আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কংগ্রেস কি সত্যিই চরম বিপর্যয়ের মুখে?

ভারতের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল কংগ্রেস কী আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন? গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সমীক্ষা ও জরিপ এমন ধারণাই দিয়েছে এবং বলেছে, এপ্রিল-মে মাসের ভোট পর্বে দলটি ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে। কেউ কেউ বলছে, এই ব্যর্থতা হবে খুবই হতাশাব্যঞ্জক এবং দলটির আসন সংখ্যা খুবই কম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ২০০৯ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস ৫৪৩ আসনবিশিষ্ট লোকসভায় পেয়েছিল ২১৬টি আসন। মিত্রদের সাহায্যে প্রয়োজনীয় ২৭২ সদস্যেরও বেশি সদস্যের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। এর আগে ২০০৪ সালের নির্বাচনে দলটির আসন ছিল কম।

তা সত্ত্বেও কংগ্রেস তৎকালীন শাসক বিজেপি থেকে বেশি আসন পেয়েছিল এবং সরকার গঠন করেছিল। দলটির নেতৃত্বে ইউপিএ মোর্চা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে এখন কঠিন নির্বাচনের সম্মুখীন। কত আসন পেতে পারে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী সংগঠনটি? অধিকাংশ বিশ্লেষকই মনে করছেন, আসন সংখ্যা এবার ১০০ এর নিচে নেমে আসবে। আবার অনেকের আশঙ্কা- এই সংখ্যা অবিশ্বাস্যভাবে ৫০-৬০ আসনে নেমে আসতেও পারে। যদি তাই হয়, তাহলে কংগ্রেসের জন্য সেটা হবে চরম বিপর্যয় ও লজ্জাকর।

দলটি এবারের নির্বাচনে যে বেশ খারাপ করবে- এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম, যদি না অপ্রতাশিতভাবে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনী হওয়া দলের অনুকূলে যায়। অবশ্য, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ।

কংগ্রেস প্রধান সোনিয়া গান্ধী, সহসভাপতি রাহুল গান্ধী এবং প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং মানতে নারাজ যে, দলটি নির্বাচনে খারাপ করবে। তারা মনে করেন, বিভিন্ন জরিপ ভুল প্রমাণিত করেই কংগ্রেস আগের গৌরব বজায় রাখবে। গত বুধবার নয়াদিলি্লতে নির্বাচনী মেনিফেস্টো ঘোষণা করে তারা বলেন, ভারতের জন্য কংগ্রেসই সর্বোত্তম দল এবং সেটা ভোটে আবার প্রমাণিত হবে।

কিন্তু কথা হলো সোনিয়া-রাহুল-মনমোহনের কথা কতদূর সত্য হবে? এটা সত্য যে, ভারতের মতো ১২০ কোটি মানুষের বহু ভাষা, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক বৈপরীত্যের দেশে কংগ্রেসের মতো দল তুলনামূলকভাবে অন্যান্য বড় দল থেকে অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা। সে কারণেই ২০০৪ এবং ২০০৯ সালে দেশটির 'কোয়ালিশন কালচারের' সময়েও কংগ্রেস ক্ষমতায় আসতে সমর্থ হয়েছে। ২০০৪ সালে বিজেপির নেতৃত্বে তৎকালীন শাসন এনডিএ মোর্চার ‘SHINIG INDIA’ অর্থাৎ 'স্বর্ণালি ভারত' স্লোগানে জনগণ বিভ্রান্ত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ও বিজেপি নেতৃবৃন্দ আগাম নির্বাচন দিয়েছিলেন এই আশায় যে, সেটা তাদের জন্য সহায়ক হবে। কিন্তু সেটা 'বুমেরাং' হয়েছিল এবং সরকারকে সরে যেতে হয়েছিল।

অবশ্য সে সময় খুব কম জরিপই বলেছিল যে, কংগ্রেস জয়ী হবে এবং সরকার গঠন করবে, তা সত্ত্বেও দলটিই সর্বাধিক আসন পেয়েছিল। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ দাবি করছেন, এবারও এমনই ফলাফল হবে এবং সমীক্ষা ও জরিপ ভুল প্রমাণিত হবে।

আসলেই সেটা হতে পারে? অর্থাৎ ফলাফল দলটির অনুকূলে যাবে? নাকি অনেকের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রধান বিরোধী দলের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদির পক্ষে যাবে। যদিও কোনো দলই সরাসরি জয় পাবে না বলেই নিশ্চিত করে বলা যায়। অর্থাৎ কোনো দল কিংবা মোর্চা 'ম্যাজিক সংখ্যা' ২৭২টি আসন পাবে না বলেই ধারণা করা যাচ্ছে।

