আমার চোখে ঠোটে গালে তুমি লেগে আছো !!
নিউমার্কেট আমার কোনদিনই ভালে লাগে নি বিশেষ করে ছুটির দিন গুলোতে এখানে এলে মনে হয় দমবন্ধ হয়ে আসছে ।
এতো মানুষ !
কিন্তু ফাজিল রিসি আর আদনান আমাকে বেছে বেছে এই ছুটির দিন গুলোতেই এখানে নিয়ে আসবে !
আরে বাবা তোদের মার্কেটে ঘোরার শখ হয়েছে তোরা যা ! আমাকে কেন টানিস ?
আমার এই কথা শুনে রিসি চোখ কপালে তুলে বলে
-আরে কি বলিস দোস্ত তুই হইলি আমাদের প্রানের দোস্ত তোরে ছাড়া আমরা কোথাও যাই বল !
কথা খানিকটা সত্য !
মোটামুটি বাধরুম আর ঘুমানো ছাড়া সব জায়গাতেই আমরা তিনজন একসাথেই ঘোরাঘুরি করি !
আদনান বলল
-তার উপর আমাদের দুপুরের খাবার বিল টা তুই ছাড়া আর কে দিবে বল !
এটাও সত্য !!
আমি বিরক্ত মুখে ওদের পিছন পিছন হাটতে থাকি ! এদিক ওদিক চোখ যাচ্ছে নানান রকমের মানুষ দেখতে পাচ্ছি । সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত ! আমার দিকে কেউ দেখছে কিন্তু আমি তাদেরকে দেখছি ! হাটতে হাটতেই একটা দোকানের দিকে চোখ আটকে গেল !
আপনা আপনি আমার বুকের স্পন্দন বেড়ে গেল বহু গুনে ! পা থেমে গেল দোকানটির সামনে ! কতক্ষন পরে চোখের পলক পড়লো বুঝতেই পারলাম না !
একবার মনে হল নিজের চোখে যা দেখছি তা মনে হয় ভুল !
চার বছর !
হ্যা মোটামুটি চার বছর তো হবেই !
নিশি কে দেখলাম চার বছর পরে !
নিশি তো ?
আবারও মনের ভিতর কেমন একটা সন্দেহ দেখা দিল ! সেই চোখ সেই মুখ কিন্তু নিশি কিনা বুঝতে পারছি না ! টি-শার্টের দোকানে নিশি কয়েকটা শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে চুপচাপ !
ওর পরেন কালো ল্যাগিংসে সাথে কালো কামিজ ! কালো ওড়না ! ফর্সা চেহারার সাথে কালো টা একেববারে যেন ফুটে আছে !
নিশি তখনও প্রায় সময়ই কালো রংয়ের পোষাক পরতো ! ওটা ওর পছন্দের একটা রং আমি জানি !
আমি কেবল তাকিয়েই রইলাম ! একবার মনে হচ্ছে আরও একটু কাছে গিয়ে জানতে চাই ও নিশি কি না কিন্তু ঠিক ভরশা হচ্ছে না ! কিন্তু মন বলছে মেয়েটা অবশ্যই নিশি ! আমি কিছু না বলে চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম । বুকের ভেতরকার লাফালাফি চলছেই !
মেয়েদের মনে হয় একটা সহজজাত ক্ষমতা থাকে যে কেউ তাদের দিকে কিছুক্ষন তাকালেই তারা সেই বুঝতে পারে ! নিশিও এক সময় বুঝতে পারলো যে ওর দিকে কেউ তাকিয়ে আছে !
চোখ ঘুরাতেই আমার দিকে ওর চোখ পরলো ! এবং আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম সেখানে এক রাশ বিশ্ময় ! নিশিও আমাকে অবাক বিশ্ময় নিয়ে দেখছে ! যেন ও নিজের আমাকে দেখে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না !
এবার মনে হয় নিশ্চিত হওয়া যায় ! এই টাই নিশি !
অবশ্যই নিশি !
