অভিযোগ বাঙ্ আছে। নিয়মিত সে বাঙ্ েজমা পড়ছে ভুক্তভোগীদের শত শত অভিযোগনামা। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। গত পাঁচ বছরে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ২৯টি দফতর-অধিদফতরের বিভিন্ন অভিযোগ বাঙ্ েজমা পড়ে ১২ লাখেরও বেশি অভিযোগ, আবেদন-নিবেদন। একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নির্ধারিত সেলে অভিযোগ করে কিছু প্রতিকার পাওয়া ছাড়া আর কোথাও তেমন কোনো সাড়া পাচ্ছেন না অভিযোগকারী নাগরিকরা।
ভুক্তভোগীদের দৃষ্টিতে একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছাড়া অন্য সব অভিযোগ বাঙ্গুলো যেন নামসর্বস্ব বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বাস্তবে জনগণের অভিযোগ দেখার বা প্রতিকারের যেন কেউ নেই।
সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দফতরসমূহে জনসাধারণের পাঠানো লাখো আবেদন-নিবেদন-অভিযোগের প্রতিকার মিলছে না। সেসব অভিযোগ, চাওয়া-পাওয়া খুব একটা পাত্তাও পাচ্ছে না। বিভিন্ন দফতরে সিটিজেন চার্টার ঝুলিয়ে আবেদন-নিবেদন নিষ্পত্তির জন্য একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডের সুফল পাচ্ছেন না জনগণ।
রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ২৯টি দফতর-অধিদফতরে গত পাঁচ বছরেই ১২ লক্ষাধিক আবেদন নিবেদন, অভিযোগ জমে জমে পাহাড় হয়ে উঠেছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো প্রক্রিয়ায় সেসব অভিযোগের সুরাহা করা হচ্ছে না। এমনকি নিদেনপক্ষে প্রতিকার প্রার্থীকে একটি চিঠি দিয়ে সান্ত্বনা জানানোর বা পরামর্শ দেওয়ার উদ্যোগ পর্যন্ত নেওয়া হয় না। বরং কোনো কোনো দফতরে জনগণের পাঠানো অভিযোগনামা নিয়ে অভিনব স্টাইলে বাণিজ্য ফেঁদে বসার চক্র গড়ে উঠারও নজির সৃষ্টি হয়েছে। চক্রের সদস্যরা জনগণের আবেদন নিবেদন নির্ধারিত খাতায় তালিকাভুক্ত করার পরিবর্তে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা কর্মকর্তাকে ডেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে সব কিছু ধামাচাপা দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগও উঠেছে।
গত কয়েকদিন অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও এর নিয়ন্ত্রিত বিভাগ পুলিশ সদর দফতর, র্যাব, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে সবচেয়ে বেশি অভিযোগনামা পাঠান ভুক্তভোগীরা। গত পাঁচ বছরে পুলিশ সদর দফতরে পেঁৗছেছে ৭০ হাজার অভিযোগ। এর পরই স্থান দুর্নীতি দমন কমিশনের, সেখানে আবেদন নিবেদন, অভিযোগনামা পেঁৗছে ৪২ হাজার। ভূমি মন্ত্রণালয় ও এর অধিনস্ত দফতর-অধিদফতর মিলিয়ে ৬৩ হাজার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিনস্ত দফতরে ৫৮ হাজার, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে ১৭ হাজারের বেশি, স্বাস্থ্য অধিদফতরে ৪১ হাজার, কৃষি অধিদফতরে ৩৫ হাজার, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ২৫ সহস াধিক, এলজিইডিতে ১৪ হাজার, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ২৩ হাজার, ঢাকা সিটি করপোরেশন (দুই ডিসিসি মিলিয়ে) ১৭ হাজার, ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ১৮ হাজার, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে সাড়ে ২৬ হাজার, আইন মন্ত্রণালয়ে ২৩ হাজার, পরিবেশ অধিদফতরে ৩৬ হাজারেরও বেশি, বিএসটিআইয়ে ২১ হাজার ও কাস্টমস দফতরসমূহে ২৭ সহস াধিক অভিযোগ জমা পড়ে। লিখিত আকারে এসব অভিযোগ ডাক বিভাগের মাধ্যমে চিঠিতে, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এবং ই-মেইলে জড়ো হয়।
নিয়ম রয়েছে, এসব অভিযোগ নির্ধারিত লগ বইতে লিপিবদ্ধ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে পাঠানোর। এরপর চিঠি ও অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনা করে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের টেবিলে আবেদন-নিবেদনগুলো পাঠানো হয়। দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কী প্রতিকার দিলেন সে বিষয়গুলো আর লগ বইয়ের তালিকাভুক্তির স্থলে লিপিবদ্ধ রাখার ব্যবস্থা না থাকায় সহজেই দরখাস্তগুলো ধামাচাপা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। সেসব নালিশের প্রতিকার পাওয়া যায় না। 'নালিশ করে বালিশ পাওয়া' ব্যঙ্গাত্দক শব্দে পরিণত হয়।
অভিযোগ করলেই বরং অনেক ক্ষেত্রে বিপদ বাড়ে। চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষই কোনো অভিযোগ উত্থাপন করার সাহস পায় না। অভিযোগ করলে সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হতে হয়। তা ছাড়া যে দফতরে বা কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়, সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তির চেয়ে নিরীহ অভিযোগকারীকেই বেশি হয়রানি পোহাতে হয়। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা কিল খেয়ে কিল হজম করার বিদ্যায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশ সদর দফতরে গত পাঁচ বছরে প্রায় ৭০ হাজার অভিযোগনামা পেঁৗছে। এ হিসেব লগ বইয়ে লিপিবদ্ধ রাখার তালিকা থেকে পাওয়া। প্রতিদিন ওই দফতরে ভুক্তভোগী মানুষজন ও হয়রানির শিকার কর্মকর্তাদের পাঠানো প্রায় ৩০০ চিঠি এসে পেঁৗছে। সেখানে মূল অফিসের বাইরে সীমানা প্রাচীরঘেঁষা প্রধান ফটকের সামনে থাকা পুলিশ কনস্টেবলরা এসব অভিযোগ খাতায় লিপিবদ্ধ করে চিঠি জমা রাখেন। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আসা চিঠিগুলোও জমা রাখা হয় মূল অফিসের বাইরে, প্রধান ফটকেই।
