ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বাংলাদেশে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বিক্রির বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। গতকাল মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে বিসমটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এই আশ্বাস দেন ড. মনমোহন সিং। একই দিনে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর সুশীল কৈরালার সঙ্গে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশকে অংশীদার করতে প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে বিমসটেকের মূল অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় প্রত্যয় জানিয়ে বলেছেন, আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সহযোগিতার মাধ্যমে বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও 'সোনার বাংলা' গড়ে তেলার স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাবে। সম্মেলন শেষে প্রধানমন্ত্রী গতকাল রাতে মিয়ানমার থেকে ঢাকায় এসে পেঁৗছান। নেপিডো সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সকালে যোগ দেন বিমসটেকের মূল সম্মেলনে। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ও তৃতীয় বিমসটেক সম্মেলনের চেয়ারম্যান থেইন সেইনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এ সময় শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী তেশেরিং তোবগে এবং থাই প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও স্থায়ী সচিব সিহাসাক ফুয়াঙকেতকেউ উপস্থিত ছিলেন। দুপুরে সম্মেলন শেষে প্রথমে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয় শেখ হাসিনা ও ড. মনমোহন সিংয়ের। নতুন সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই প্রথম বৈঠক করলেন। অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ড. মনমোহন সিংয়ের এটাই শেষ মেয়াদ হিসেবে ধরা হচ্ছে। পরে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা।
ভারত ও বাংলাদেশের দুই প্রধানমন্ত্রীর প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারপ্রধানকে অভিনন্দন জানান। দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টারও প্রশংসা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বলেন, টেকসই গণতন্ত্রের অব্যাহত ধারার চর্চার মাধ্যমে এই অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও সন্ত্রাসকে এ অঞ্চলের 'অভিন্ন শত্রু' হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এর বিরুদ্ধে 'ঐক্যবদ্ধভাবে' সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারের কথা বলেন। সে লক্ষ্যে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশকে সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী উল্লেখ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ বিভিন্নক্ষেত্রে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে। শেখ হাসিনা বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান এই চার দেশ আঞ্চলিক উদ্যোগে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করতে পারে। এ উদ্যোগ এই অঞ্চলের অর্থনীতিকেও গতিশীল করবে। এ জন্য বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে ভারতের সহযোগিতা বাড়াতে অনুরোধ করেন শেখ হাসিনা। বিশেষ করে ত্রিপুরা থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশের সঞ্চালন লাইনে যুক্ত করার জন্য মনমোহন সিংকে অনুরোধ জানান তিনি। এর জবাবে মনমোহন সিং আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, সম্ভব দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। দুই দেশের স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন ও তিস্তা চুক্তি নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। স্থলসীমা প্রটোকল ভারতের লোকসভায় উত্থাপন করায় মনমোহন সিংকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ওই প্রটোকল বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনের বিল শীঘ্রই ভারতের পার্লামেন্টে পাস হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। তিস্তা চুক্তি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ ভারতের ইতিবাচক ও কার্যকর পদক্ষেপের অপেক্ষায় রয়েছে।
দুই নেতার বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিব শংকর মেনন ও পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ এম জিয়া উদ্দিন ও পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক।
জলবিদ্যুতে অংশীদার করতে নেপালকে প্রস্তাব : নেপালের ভৌগোলিক সুবিধা ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে অংশীদার হতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালাকে প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিমসটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তিনি এ প্রস্তাব দেন। সুশীল কৈরালাও দুই দেশের যৌথ অংশীদারিত্বে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে একমত হয়েছেন বলে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী জানিয়েছেন। বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল একসঙ্গে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজ করতে পারলে তিন দেশই লাভবান হবে। এ ছাড়া কৃষিভিত্তিক শিল্প এবং পর্যটন শিল্পে এক সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে একমত হয়েছেন দুই নেতা। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে উন্নয়নের পূর্বশর্ত উল্লেখ করে এক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে জোর দেন হাসিনা ও কৈরালা।
বিমসটেকের ভাষণ ও সম্মেলন : সকালে বিমসটেকের নির্ধারিত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'বিমসটেকের লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশের অঙ্গীকারের কথা আমি পুনর্ব্যক্ত করছি। আমাদের সবাইকে আমাদের সাধারণ লক্ষ্যে পেঁৗছে দেওয়ার সম্ভাবনা এই জোটের আছে। বিশেষ করে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য বাংলাদেশের 'ভিশন ২০২১' বাস্তবায়নে এই জোট ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশকে 'সোনার বাংলা' হিসেবে গড়ে তোলার অভিযাত্রায় একটি পদক্ষেপ এই 'ভিশন ২০২১'। বিমসটেকের স্থায়ী সচিবালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের সব যৌথ সিদ্ধান্ত ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে কার্যকর গতি আসবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আর এই সচিবালয় স্থাপনের জন্য বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে বেছে নেওয়ায় জোটভুক্ত দেশগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এই সচিবালয় সব ক্ষেত্রে আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা পাবে- এই নিশ্চয়তা আমি দিচ্ছি। বিমসটেকের প্রথম মহাসচিবকে ঢাকায় স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় রয়েছি আমরা। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বিমসটেকের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, বিশ্বায়নের এ যুগে অভিন্ন সংস্কৃতি ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জাতিসমূহের মধ্যে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক জোট গঠন এখন আর শখের বিষয় নয়, বরং সময়ের দাবি। তৃতীয় বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য 'সংহতি ও সমৃদ্ধির জন্য অংশীদারিত্ব' যা সমতা ও অংশীদারিত্বের চেতনায় যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে এ অঞ্চলের সামাজিক অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে কার্যপন্থা হিসেবে কাজ করতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বিমসটেকের স্থায়ী সচিবালয় বাংলাদেশে স্থাপন করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।
চুক্তি স্বাক্ষর : অধিবেশনের পর বিমসটেক সদস্য দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের উপস্থিতিতে দুটি মেমোর্যান্ডামস অব অ্যাসোসিয়েশন (এমওএ) এবং একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। মেমোর্যান্ডামস অব অ্যাসোসিয়েশন দুটি হলো এমওএ অন এসটাবলিস্টমেন্ট অব দ্য বিমসটেক পার্মানেন্ট সেক্রেটারিয়েট, এমওএ অন এসটাবলিস্টমেন্ট অব দ্য বিমসটেক সেন্টার ফর ওয়েদার অ্যান্ড ক্লাইমেট এবং সমঝোতা স্মারক হলো এসটাবলিস্টমেন্ট অব দ্য বিমসটেক কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিজ কমিশন (বিসিআইসি) অ্যান্ড বিমসটেক কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিজ অবজারভেটরি (বিসিআইও)। বিমসটেক নেতারা একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলন ও গ্রুপ ফটো সেশনে অংশ নেন।
ঢাকা ফিরলেন প্রধানমন্ত্রী : দুই দিনের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার উদ্দেশ্যে মিয়ানমার ত্যাগ করেন। রাত ১১টার কিছু পরে তিনি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পেঁৗছান। বিমানবন্দরে মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।