আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নারী দিবস : সমাজ ও রাষ্ট্র

পার হয়ে গেল ৮ মার্চ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বাংলাদেশে এ বছর মৃদু একটা আলোচনা উঠেছিল, পুরুষরা আলাদা করে তাদের জন্য কোনো দিবস পালন করে না। নারীদের কেন তা করতে হবে। খুবই ইন্টারেস্টিং একটি প্রশ্ন।

১৮৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা ভোটাধিকারসহ বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে পুলিশ তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। তৎকালে সমগ্র বিশ্বে, বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকায় এটি একটি বড় ঘটনা ছিল। ঠিক সঙ্গে সঙ্গে এই আন্দোলন জয়যুক্ত হয়ে গিয়েছিল সেই রকম নয়? 'কি করে আমরা ভোটের অধিকার পেলাম'_ এই শিরোনামে নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন গত সপ্তাহে বাংলাদেশ প্রতিদিনে একটি লেখা লিখেছিলেন। সম্ভবত ভোটাধিকার মেয়েরা পেয়েছিল নিউজিল্যান্ডে। সেই নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অধিকার মেয়েদের ছিল না।

তারা সেই অধিকার পেয়েছিল ১৯১৮ সালের পরে। ইউরোপের প্রথম যে বড় দেশটিতে মেয়েরা ভোট দেওয়া এবং ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার পায় সেটি ফিনল্যান্ডে ১৯০৫ সালে।

১৯০৫ সালকেও যদি আমি আন্দোলনের বিজয়ের দিন বলে মনে করি, তাহলেও এটুকু বিজয়ের জন্য নারী সমাজকে প্রায় ১০০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। সেই বিজয়টিও মাত্র একটি দেশে অর্জিত হয়েছে এবং সেই দেশটি যে দেশে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সেই দেশ নয়, সেই দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়। কিন্তু তারপরও ১৮৫৭ সালের সেই আন্দোলনের তাৎপর্য এখন অনেক গভীর।

জার্মান নারী নেত্রী ক্লারা জেটকিন এ দিনটিকে নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব করেছিলেন। পরের বছর ১৯১১ সালে প্রথম বেসরকারিভাবে বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালন করা হয়। আর এর দীর্ঘ ৭৩ বছর পর ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ এটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশেও সেই সিদ্ধান্তের আলোকে বছর বছর দিনটি পালন করে আসছে।

খেয়াল করা দরকার, বাংলাদেশে নারী ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কিন্তু কোনো আন্দোলন করতে হয়নি।

বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখানকার নারীদের অবরোধ বা অন্তঃপুরবাসিনী অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কোনো রক্তক্ষয়ী বা দীর্ঘ আন্দোলনও গড়ে তুলতে হয়নি। অবশ্যই আমাদের সমাজের পশ্চাৎপদতা ছিল, নারীরা অন্তঃপুরবাসিনী ছিলেন, তার বিরুদ্ধে বেগম রোকেয়াকে জীবনভর সংগ্রাম করতে হয়েছে। আর একটা কথা, আন্দোলন শুরু করেছিল সেলাই কারখানার শ্রমিকরা। তারই একটি বৃহত্তর অবয়ব হিসেবে বর্তমানে আমরা বাংলাদেশে গার্মেন্ট কারখানার কথা ভাবতে পারি। প্রায় ১৫০ বছর পরে সেই সেলাই কারখানার শ্রমিকরা তাদের মর্যাদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সুনির্দিষ্ট কি কি দাবি সেদিন পেশ করেছিলেন তা আমরা জানি না।

কিন্তু এ বছরও বাংলাদেশে যেসব নারী সংগঠন এ দিবসটি পালন করেছে, তাদের মধ্যে মাত্র দুটি গার্মেন্ট শ্রমিক সংগঠন ছিল।

যদিও অনেকের মুখে আলাদা করে নারী দিবস পালনের প্রশ্ন ছিল কিন্তু তার পরও আচার-অনুষ্ঠানে দিনটি ছিল জমজমাট। এ কথা ঠিক সূর্য ওঠার আর ডোবার মতো দিন হিসাব করলে আজকাল পশুর মধ্যে পার্থক্য কতটুকু। কিন্তু যখনই আমরা আলাদা করে একটি দিন পালন করি তখনই সেই দিনটি আলাদা করে মনোনীত হয়ে ওঠে। তার একটি আলাদা তাৎপর্য তৈরি হয়, আলাদা ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়, বছরে যে কোনো দিনের চেয়ে তার আলাদা দ্যোতনা দেখা যায়।

