আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে শিক্ষার্থীরা!

মোরশেদুল ইসলাম তীর্থ (ছদ্ম নাম)। অতীশ দিপংকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিপলির ছাত্র। সপ্তম সেমিস্টার শেষ করেছে। তার ক্যাম্পাস রাজধানীর নয়াপল্টনে। এক সেমিস্টার শেষ হলেই তার অনার্স শেষ হবে।

তবে এর মধ্যেই সে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে। বন্ধুদের বলতে চায় না, সে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তীর্থ জানায়, অতীশ দিপংকর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপক দুর্নাম রয়েছে। মালিকানা নিয়ে রয়েছে বিরোধ। রয়েছে একাধিক ক্যাম্পাস।

এমনকি ক্যাম্পাস দখলের পাল্টাপাল্টি ঘটনাও আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয় দিতে নিজেই হীনম্মন্যতায় ভোগী। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় নিজেকে একটু ভিন্ন মনে হয়। তীর্থের মতো এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যারা নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করে। সারাক্ষণ অনুসূচনায় ভোগেন তার বিদ্যাপীঠ নিয়ে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োজিত একাধিক শিক্ষক বলেছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের সুযোগ অনেকাংশেই কম। দুই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানেও বিস্তর ফারাক আছে। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে 'মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব' তৈরি হচ্ছে। এমনকি বেশিরভাগ চাকরির ক্ষেত্রেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। প্রাইম ইউনিভার্সিটির বিবিএ শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আনিসুর রহমান রবিন বলেন, বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার যথার্থ পরিবেশ নেই।

২০ তলা ভবনের এক ফ্লোরে বিশ্ববিদ্যালয়। আর এর এক কক্ষে বিবিএ, এমবিএ বিভাগ। এমনকি পরীক্ষার খাতায় নাম লিখে গেলেও নাকি সনদ মেলে। পক্ষান্তরে বৃহদায়কার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, দলীয়করণ, সেশনজট, ধর্মঘট, আন্দোলন, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, মারামারি ও দুর্নীতিসহ আছে নানাবিধ সমস্যা। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) শিক্ষার্থী বিমল বিশ্বাস বলেন, যদিও এক ভবনে সবার ক্লাস হয়।

পরিসর ছোট। তার পরেও কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম আছে। কোথাও বললে মানুষ প্রশংসা করেন। বিমল বলেন, দেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ দুই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিবেশের মধ্যে যেমন পার্থক্য আছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের মনের ওপর এর প্রভাব পড়ে। এটা অদৃশ্যমান।

ফলে দুই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে 'মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব রয়েছেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএর শিক্ষার্থী বিপাশা বড়ুয়া বলেন, 'পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পাওয়ায় আমার অনেক বন্ধুর মাঝেই হীনম্মন্যতা তৈরি হয়েছিল। এটি পরবর্তীতে ক্ষোভে পরিণত হয়। তবে তাদের অনেকেই বলে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যা আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও তা নেই। তাদের মতে ক্লাস রুমে এসি ও মাল্টিমিডিয়া আছে, যা আমাদের নেই।

কিন্তু এসি রুমের সঙ্গে ভালো পড়াশোনার কী সম্পর্ক আছে। শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ঋতি্বকা বলেন, আমার মতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই সমাজ, রাজনীতি ও দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন না। তারা অনেক বেশি পাশ্চাত্য সংস্কৃতি পছন্দ করে। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সখ্য কম হয়। তবে এটাও ঠিক যে সম্প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে ডিগ্রি বাড়াচ্ছে।

পাবলিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মনমানসিকতা এবং শিক্ষার পরিবেশ ও সংস্কৃতির বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ত্রিপলির শিক্ষার্থী তন্নী বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার মানসিকতা এক রকম নয়। অনেকেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। পড়াশোনার পাশাপাশি কেউ ফটোগ্রাফি, কেউবা নাটক করে। তবে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানও পরিবেশ খারাপ নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও ভালো পড়াশোনা হয়।

তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পাওয়ায় অনেকের মাঝেও আক্ষেপ থাকে। আমি মনে করি নিজের মানসিকতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে মনের ওপর। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মনিরুল ইসলাম খান বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল। বিশ্ববিদ্যালয় মালিকদের বাজারমুখী প্রবণতার কারণে ওখানে জ্ঞানচর্চামূলক কার্যক্রম কম হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের চেতনার উন্নয়নও কম হয়ে থাকে।

শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিভিত্তিক ক্ষমতা অসাধারণ পর্যায়ে পৌঁছায় না। এ দিক থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার সুযোগ অনেক বেশি। আর এখানে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিও নেই। এক কথায় বলতে গেলে, এক ধরনের বাজারমুখী শিক্ষার অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এ শিক্ষা শিক্ষার্থীদের তৃপ্তি দিতে পারে না।

তাদের মাঝে এক ধরনের আক্ষেপ থাকে। শিক্ষার্থীদের মাঝে কোনো ভাবাবেগ তৈরি করতে পারে না। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশাল ক্যাম্পাসে উচ্চশিক্ষার স্বাদ পায়। যদিও অনেকে এ সুযোগ কাজে লাগায় না। তারপরও এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সুযোগ থাকে।

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. ঝুনু শামসুন নাহার বলেন, 'দুই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে চিন্তাচেতনার পার্থক্য তো আছেই। এদের উভয়ের পরিবেশই ভিন্ন। ফলে এক ধরনের মনস্তাত্তি্বক পার্থক্য তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, আমার মেয়েও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। প্রথমে আমি তার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম।

কিন্তু এখন সে ভালো চাকরি করছে। দুই-চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ দিয়ে সবার সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তিনি আরও বলেন, 'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত বঞ্চিতদের বঞ্চনার অনুভূমি। যারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা কারণে পড়ার সুযোগ পায় না তারাই বেসরকারিতে ভর্তি হয়। মূলত সমাজের উচ্চবিত্তদের সন্তানরাই সেখানে বেশি পড়ে।

এতে এক ধরনের শ্রেণী-বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। যার প্রভাব শুধু শিক্ষার্থীদের মনে নয়, পুরো সমাজের ওপরই পড়েছে। '

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.