আমার ধরনা কে আরও পাকা করে দিয়ে নিশি নিজেই আমার দিকে এগিয়ে এল ! কথা বলল ও নিজেই প্রথমে !
-অপু ? মাই গড ! সত্যিই তুমি অপু তো ?
স্কুলে থাকতে নিশিকে কুমড়া বলে ক্ষ্যাপাতাম ! অনেক মোটা ছিল তো তাই ! নিশি অবশ্য প্রথম প্রথম অনেক রাগ করতো ! কিন্তু পরে আর রাগতো না ! তবে মোটা হলেও নিশির চেহারাটা বেশ চমৎকার মায়া মায়া ছিল !
আমার মনে আছে একদিন স্কুলে খুব রাগিয়েছি ! দুষ্টামীটা এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে নিশি একেবারে কেঁদে দিল ! বাথরুমে গিয়ে সেই কান্নায় পানি দিয়ে এল ! স্যার চলে আসাতে সবার চোখ সেদিকে না গেলেও আমার চোখ এড়ালো না ! নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগলো ! আমার কারনে একটা মেয়ে কাঁদবে এটা ভাবতেই কেমন যেন নিজকে খানিকটা অপরাধী মনে হল !
বিকেল বেলা ওদের বাসায় হাজির হলাম ! আমাকে দেখে সেদিন নিশি বেশ অবাক হয়েছিল !
ওকে যখন সরি বললাম তখন আবারও ওর চোখে পানি দেখতে পেলাম ! আনন্দের পানি ! পকেটে করে আনা চকলেটের প্যাকেট টা পেয়ে বাচ্চা মেয়েদের মত খুশি হয়ে গেল ! সেই থেকে আমাদের বন্ধুত্ব শুরু !
তবে সেই বন্ধুত্ব কেমন করে যেন অন্য দিকে চলে গেল ! বুঝতেই পারি নি মেয়েটা কখন মনের ভিতর একটা স্থান করে নিয়েছিল ! কিন্তু বলি বলি করেও বলতে পারি নি ! এসএসসি পরীক্ষার পরে একদিন মনের কথা গুলো ছোট্ট করে লিখে ওকে দিলাম !
লিখেছিলাম রাজী না হলে যেন ও উত্তর না দেয় ! আমি অপেক্ষা করবো ! তবুও যেন ও মানা না করে ! কোন দিন এটার কথা ওর কাছে জানতেও চাইবো না !
ভেবেছিলাম উত্তর আসবে ! কিন্তু আসেন নি ! কোন খবরও না ! এক সপ্তাহ পরে খোজ পেলাম ওরা নাকি চলে যাচ্ছে ! ওর বাবার সরকারী চাকরী ছিল !
যাওয়ার দিন দেখা করতে গেলাম ! দুরেই দাড়িয়ে ছিলাম ! কাছে যাই নি ! নিশিও আমাকে দুর থেকে দেখলে ও কাছে আসে নি । ট্রাক টা যখন ছেড়ে দিল আমি তাকিয়েই ছিলাম ওটার দিকে ! বারবার মনে হচ্ছিল নিশি একবার হলেও জানালা দিয়ে মুখ বের করে আমার দিকে তাকাবে !
কিন্তু নিশি সেদিন তাকাই নাই ! আমি কেবল অপেক্ষা করে গেছি ! হয় তো আজও অপেক্ষা করছি !
নিশির এখন আর সেই কুমড়া নেই ! এই চার বছর পরে ওকে তো ঠিক মত ই চেনাই যাচ্ছে না ! এতো স্লিম কিভাবে হল ও !
আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম
-তুমি সত্যিই নিশি তো ?
-কেন ? বিশ্বাস হচ্ছে না ?
-সত্যিই কথা আসলেই হচ্ছে না ! তুমি তো .....।
-এই খবরদার ! এই শব্দ মুখে আনবা না !
-আচ্ছা আচ্ছা ! আনবো না !
আমার আর কিছু বলার ছিল কিন্তু পিছন থেকে কালো চশমা পরা একটা সুদর্শন ছেলে এসে হাজির ! নিশিকে উদ্দেশ্য করে বলল
-চল কাজ শেষ !