এ ক্ষেত্রে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে আসা সাধারণ চিঠি এবং কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পেঁৗছানো অভিযোগনামার সবগুলো লগ বইতে লিপিবদ্ধ করা হয় কি না তা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাতে গোনা কিছু চিঠি লগ বইতে লিপিবদ্ধ করা হলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু চিঠি একটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা মূল দফতরকে এড়িয়ে অভিযোগনামায় বর্ণিত কর্মকর্তাদের ডেকে পাঠান এবং মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে ভুক্তভোগীদের অভিযোগনামাকে লাপাত্তা করে দেন। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদিসহ অভিযোগনামা পাঠানো সত্ত্বেও কারও বিরুদ্ধে কোনোরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নজির দেখা যায় না।
অভিযোগপত্র জমার দিক থেকে পুলিশের পরই স্থান রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের।
সারা দেশের বিভিন্ন বিভাগের সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এমন কি ব্যক্তিকেন্দ্রিক নানা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে হাজার হাজার অভিযোগনামা আসে দুদকে। সেখানে অভিযোগপত্রসমূহ লিপিবদ্ধ করে তার সারমর্ম কমিশনার পর্যায়ের কর্মকর্তাকে অবহিত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু দুদক কার্যালয়ে একজন পিয়ন ও নিরাপত্তা কর্মী এসব অভিযোগনামা লগ বইতে লিপিবদ্ধ করে থাকেন। গত দুই দিন দুদকে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ডাক, কুরিয়ার বা হাতে হাতে পেঁৗছানো চিঠিগুলোর খাম ছিঁড়ে ছিঁড়ে তাতে লেখা বিষয় উল্লেখ করে লগ বইতে লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। অধিক গুরুতর অভিযোগের অনেক চিঠিই এখান থেকে লগ বইতে না তুলে একজন ক্লার্কের টেবিলে পাঠানো হয়।
তিনি গুরুত্ব অনুধাবন করে কোনোটা খাতায় লিপিবদ্ধ করেন, আবার কোনো কোনো চিঠি ফেলে দেন টেবিলের পাশে রাখা ঝুড়িতে। বিকালে ঝুড়িতে পড়া সব অভিযোগগু গুদামে ফেলার আগে একটি সিন্ডিকেটের হাতে গিয়ে পেঁৗছে। তারা প্রতিটি চিঠি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পাঠ করার পর নিজেদের সুবিধা মতো ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। সেখানেও টাকা কামানোর আরেকটি ধান্ধাবাজি চলে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এর আগে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার রূপরেখার অংশ হিসেবে জনসাধারণের অভিযোগনামা যথাযথ গুরুত্বে সুরাহা করার নিমিত্তে দেশের সব দফতর অধিদফতরসমূহে সিটিজেন চার্টার নিশ্চিত করা হয়।
এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমিয়ে আনাসহ নির্ধারিত কর্মকর্তার কাছে গিয়ে সব সেবা নিশ্চিত করার সহায়তা পাবারও সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু একেকটি মন্ত্রণালয়ে সিটিজেন চার্টার যথা নাগরিক সেবা যথাযথভাবে পাওয়ার সুবিধার্থে মাত্র ২/৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিযুক্ত করায় তারা রীতিমতো হাঁফিয়ে ওঠেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো বিশাল শাখা প্রশাখা, অসংখ্য দফতর সম্পৃক্ত মন্ত্রণালয়ের সিটিজেন চার্টারের সেবা নিশ্চিত করতে একজন সিনিয়র সহকারী সচিব এবং একজন সাঁট মুদ্রাক্ষরিক ও একজন এমএলএলএসকে নিয়োজিত রাখা হয়েছে। ফলে জনবলের অভাবে তারা অনেক সেবা নিশ্চিত করা থেকে ব্যর্থ হন। জনগণের চাওয়া-পাওয়া ও অভিযোগনামার প্রতিকার প্রদানে কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্থাপিত অভিযোগ সেলটি সবচেয়ে বেশি তৎপর থাকে বলে জানা গেছে।
সেবা সুবিধা পাওয়া জনসাধারণ সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ সেলে চিঠি পাঠানো মাত্র তার প্রাপ্তি স্বীকার করার মতো সৌজন্যতা দেখাতেও কার্পণ্য নেই। সময় সময় এসবের অগ্রগতি জানানোরও নজির রয়েছে। একজন উপ-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে ৯ জন কর্মকর্তা কর্মচারীর সমন্বয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্থাপিত অভিযোগ সেলটি পরিচালিত হয়। এই সেলে গত পাঁচ বছরে সরাসরি পাঠানো অভিযোগনামার সংখ্যা ২০ সহস াধিক। তবে অবহিতকরণের মতো চিঠির সংখ্যা লক্ষাধিক বলে জানা গেছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।