়া। বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। প্রেম নষ্ট হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়। ধর্মকথাকে সাম্প্রদায়িকতা মনে করে। ইসলামের নাম নিলেই পাকিস্তানের ইসলামের সঙ্গে মিল পাই। কেন, ভারতে কি মুসলমান নেই? সেখানে কি ইসলাম চর্চা নেই। সারা মধ্যপ্রাচ্য, ইসরায়েল বাদে, ইসলামের চর্চা নেই? মিসর, লিবিয়া, সুদান ইত্যাদি দেশে কি ইসলাম চর্চা নেই? সেসব দেশের সঙ্গে মিল খুঁজে পাই না কেন? দুর্বল ভাষা আর দুর্বল মনন কিন্তু অভিন্ন। তাই বলতে চাই, এসব ভাষিক দুর্বলতায় মানুষের মনও ছোট হয়, অন্যকে আঘাত করাও সহজ নয়। কখনো জেনে, কখনো না জেনে। এসব ক্ষেত্রে বলতেই হয়, বাংলা ভাষার বিজ্ঞানভিত্তিক চর্চা, ব্যবহারিক বিশ্লেষণমূলক গবেষণায় আমরা প্রায় শূন্যের কোঠায়। পারস্পরিক ভাষিক ব্যবহারও বোধগম্যতায় আমরা নিদারুণ হীনম্মন্য। ঐক্যমন্য একেবারেই নই।

মতিন ভাই বলেছেন, ভাষা রক্ষার খাতিরে আবারও বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই কথাটাই ঘুরিয়ে বলতে চাই। ভাষা রক্ষার 'খাতিরে' নয়, 'দাবিতে' বাঙালিদের গবেষণায় মন দিতে হবে। যে কাজটা বলতে গেলে কোনো দিনই সুষ্ঠুভাবে হয়নি। বাংলা একাডেমির অভিধানগুলো নিঃসন্দেহে গবেষণামূলক কাজ। কিন্তু প্রমিত বাংলা ভাষার বানান এবং উচ্চারণ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কাজ খুব কম হয়েছে। বিশেষ করে বানানের নৈরাজ্য সইতে না পেরে প্রজন্মরা এখন রোমান অক্ষরে বাংলা লিখছে। সেখানে হ্রস্ব দীর্ঘ ই/উ- এর বালাই নেই। নেই মূর্ধন্য-ণ, মূর্ধন্য-ষ এবং ফলাযুক্ত কিছু দ্বিত্ব বর্ণের উৎপাত।

এর জন্য প্রজন্মকে শাপশাপান্ত করে তো লাভ নেই। অতিরিক্ত চাপে পড়ে ওরা বাংলা মায়ের কোল ছেড়ে দিচ্ছে। এখনো আমরা বাংলা বানানের নৈরাজ্যকে নিয়মের নামে অাঁকড়ে ধরে আছি। পণ্ডিতরা বানান সাত্তি্বকতা রক্ষার জন্য দণ্ড উঁচিয়ে পাহারা দিচ্ছেন। কার কথা কে শোনে? প্রজন্ম রোমান হরফে লিখছে : কসহ ধংড়? না ইংরেজি, না বাংলা বানান লেখা হলো। কিন্তু ভাষার প্রধান কাজ মনের ভাব প্রকাশনা করা। সেটা হয়ে যাচ্ছে। আটকাতে পারছে না কেউ। মতিন ভাইকে বলি, বাঙালিদের ভাষিক ঐক্য ক্রমেই তো দূরে সরে যাচ্ছে পণ্ডিতি শাসনের কারণে। কী করতে পারি আমরা? কী করেছেন ভাষাসৈনিকরা? বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও করেছি মতিন ভাইয়ের সঙ্গে।

বাংলা ভাষার অপব্যবহার বলতে মতিন ভাই কি বোঝাতে চেয়েছেন তা বুঝিনি। যদি এর অর্থ হয় যথাস্থানে যথাযথ ভাষার প্রয়োগ হচ্ছে না, তাহলে বলব ঠিকই বলেছেন। কিন্তু মতিন ভাই প্রমিত বাংলা বানানের কথা একবারও কেন বললেন না? বাংলা একাডেমির (২০ বছর পর 'একাডেমী' বানান শুদ্ধ হয়েছে) প্রমিত বাংলা বানান পুস্তিকায় ২.০১. নিয়মে বলেছে, তৎসম শব্দ ছাড়া দেশি বিদেশি মিশ্রশব্দে কেবল হ্রস্ব ই/উ এবং তাদের 'কার' ব্যবহৃত হবে। তবু আমরা 'কী' লেখি। কত কারণ, কত ব্যাখ্যা বের করা হয়েছে এর জন্য, যার কোনোটাই ধোপে টেকে না। যুক্তির মধ্যে পড়ে না। তবু গায়ের জোরে চলছে।