তবে কাছাকাছি যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে মোদির মোর্চা এনডিএর এবং সে কারণে মোদিকেই আগামী দিনের ভারতের সরকারপ্রধান হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ মোর্চা ও কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ অাঁতাতের বাইরেও অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি এবার সরকার গঠনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এসব ছোট ও আঞ্চলিক দলের প্রায় সবাই দুই বড় দল অর্থাৎ কংগ্রেস ও বিজেপিবিরোধী। কিন্তু তারাও একত্রিত হতে পারছে না নেতৃত্ব ও কিছুটা আদর্শগত কারণে। এসব দলের নেতা-নেত্রীরা তাদের স্বীয় রাজ্যে বেশ প্রভাবশালী এবং সেসব রাজ্যে তাদের দলই বেশি আসন পাবে।

বিজেপি কিংবা কংগ্রেস নয়। উত্তর প্রদেশে শাসক সমাজবাদী পার্টি ও এর নেতা মুলায়েম সিং যাদব ও একই রাজ্যে বিরোধী ভূজন সমাজ পার্টি ও এর নেত্রী মায়াবতী, পশ্চিমবঙ্গে 'তৃণমূল' কংগ্রেস ও দলের নেত্রী মমতা ব্যানার্জি, তামিলনাড়ুতে জয়রাম জয়লতিতা ও বিহারে জনতা দল ও এর নেতা নীতিশ কুমার- এরা সবাই দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনা লালন করছেন। তাদের ধারণা, 'কোয়ালিশন কালচারের' কারণে যখন কোনো বড় দল সরকার গঠনে তাদের সাহায্য চাইবে, তখন দরকষাকষির অংশ হিসেবে এসব দল ও নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়ে যেতে পারেন; যদিও তাদের আসন সংখ্যা বড় হবে না। এভাবেই ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এইচডি দেবগৌড়- যার জনতা দলের (এস) আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ৪১। তিনি ছিলেন দক্ষিণের কর্নাটক রাজ্যের।

তাই ফলাফলের ওপরই নির্ভর করবে সরকার গঠনের সমীকরণ।

কথা হলো কংগ্রেসের অবস্থা এতটা বেহাল মনে করার কারণ কি? যে দলটি ভারতের খ্যাতনামা নেতৃবৃন্দের সংগঠন এবং ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৪৭ সাল থেকে একটানা অনেক বছর শাসন করেছে, সেই সংগঠনের এই অবস্থায় উপনীত হওয়ার কারণ কি? অবশ্যই এর কারণ রয়েছে, যদিও এটাও হতে পারে যে, কংগ্রেস হয়তো চরম বিপর্যয় এড়াতেও পারে। তবে বিপর্যয়ের যে সম্মুখীন, সে বিষয়ে সন্দেহের সুযোগ কম।

১৯৭৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস পর্যুদস্ত হয়েছিল এবং জনতা দল ক্ষমতায় এসেছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীন দেশ হিসেবে উদ্ভব এবং ভারতের ভূমিকার জন্য তখন কংগ্রেস সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে।

সেই অভূতপূর্ব সাফল্যে কংগ্রেস সরকার আরও অনেক বছর হয়তো ক্ষমতায় থাকতে পারত। কিন্তু ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থা, রাজনৈতিক নির্যাতন ও ইন্দিরার কনিষ্ঠপুত্র সঞ্জয়ের বাড়াবাড়ির জন্যই দলটি ১৯৭৭ সালে পরাজিত হয়। তখন ভারতের সর্বোদয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণসহ অনেকেই সেই সরকারের জরুরি অবস্থায় ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি এবং নির্যাতনের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং রায়বেরেলিতে রাজ নারায়ণের কাছে হেরে যান এবং দলের হেভিওয়েট দেশরক্ষা মন্ত্রী বংশীলাল হরিয়ানা থেকে এবং তথ্যমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুল্কা মধ্য প্রদেশ থেকে পরাজিত হন। এটা অবশ্য ভারতের গণতন্ত্রে সম্ভব।

ক্ষমতাসীনরা নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পদ্ধতিতে গণরায়ে সহজেই হেরে যেতে পারেন যদিও শাসক দলের অধীনে নির্বাচন হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে গণতন্ত্র সেভাবে শিকড় গাড়তে পারেনি এবং সে কারণে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে সংশয় বিদ্যমান।

কিন্তু অনেক দলের সমন্বয়ে গঠিত 'জনতা দল' বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনে আবার বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে আসে ১৯৭৯-৮০ এর নির্বাচনে। আমার সুযোগ হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর ১২ নং 'ওয়েলিংডন ক্রিসেন্ট' বাসভবনে তার একটি সাক্ষাৎ নেওয়ার। তিনি বলেছিলেন এবং স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি, জরুরি অবস্থার সময় একটি গণতান্ত্রিক দেশে তার সরকারের কর্মকাণ্ডের অনেক কিছুই সঠিক ছিল না।