-শেষ ? আচ্ছা মিহির, এ আমার স্কুল জীবনের বন্ধু ! অপু !
মিহির সাহেব আমার দিকে কেমন একটা তাচ্ছিল্যের চোখে তাকিয়ে বলল
-হ্যালো !
আমিও বললাম
-হ্যালো !
মিহির সাহেব বলল
-এখানে আর সময় দেওয়ার উপায় নেই ! চল ! দেরি হয়ে যাচ্ছে ! শো শুরু হয়ে যাবে !
আমার মনে ক্ষীন একটা সম্ভাবনা দেখা দিল যে নিশি বলবে যে মিহির আজকে না হয় না যাই ! অনেক দিন পরে অপুর সাথে দেখা ! ওর সাথে কিছুক্ষন থাকি !
কিন্তু আমার সেই আশায় নিরাশায় পরিনিত হতে সময় লাগলো না !
নিশি বলল
-আচ্ছা চল !
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আজকে তাহলে আসি । হাতে সময় নেই ! অন্য কোন দিন তোমার সাথে কথা হবে ! তোমার মোবাইল নাম্বারটা দেও তো !
আমি মোবাইল নাম্বার দিলাম ! নিশি নিজের মোবাইলে নাম্বার তুলে আমাকে একটা কল দিল ! সেভ করে নিতে বলল ! তারপর হাটা দিল মিহিরের সাথে ! আমি আবারও তাকিয়ে রইলাম ! ওদের দুজনের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম ! এমন ভাবে ওরা হাটছিল মনে হচ্ছি যেন ওরা বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড !
হতেই পারে ! আমি আবারও বোকার মত এটা আশা করে বসে রইলাম নিশি আজকে অন্তত একবার ফিরে চাইবে !
কিন্তু আজকে নিরাশ হতে হল ! ভীড়ের ভিতর ওরা হারিয়ে গেল !
-এই দাড়িয়ে আসিস ক্যান ?
পেছন থেকে রিসির আওয়াজ শুনতে পেলাম !
-এমনি !
-চল !
-হুম চল !
মোবাইল থেকে নিশির নাম্বারটা মুছে ফেললাম ! মনে মনে বললাম ওর সাথে আমার দেখাই হয় নি !
-কি ব্যাপার জনাব ? কথা এমন শোনাচ্ছে কেন ?
ভেবেছিলাম নিশি হয়তো আমাকে আর ফোন করবে না ! ও তো অনেক ব্যস্ত ! কিন্তু রাতের বেলাতেই নিশির ফোন এসে হাজির ! আমি নাম্বার মুছে দিয়েছিলাম তবুও হ্যালো ডাক টা চিন্তে অসুবিধা হল না !
-না কিছু না !
-ভাল আছো তুমি ?
-হুম ! থাকবো না কেন ?
-গার্লফ্রেন্ড হয় নি ?
-হুম ! কেন হবে না ! আর কিছুক্ষন থাকলে তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতাম !
কিছুক্ষন কোন কথা হয় না ! নিশি চুপ করে থাকে আমিও ! একটু পরে আমি বলি
-মিহির কি তোমার বয়ফ্রেন্ড ?
-কেন ?
-না এমনি জানতে চাইলাম !
নিশি বলল
-নাহ ! আমি অন্য কাউকে ভালবাসি !
-কাকে ?
আবারও কিছু্ক্ষন নিরবতা ! তারপর নিশি বলল
-সে আমার উত্তরের অপেক্ষাতে আছে !
কথাটা শুনে এবার আমি চুপ করে গেলাম ! কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না !
নিশি বলল
-কিন্তু মনে হচ্ছে সে আর অপেক্ষা করে নেই !
-নাহ ! সে অপেক্ষা করে আছে ! সারা জীবন অপেক্ষা করে থাকবে !