'কি' একটা বাংলা শব্দ। বাংলায় দীর্ঘস্বর নেই। তাই কারও থাকার কথা নয়। তাই 'কি' বানান কখনো 'কী' হবে না। রবীন্দ্রনাথ লেখলেও মানব না, কারণটা বলেছি অনেক লেখায়।

অন্যদিকে তৎসম শব্দের বানানকে পাহারা দেওয়ার কথাটা এখন আর মানতে চায় না আমার যুক্তি। তৎসম তথা সংস্কৃত শব্দ বাংলায় যদিও এসেছে তার প্রকৃত বানানসহ, কিন্তু উচ্চারণে তা বরাবরই বাংলা ছিল এবং আছে। যেমন স্বাস্থ্য, সূর্য্য, আপষ, কার্ত্তিক, মঞ্জরী, ধূলি, স্বত্ত্ব, শ্মশান, পদ্ম অর্দ্ধ ইত্যাদি বানান এখন বদলে গেছে কতক ব্যবহারিক চর্চায়, কতক বাংলা একাডেমির নিয়মে। যেমন : স্বাস্থ, সূর্য, আপস, কার্তিক, মঞ্জরি, ধুলি, স্বত্ব, শ্মশান, পদ্ম, অর্ধ লেখা হচ্ছে। উচ্চারণে তা আরও সহজ। আরও বাংলামন্ত। যেমন : স্ওয়াত্ওয়া (স্বত্ব) হয়েছে 'সত্ব', পদ্ম হয়েছে 'পদ্দ', সমশান (শ্মশান) হয়েছে 'শশান'। যখন শব্দগুলো বাংলায় এসেছে, তখন থেকেই ওই শব্দগুলোর উচ্চারণ এমনই বাংলামন্ত। সংস্কৃতের উচ্চারণ দম্ভ ঝেড়ে কেটে ধুয়ে মুছে বাংলাভাষীর বাগযন্ত্র তাকে মুখে নিয়েছে। এতে কেউ কিছু বলে না। বিরূপ মন্তব্যও নেই। কিন্তু বানানের ব্যাপারে সংস্কৃত বানানকে জাপটে ধরে রেখেছি শক্ত করে। প্রজন্ম সেগুলো না মেনে বিপ্লব এনেছে রোমান হরফে সরল বানান লিখে। কিছু করার নেই। বলারও নেই। ওরা আর পেছন ফিরবে না। ওদের জন্য উচ্চরণানুগ বানান লেখার বিধান তৈরি করতেই হবে। এবং অতি সত্বর। নাহলে বিপন্ন হবে বাংলা ভাষা।

সংস্কৃত শব্দের বানান যদি যুগ যুগান্ত কেন, বহু শতাব্দীর সংস্কারও হয়, তাও যে আমজনতার মুখের উচ্চারণে প্রথম থেকেই বাংলা হয়েছে! তারপর একটু একটু করে বানানে এসেছে। তো তৎসম বানানের সংস্কার যদি ভাঙাই যায়, তাহলে এলোমেলোভাবে কেন? রীতিমতো গবেষণা করেই হতে হবে কাজটা। উচ্চরণানুগ বানান লেখার অনিবার্য প্রয়োজন থেকেই ১৯৩৪-৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বাংলা বানান সংস্কারের কাজ করেছিল। সেখানে 'বাঙ্গালা' শব্দটা থেকেই গিয়েছিল। তবুও বাঙ্গালা বানান সংস্কারের পদক্ষেপে দুটো বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রথম, সংস্কৃত শব্দকে বাংলায় উচ্চরণানুগ বানানে লেখা প্রয়োজন। দ্বিতীয়, বাংলায় ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দের বানান সংস্কার করা যায়। এই বাস্তবতার পথ ধরেই বাংলাদেশে এনসিটিবি ১৯৮২ সালে এবং বাংলা একাডেমি ১৯৯২ সালে প্রমিত বানান সংস্কারের কাজগুলো করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'বাঙ্গালা' বানানের নিয়ম সংস্কার পথ দেখিয়ে দিলেও সাহস করে বেশি দূর এগোলো না কোনো প্রতিষ্ঠান। সবই থোড় বড়ি খাড়া- খাড়া বড়ি থোড়ের মতো হয়ে থাকল। ওইসব কাজে কোনো ভাষাবিজ্ঞানীকে সম্পৃক্ত করাও হয়নি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে বাঙ্গালা বানান সংস্কারকারীরা ছিলেন পণ্ডিত ব্যক্তি। ওরা বহু সুধীজনের মতো পরামর্শও সংগ্রহ করেছিলেন। ওদের প্রবল সীমাবদ্ধতা ছিল একটাই, 'ভাষা বিজ্ঞান' বিষয়টাই কেউ পড়েননি। বিষয়টা তখনো গবেষণালব্ধ চর্চায় ভারতে আসেনি। তবুও তারা স্বজ্ঞালব্ধ জ্ঞানের ওপর আস্থা রেখে একটা মাইলফলক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং বানান সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্যতার সাহসী দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেটা বাংলাভাষীদের মস্ত প্রাপ্তি। তবে কলকাতার পণ্ডিত ব্যক্তিরা বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের দুহিতা মনে করে শব্দের উৎপত্তি ও ব্যুৎপত্তি নির্ধারণ করতে চেষ্টা করেছেন। বাংলা যে পূর্বাঞ্চলীয় প্রাকৃতের, বিশেষ করে গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকে অপভ্রংশের বিবর্তন প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা ভূমিজ ভাষা, এটা তারা হয় জানতেন না, নয়তো জেনেও মানতেন না। এখন সে কথা থাক।

বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানান পুস্তিকায় যেসব বানান সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, সেখানে একবারও বলা হয়নি বাংলা বানান এতই সহজ যে তার সংস্কারের প্রয়োজনই নেই। দেশি-বিদেশি শব্দ যখন বাংলায় এসে পড়েছে, তখন তা আমরা বাংলা বানানেই লিখছি। বাংলা একাডেমি সেটাকে আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে। হোঁচট খেতে হয় সংস্কৃত শব্দ লেখতে গেলেই। এনসিটিবি এখন 'শ্রেণি' বানান লিখছে। এটা 'আধা খ্যাঁচড়া' সংস্কার। ওই যে বলা হয়েছে, বাংলায় দীর্ঘস্বর নেই, তাই শ্রেণী হয়েছে শ্রেণি। কিন্তু মূর্ধন্য-ণ-ও যে বাংলার বর্ণ বা ধ্বনি নয়, 'বহুকাল আগে এর উচ্চারণ লুপ্ত' হয়ে গেছে (ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়); সেটাও তাহলে মানতে হবে। তাহলে তো 'শ্রেণি' বানানই চলতে পারে। আসলে বাংলাভাষীর মুখে মূর্ধন্য-ণ-এর উচ্চারণ আসতেই চায় না। কথাটা রবীন্দ্রনাথও বলেছেন বেশ স্পষ্ট করে। চর্যাপদের কবিতায় দুই ন-এর আপস বদল (রহঃবৎপযধমবধনষব) বানান আছে। এটা দেখেও বোঝা যায়, সাহিত্যের ভাষা গড়ে ওঠার সময়ও উচ্চারণে দুই-ন-এর সমস্যা ছিল। হলো তো প্রায় দেড় হাজার বছর দেখা। বানানের মূর্ধন্য-ণ এতই বেয়াড়া, কিছুতেই এলো না বাংলাভাষীর মুখে। আমাদের উচ্চারণে মুর্ধন্য-ণ দন্ত্য-ন-এর সহধ্বনি। 'দন্ত্য সন্তাপ', আর 'দণ্ড গুণ্ডা' উচ্চারণ করলেই তা বোঝা যায়।

বাংলা বানানে যখন লেখি গ্রহণ, মরণ, শ্রবণ, শয়ণ, অগ্রহায়ণ, কারণ, পাষাণ, হিরণ, ব্যাকরণ, উচ্চারণ তখন মূর্ধন্য-ণ অন্তধ্বনি এবং বদ্ধধ্বনি। এমন অবস্থানের মূর্ধন্য-ণ তো উচ্চারণ হতেই পারে না। বদ্ধ মহাপ্রাণ ধ্বনি যেমন মহাপ্রাণতা লুপ্ত হয়; বদ্ধ মূর্ধন্য-ণ-এর তেমনি পশ্চাৎ তাড়নও সৃষ্টি হয় না। ফলে ওই শব্দগুলোর অন্ত মূর্ধন্য-ণ -এর পশ্চাৎ তাড়ন থাকে না। আমাদের উচ্চারণে তা হয় দন্ত্য-ন। যদি প্রজন্মের বাংলা বানানেও এই সংস্কার এসেই যায়, তাহলে কিছুই করার থাকবে না। এই ণ নিয়ে অনেক বাহাস হয়েছে। কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বাংলা একাডেমি। বাংলা শব্দে মূর্ধন্য-ণ নেইও। বেঁচে গেছি সেদিক থেকে; কিন্তু কাজ তো জমে গেছে অনেক। করতেও চাই। জানি না কবে সুযোগ পাব? ভাষার মাসে কথা বলতে চায় অনেকে। কাজ চায় না কেউ।

লেখক : সাবেক অধ্যাপক, ö

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.