অযোধ্যায় রাম জন্মভূমি মুক্তির আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠার সময় থেকেই সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিং যাদবের নামের আগে ‘মওলানা’ কথাটি জুড়ে গিয়েছিল। জুড়েছিল প্রধানত সংঘ পরিবার, সায় দিয়েছিল বিজেপি। সেই থেকে ক্রমে ক্রমে মুলায়মই হয়ে উঠেছেন উত্তর প্রদেশের মুসলমানদের ‘উদ্ধারকারী’। রাজ্যে যতবার ভোট হয়েছে, সমর্থনে কখনো-সখনো টাল খেলেও মুসলমানরা ক্ষোভে বা অভিমানে জোটবদ্ধভাবে একবারও মুলায়মের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকেননি। কিন্তু এবার কিছুদিন ধরেই শুনছিলাম গোটা পশ্চিম-উত্তর প্রদেশে নাকি পটপরিবর্তন ঘটতে চলেছে।
দিল্লি ছেড়ে পথে নামার পর গাজিয়াবাদ, বাগপত ও মিরাটের মুসলমানদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম, যা রটেছে তা নিছক অপপ্রচার বা উদ্ভট কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। মুজাফফরনগরে এসে দেখছি, মুসলমান মননে সত্যি সত্যিই একটা ঠোকাঠুকি চলছে। মুলায়মের দলের সঙ্গে এত বছরের আত্মিক সম্পর্ক দাঙ্গার কারণে ছিন্ন করা ঠিক হবে কি না একদিকে সেই প্রশ্ন, অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মায়াবতীর পাঁচ বছরের শাসনকালে একটাও দাঙ্গা না হওয়ার দুর্দান্ত ট্র্যাক রেকর্ড। কোনটাকে আঁকড়ে ধরবেন, তা নিয়ে দোদুল্যমানতায় ভুগছেন তাঁরা।
দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণ আরও আছে।
তার একটি হচ্ছে অভিমান। গেল বছর সেপ্টেম্বরে যে দাঙ্গাটা হলো, সেই থেকে এই ভোটের আগে পর্যন্ত মুলায়ম মুজাফফরনগরে আসার ফুরসত পাননি। ঘরছাড়া মুসলমানদের শিবিরে মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ মাত্র একবার গিয়েছেন। কিন্তু মুলায়ম, যাঁর দৌলতে এখানকার মুসলমানেরা সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে চিটে গুড়ে মাছির মতো আটকে রয়েছেন, তিনি একবারের জন্যও এমুখো হলেন না! এলেন যখন, তখন ভোটের প্রচার শেষ হতে দুদিন মাত্র বাকি। শহরে একটামাত্র জনসভা করলেন এবং হেলিকপ্টারে ধুলো উড়িয়ে মিলিয়ে গেলেন।
সেই সভায় মুলায়ম যা বললেন, তৃতীয় ফ্রন্ট সরকার গড়বে ও তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন—তা বিশ্বাস করতেও মুসলমানদের তেমন ভরসা হচ্ছে না। পাশাপাশি মায়াবতী এ জেলায় বার কয়েক ঘুরে গেছেন। বড় মুখ করে সমর্থন চেয়ে বারবার বলেছেন, অখিলেশের দুই বছরে গোটা উত্তর প্রদেশে ১৩৫টি দাঙ্গা হয়েছে, অথচ তিনি দিয়েছেন দাঙ্গামুক্ত পাঁচ পাঁচটি বছর। মুসলমান মন এই যে মুলায়ম ও মায়াবতীর মধ্যে পেন্ডুলামের মতো ঘুরছে, ভোটের আগে পর্যন্ত সেটাই অমোঘ সত্য। আর এই সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই কেন্দ্র থেকে আগেরবার জেতা বহুজন সমাজ পার্টির কাদির রানা ও সমাজবাদী পার্টির বীরেন্দ্র সিংয়ের ভোট-ভাগ্য।