কোন দিন ভাবি নি আবার কোন দিন নিশির সাথে এক সাথে কোথাও বসে গল্প করতে পারবো ! আমি নিজের ভেতর কেমন একটা আনন্দ অনুভব করতে পারি !
আমরা দুজনেই চুপ করে বসে রয়েছি ! দুজনেই ভাবছি কি কথা দিয়ে শুরু করবো ! আমিই প্রথমে ঠিক করলাম কি বলবো ! কিন্তু যখন মুখ খুলতে যাবো তখনই নিশির ফোন বেজে উঠলো !
আমি ওর কথা গুলো শুনতে পাচ্ছি । ফোনে সম্ভবত মিহির সাহেব !
-হ্যা !
-(নিরবতা)
-আরে তোমাকে কেন সব কথা বলতে হবে ? আমি কারও সাথে দেখা করতে গেলে তোমার কাছে কেন বলতে হবে ?
-(নিরবতা)
-দেখো মিহির ! আমি একটু ব্যস্ত আছি ! পরে কথা বলি !
ফোন রেখে নিশি বলল
-সরি !
-না ঠিক আছে ! মিহির ?
-হুম !
-ছেলেটা মনে হয় তোমাকে অনেক পছন্দ করে !
-হুম ! আমি জানি !
আমি কথা হারিয়ে ফেললাম । কি বলতে গিয়ে কি বললাম !
নিশি নিজের ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে দিল ! কাগজটা খানিকটা মলিন আর হলদে হয়ে গেছে ! অনেক দিন আগের কাগজ দেখলেই বোঝা যায় ! আমি হাতে নিতে নিতে বলল
-সাবধান ! চিনতে পারছো ?
কাগজ খুলে খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম ! এটা তো আমার দেওয়া সেই চিঠিটা যার কোন উত্তর আসেনি !
মুখ দিয়ে কেবল একটা কথা বের হল
-তুমি এখনও রেখে দিয়েছো ?
-এটা ফেলার জিনিস ?
-মাইগড !
-আরও কিছু আছে ?
-কি !
নিশি এবার আরেকটা কাগজ বের করে দিল ! হলুদ রংয়ের একটা খাম ! তবে রংটা কেবল ঘোলাটে হয়ে গেছে ! বোঝা যাচ্ছে এটাও অনেক দিন আগেই লেখা !
খামটার মুখ বন্ধ !
আমি বললাম
-এটা কি ?
-তোমার চিঠির জবাব !
-কি ? তখন কেন দেও নি !
এই প্রশ্নটার উত্তরটা দিতে নিশি একটু সময় নিল ! তারপর বলল
-চিঠি আমি সেদিনই লিখেছিলাম ! কিন্তু দেই নি !
-কেন ?
-নিজেকে সেদিন রাতের বেলা যখন আয়নায় দেখছিলাম তখন মনে হল ....।
নিশি কথা শেষ করলো না !
-মানে কি এসবের ?
-হয়তো কোন মানে নেই ! তুমি বুঝবে না !
-নিশি .....!
-যাক ! আজকে দিচ্ছি ! মন টা কিন্তু আমার সেই রকমই আছে ! তোমাকে অনেক দিন অপেক্ষা করিয়েছি তাই না ?
আমি খামটা হাতে নিয়ে বসে রইলাম !
নিশি বলল
-বাসায় গিয়ে খুলবে কেমন ? আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকবো ! অবশ্য তুমি চাইলে চার বছর পরেও আমাকে ফোন করতে পারো ! আমি অপেক্ষা করবো !
নিশিকে যখন রিক্সায় তুলে দিলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা ! আজকে কেন জানি মনে হল নিশি বারবার তাকাবে ! আমি দাড়িয়ে রইলাম ওর পিছনে ফিরে তাকানোর অপেক্ষায় !
ঠিক ত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় নিশি ফিরে তাকালো ! তারপর আবার !
আরেকটি বার !
আমি বুক পকেটে বহুদিনের পুরানো রংচটা হলুদ খাম নিয়ে নিশির বারবার ফিরে চাওয়া দেখতে লাগলাম !
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।