যাই হোক, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৮৪ সালে অমৃতসরে শিখদের স্বর্ণমন্দিরে সরকারের আক্রমণের প্রতিশোধে ইন্দিরা গান্ধী শিখ দেহরক্ষীদের দ্বারা নিহত হন।

ইন্দিরা আবার কংগ্রেসকে শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করিয়ে গিয়েছিলেন এবং সে কারণে পুত্র রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে 'বোফর্স' অস্ত্র ক্রয়ের কেলেঙ্কারি এবং আরও কিছু কারণে আবার কংগ্রেস নির্বাচনে হেরে যায়। ১৯৯১ সালে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রাজীব গান্ধী তামিলনাড়ুতে শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহীদের দ্বারা নিহত হলে কংগ্রেস মূলত সেই মৃত্যুজনিত সহানুভূতির কারণে নির্বাচনী জয় পেয়ে আবার ক্ষমতায় আসে। প্রধানমন্ত্রী হন নরসীমা রাও।

কিন্তু তার শাসনের সময়টা খুব সফল ছিল না এবং কংগ্রেস ক্ষমতা হারায়। এ সময়েই অযোধ্যায় 'বাবরী মসজিদ' ধ্বংস হয় যদিও কংগ্রেস উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় ছিল না। তবে কেন্দ্রে অবশ্যই ছিল।

নরসীমা রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বে কংগ্রেস ক্ষমতা হারায় এবং দলের সভাপতি হিসেবে সীতারাম কেশরিও কোনো দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেননি। তখন আবার দলের নেতা-কর্মীরা ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবার 'নেহরু-গান্ধী'র সদস্য সোনিয়া গান্ধীর প্রতি রাজনীতিতে আসার অনুরোধ জানায়।

রাজনীতিতে অনাগ্রহী সোনিয়া সম্মত হন এবং পরে পুত্র রাহুলকে কংগ্রেসে সম্পৃক্ত করেন। মাতা-পুত্র শুরুতে রাজনীতিতে কোনো ম্যাজিক টাচ না দেখাতে পারলেও ২০০৪ সালের নির্বাচনে সফলতা দেখাতে সমর্থ হন। পরবর্তীতে ২০০৯ সালেও কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে। এবার সত্যিই কংগ্রেস কঠিন অবস্থানে বিচরণ করছে। নেহাত অভাবিত ফলাফল ছাড়া কংগ্রেসের পরিস্থিতি শোচনীয়।

দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার পারফর্ম করতে পারেনি। সবচেয়ে ক্ষতিকর হয়েছে বেশ কয়েকটি সাড়া জাগানো বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনা। কমনওয়েলথ গেমস আয়োজন, অত্যাধুনিক মোবাইল ফোনের বিশাল টাকার কেলেঙ্কারি মহারাষ্ট্রে কারগিল যুদ্ধে শহীদদের আবাসন নিয়ে দুর্নীতি, কয়লা মন্ত্রণালয়ের গুরুতর অনিয়ম এবং আরও কয়েকটি বিষয়ে জনগণ কংগ্রেসের ওপর ক্ষিপ্ত। সম্প্রতি সরকারের জন্য ইতালীয় হেলিকপ্টার ক্রয়ের ব্যাপারে সোনিয়ার প্রতিও দুর্নীতির আঙ্গুল উঠেছে। রাহুল গান্ধী নিজেকে অনেকটা ক্লিন রাখতে পারলেও বিহার, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান ও দিলি্লর বিধান সভার নির্বাচনে কোনো সাফল্য দেখাতে পারেননি।

কংগ্রেস সরকারের দুর্নীতির জন্যই আমআদমি পার্টির মতো দলের উত্থান সম্ভব হয়েছে।

অন্যদিকে, সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারে বিতর্কিত হলেও নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের সফল মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে রাহুল গান্ধীর চেয়ে অনেক এগিয়ে। এক সময়ের ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত সংখ্যালঘুরা আগের মতো আর কংগ্রেসের সঙ্গে নেই। নেতাজী সুভাষ বোস, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, কামরাজ, শংকর দয়াল শর্মার নেতৃত্বের স্বাধীন ভারতের দলটি এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। নেহরু-শাস্ত্রী-ইন্দিরার দক্ষ প্রধানমন্ত্রিত্ব এখন যেন ইতিহাস।

তবে ক্ষয়িষ্ণু হলেও কংগ্রেস এখনো বড় শক্তি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জন্য। তবে এবার চরম বিপর্যয় হতে পারে দলটির।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষক

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.