এখন আর নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে বাংলাদেশ নারী দিবস পালন করে না। একটু আগেই বললাম দু-একটি গার্মেন্ট সংগঠন এ দিবসের কর্মসূচি দিলেও এটি আর গার্মেন্ট শ্রমিকের বিশেষ কোনো দিন নয়। এটি একটি সর্বজনীন নারী সমাজের দিবস হিসেবে বিবেচিত ও পালিত হয়। নারীর অধিকার ও সমতা প্রতিষ্ঠাই এখন নারী দিবসের প্রধান স্লোগান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের আয়োজিত শোভাযাত্রায় বক্তারা নারীবান্ধব পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের আহ্বান জানান।

এ জন্যই আলাদা করে নারী দিবস পালনের পক্ষে আমি। আগেই বলেছি, যে দাবিসমূহ নিয়ে ১৮৫৭ সালে এ আন্দোলনের শুরু সে দাবির কোনো কিছুই আর জানা নেই আমাদের। আর মূল দাবি নারীর ভোটাধিকার তো ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেই। কিন্তু ভোটাধিকার মানেই নারীর সমুদয় সামাজিক অধিকার নয়। এমনিতেই বাংলাদেশ নারীবিদ্বেষী কোনো সমাজ নয়।

দেশের প্রধানমন্ত্রী, আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী, বর্তমান সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী, আমাদের স্পিকার সবাই নারী। উপজেলা পর্যায়ে একজন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের নির্বাচন বিধানদ্বারা প্রতিষ্ঠিত। রাজনৈতিকভাবে নারীর অগ্রযাত্রার কথা বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত কোনো নারী প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। হিলারি ক্লিনটনের মতো ক্যারিশমেটিক নেত্রীও প্রাইমারি ভোটে পাস করতে পারেননি।

সেসব দিক থেকে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় নারী সমাজের যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হলেও জেন্ডার সমতার বিষয়টি এখনো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে সত্য, কিন্তু তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রার অনেক নিচে অবস্থান করছে। শুধু তাই নয়, নারী নির্যাতন ও বঞ্চনাও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা সম্ভব হয়নি। দেশের নারী সমাজ এখনো নানা ধরনের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে এবং এর শিকার হয়ে আত্দহননও করেছেন অনেকে।

যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় প্রতিবাদকারীকেও হত্যা করা হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। গার্মেন্ট শিল্পে নারী শ্রমিকের বঞ্চনা আলোচিত ঘটনা। এ শিল্পের প্রসার ঘটেছে মূলত নারী শ্রমিকের কল্যাণেই অথচ তারা অনেক সময় কষ্টকর জীবনযাপন করে থাকেন। যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহ, ধর্মীয় কুসংস্কার, পারিবারিক জীবনে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের আধিপত্য ব্যক্তি ও সমাজের মাইনসেট একটি নারীবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা।

রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, 'নারীর সমতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত কর'- এ স্লোগান ৮ মার্চ সামনে রেখে ৬৭টি নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের সম্মিলিত মঞ্চ সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করে।

এতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ নির্যাতনের শিকার একজন নারীর পাশে হাজার নারী উপস্থিত থাকবে বলে অঙ্গীকার করেন। বোঝা যায়, এটি একটি সরকার সমর্থিত সমাবেশ। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন আলোচনা ও সভার আয়োজন করে। এখানে যারা আলোচনা করেন তারা নারীর প্রতি এসব অবান্ধবসুলভ আচরণের প্রতিবাদ করেন।

নারী সমাজের জন্য সুনির্দিষ্ট এ দিনটিতে সবচেয়ে বড় অন্যায় দিক হলো ওই দিন মহিলা দলের শোভাযাত্রায় পুলিশের বাধা।

একদিকে আমরা ঘোষণা করছি আমরা নারীবান্ধব সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, অপরদিকে একটি সংগঠনকে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হবে না এই বিমাতাসুলভ আচরণ নারী নির্বিশেষে সবাইকে অপমান করার শামিল। এটি কেবল দলীয় রাজনীতির কারণে? ওরা বিরোধী দলের বলে? তাহলে তো প্রশ্ন উঠতে পারে আমরা যে বলছি নারীর ভোটাধিকার আমরা অনেক আগেই প্রতিষ্ঠা করেছি। সেই আমরাই তো নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সবার ভোটাধিকারই কেড়ে নিয়েছি।

লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।

ই-মেইল :mrmanna51@yahoo.com

 



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.