যথাযথ প্রস্তুতি, পরিকল্পনা ও সময়মতো বাস্তবায়নের উদ্যোগ না থাকায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্তত চারটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও অসন্তোষের জন্ম দিচ্ছে। নিয়োগ, পদমর্যাদা ও বেতন-ভাতা বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর করতে গিয়ে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘শিক্ষক পুল’ নির্বাচন। লম্বা ছুটিতে থাকা শিক্ষকদের স্থলে অস্থায়ীভাবে নিয়োগের জন্য পরীক্ষা নিয়ে ১৫ হাজার তরুণকে নির্বাচন করা হয় দুই বছর আগে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
ইতিমধ্যে এঁদের অনেকের চাকরির বয়স শেষ হয়ে গেছে।
২৩ হাজার রেজিস্টার্ড বিদ্যালয়কে সরকারি করা হয়েছে। কিন্তু এসব বিদ্যালয়ের প্রায় এক লাখ শিক্ষক সরকারি স্কেলে বেতন পান না।
আবার রেজিস্টার্ড বিদ্যালয়ের জন্য নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ এবং প্যানেলভুক্ত প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষককে চাকরিতে নেওয়া হচ্ছে না। পাঁচ বছরের মধ্যে উপজেলায় পদ শূন্য হওয়া সাপেক্ষে তাঁদের নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল।
বিদ্যালয় সরকারি করার পর এখন তাঁদের নেওয়া হচ্ছে না। অথচ এর মধ্যে অনেকেরই চাকরির বয়স পার হয়ে গেছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদমর্যাদা বাড়ানো হয়েছে। তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তার মর্যাদা দেওয়া হলেও বেতন স্কেল সমমানের করা হয়নি। ফলে বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে।
আবার আগে সহকারী শিক্ষকেরা প্রধান শিক্ষকদের এক
ধাপ নিচের স্কেলে বেতন পেতেন। নতুন সিদ্ধান্তে তাঁদের বেতন বাড়ানো হলেও তা প্রধান শিক্ষকের চেয়ে তিন ধাপ নিচে নেমে গেছে।
এ অবস্থায় শিক্ষক পুলের জন্য নির্বাচিত শিক্ষকেরা আন্দোলনে নেমেছেন। সহকারী শিক্ষকেরাও নতুন বেতন স্কেলকে ‘বৈষম্যমূলক’ আখ্যা দিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। রেজিস্টার্ড থেকে সরকারি হওয়া প্রায় এক লাখ শিক্ষকও সরকারি হিসেবে বেতন না পেয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ।
শিক্ষক পুলে আটকা ১৫ হাজার তরুণ: শিক্ষকেরা প্রশিক্ষণ, মাতৃত্বকালীনসহ অন্যান্য ছুটিতে থাকলে যাতে শিক্ষা কার্যক্রমে শূন্যতা দেখা না দেয়, সে জন্য কয়েক বছর ধরে আলোচনার পর ২০১২ সালে শিক্ষক পুল করে সরকার। কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছুটিতে গেলে সংশ্লিষ্ট উপজেলার পুলভুক্ত শিক্ষক তাঁর যোগদান পর্যন্ত ওই পদে কাজ করবেন। স্থায়ী শিক্ষক ছুটি শেষে কাজে যোগ দিলে অস্থায়ী শিক্ষক চলে আসবেন।
এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১২ সালের আগস্টে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের সময় ছুটিজনিত শূন্য পদে অস্থায়ীভাবে নিয়োগের জন্য শিক্ষক পুলে ১৫ হাজার ১৯ জন প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
এমনকি এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য একটি নীতিমালাই করতে পারেনি মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গড়ে ১০ শতাংশ শিক্ষক বিভিন্ন রকম ছুটিতে থাকেন। এই হিসাব অনুযায়ী পুলের শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব করা হলেও অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাতে আপত্তি জানায়। ওই দুই মন্ত্রণালয় বলছে, শিক্ষক পুল থেকে দিনে ২০০ টাকা করে মাসে ছয় হাজার টাকার ভিত্তিতে অস্থায়ীভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া যাবে, স্থায়ীভাবে নয়। কয়েক দিন আগে এই মতামত পেলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা মনে করছেন, যদি এ শিক্ষকদের অস্থায়ীভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়, তা হলে কয়েকটি সমস্যার আশঙ্কা আছে। প্রথমত, চাকরির নিশ্চয়তা না থাকায় অস্থায়ীতে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা ঠিকমতো পাঠদান না-ও করতে পারেন। কেউ কেউ অন্য চাকরি নিয়ে চলে যেতে পারেন। আবার কিছুদিন পর তাঁরা স্থায়ী নিয়োগের জন্য আন্দোলনেও নামতে পারেন। এতে পুরো প্রক্রিয়াই অনিশ্চিত হয়ে যাবে।
পুলভুক্ত কয়েকজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের প্রতিশ্রুতিতে তাঁরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু নিয়োগ না হওয়ায় এখন চরম হতাশায় ভুগছেন। অনেকের চাকরির বয়স চলে যাওয়ায় মানবিক দিক বিবেচনা করে হলেও নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব কাজী আকতার হোসেন বলেন, মন্ত্রণালয় এটা করতে চায়। কিন্তু কিছু জটিলতার কারণে এগোনো যাচ্ছে না।
তবে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চলছে।
রেজিস্টার্ড থেকে সরকারি, কিন্তু এক লাখ শিক্ষক বেতন পান না: সম্প্রতি ২৩ হাজার রেজিস্টার্ড বিদ্যালয়কে সরকারি করা হয়। কিন্তু সব বিদ্যালয়ের প্রায় এক লাখ শিক্ষক এখনো সরকারি স্কেলে বেতন পাচ্ছেন না। এ নিয়েও তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। বিভিন্ন সময় তাঁরা এ নিয়ে বিবৃতি আসছেন।
আবার ২৩ হাজার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সবাইকে স্বপদে রেখে দেওয়া হয়েছে। আগের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, অসংখ্য প্রধান শিক্ষক আছেন, নির্ধারিত শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। অনেকে মাত্র এইচএসসি পাস। অথচ স্নাতক পাস অসংখ্য সহকারী শিক্ষক আছেন, যাঁরা পদোন্নতি পাচ্ছেন না। এ জন্য শিক্ষকদের থানাওয়ারি জ্যেষ্ঠতার (গ্রেডেশন) তালিকা করে তাঁদের মধ্যে থেকে জ্যেষ্ঠদের নিয়োগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন শিক্ষকদের একটা অংশ।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সরকারি হওয়া রেজিস্টার্ড বিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষকের নির্ধারিত যোগ্যতা নেই, তাঁদেরকে তিন বছরের মধ্যে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
বঞ্চিত হলেন রেজিস্টার্ড স্কুলে নিয়োগের জন্য উত্তীর্ণরা: সরকারের সব নিয়মকানুন মেনে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। তখন বলা হয়েছিল, উত্তীর্ণ প্রার্থীদের পর্যায়ক্রমে পাঁচ বছরের মধ্যে নিয়োগ দেওয়া হবে। এর মধ্যে কিছুসংখ্যক প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার পর ওই সব বিদ্যালয় সরকারীকরণের ঘোষণা চলে আসে। বাকিদের নিয়োগ থেমে যায় এবং তাঁদের নিয়োগ না দিয়ে নতুন করে নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু আগের নির্বাচিত ব্যক্তিদের ভবিষ্যৎ কী হবে, তার কোনো স্পষ্ট ঘোষণা পাওয়া যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে সচিব কাজী আকতার হোসেন বলেন, প্রার্থীদের যোগ্যতা একই রকম হলেও যখন ওই সিদ্ধান্ত হয়েছিল তখন বিদ্যালয়গুলো নিবন্ধিত ছিল। পরে বিদ্যালয়গুলো সরকারি হওয়ায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো করেই পরীক্ষা নিতে হচ্ছে।
মর্যাদা বেড়েছে, বেতন নিয়ে অসন্তোষ: ৯ মার্চ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের পদমর্যাদা এক ধাপ বাড়িয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী করা হয়। পাশাপাশি সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেলও এক ধাপ উন্নীত করা হয়।
প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা দেওয়া হলেও মূল বেতন ধরা হয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের জন্য ছয় হাজার ৪০০ টাকা এবং প্রশিক্ষণবিহীনদের পাঁচ হাজার ৯০০ টাকা। কিন্তু সরকারের দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের মূল বেতন শুরু হয় আট হাজার টাকা দিয়ে।
আর সহকারী শিক্ষকেরা মনে করেন, সাড়ে তিন লাখ সহকারী শিক্ষককে ‘ঠকানো’ হয়েছে। একাধিক সহকারী শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন সহকারী শিক্ষকেরা প্রধান শিক্ষকদের এক ধাপ নিচের স্কেলে বেতন পেয়ে আসছিলেন। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সহকারী শিক্ষকদের বেতন বাড়ালেও তা প্রধান শিক্ষকদের চেয়ে তিন ধাপ নিচে চলে গেছে।
এটা বৈষম্যমূলক।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সহকারী শিক্ষকদের মূল বেতন স্কেল প্রশিক্ষণবিহীনদের চার হাজার ৭০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা বাড়িয়ে চার হাজার ৯০০ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের চার হাজার ৯০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা বাড়িয়ে পাঁচ হাজার ২০০ টাকা করা হয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের একটি সংগঠন বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজ বেতনবৈষম্য কমানোর দাবিতে কর্মবিরতিসহ কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ১ এপ্রিল থেকে কর্মসূচি শুরু হবে। সংগঠনটির সদস্যসচিব শাহিনুর আল আমীন বলেন, এটা শুধু বৈষম্যমূলক নয়, সংবিধানেরও লঙ্ঘন।
সহকারী শিক্ষকদের সমস্যাটি শিগগিরই সমাধান হয়ে যাবে দাবি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব বলেন, এটা কীভাবে করা যায়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
জানতে চাইলে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, েযহেতু সিদ্ধান্ত হয়েছে সেহেতু বোঝা যায়, এসব বিষয়ে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে বাধা কোথায় বুঝতে পারছি না। ’ তিনি বলেন, ভালো উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষোভ প্রশমন করা জরুরি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।