এটা যদি মুদ্রার একটা পিঠ হয়, অন্য পিঠে তাহলে রয়েছেন বিজেপির জাঠ প্রার্থী সঞ্জু বালিয়ান ও কংগ্রেসের বানিয়া প্রার্থী পঙ্কজ আগরওয়াল। মুসলমান ভোট ভাগ হলে এবং নরেন্দ্র মোদির নামে হিন্দু ভোট একজোট হলে পাটিগণিতের নিয়মে বিজেপির জেতা কেউ ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু আর্যাবর্তের জাতপাতের ভোট-রাজনীতি কবেই বা আর পাটিগণিতের সরলরেখায় এগিয়েছে? এবার তাহলে কেন তার ব্যতিক্রম ঘটবে? তারই খোঁজে শহর ছাড়িয়ে গ্রাম। আর গ্রাম মানে সেই কাওয়াল, যা মুজাফফরনগরের দাঙ্গার ‘এপিসেন্টার’।
শহর ছেড়ে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার পুবে কাওয়াল।
আখ, গম, সরষের মতো ফসল বারো মাস তল্লাটের লোকজনদের ব্যস্ত রাখে। এলাকায় তাই দারিদ্র্যের ছোঁয়াও নেই। বরং আধুনিক দুনিয়ার হাত ধরে এগিয়ে চলার ইচ্ছা আছে। পাশেই মালেকপুর গ্রাম। এই জাঠ গ্রামের মেয়ে সোনিকাকে উত্ত্যক্ত করায় গোলমালের সূত্রপাত।
সোনিকার দুই ভাই শচিন ও গৌরবের সহিংস প্রতিবাদের শিকার হয়ে মারা যায় শাহনেওয়াজ। ক্ষিপ্ত কাওয়ালের লোকজন শচিন ও গৌরবকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। হাইওয়ের ধারে সেদিনই বসে পঞ্চায়েত। সন্ধ্যায় মাঠ থেকে চাষের কাজ সেরে ঘরে ফেরার পথে খালের ধারে খুন হয় তিনজন। দাবানলের মতো হিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়ে গোটা জেলায়।
জেলা ছাড়িয়ে অন্যত্র। ৬০ জনের মৃত্যু ঘটে। ঘরহারা হয়ে শিবিরে আশ্রয় নেন পঞ্চাশ হাজার নর-নারী। এযাবৎ নিশ্চিন্তে, নিরুপদ্রবে, নির্ভাবনায় ও নির্ভয়ে থাকা মুজাফফরনগর হুট করে চলে আসে খবরের শিরোনামে।
সেই মালেকপুর গ্রামের প্রেম সিং, নেত্রপাল সিং ও দেবিন্দর সিং গাছগাছালির ছায়ায় ঢাকা বাড়ির উঠোনে চারপাইয়ে বসে বললেন, ‘কোনো দিন যা হয়নি, এবার বহু জায়গায় তাই হবে।
প্রার্থী নয়, দল নয়, ভোট হবে মোদির নামে। ’
কাওয়াল ছাড়িয়ে আরও পুবে বুঢ়ানায় দয়ারাম যাদবের বাড়ি। কাওয়াল বাজারে তাঁর মনোহারি দোকান। দোকানের একধারে গ্যাসের চুল্লিতে চায়ের বন্দোবস্ত। দুটো বেঞ্চিতে লোকজন বসে চা খায়, দুদণ্ড জিরোয়।
দয়ারামের একটা ট্রাক্টর আছে। ভাড়ায় খাটে। খেত দেখাশোনা করে অন্য ভাইয়েরা। ডাল-ভাত, রুটি-সবজি ও দুধের অভাব নেই পরিবারে। চা-বিস্কুট হাতে ধরিয়ে চাপা স্বরে দয়ারাম বললেন, ‘এত বছর সাইকেলে ভোট দিয়েছি জাতিগত কারণে।
যাদব হয়ে মুলায়ম সিং যাদবকে ফেরাতে পারিনি। কিন্তু দাঙ্গাটা সব গুলিয়ে দিয়েছে। প্রাণে বাঁচতে হলে মোদির নামে বিজেপিকে ভোট দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ’
বেঞ্চিতে বসে রমেশ রানা। রাজস্থানের রাজপুত হলেও মুজাফফরনগরে দেড় শ বছরের বাসিন্দা তার পরিবার।
জীবনবিমার এজেন্ট। মোটরসাইকেলে ঘুরে ঘুরে মক্কেলদের সেবা দেন। কাওয়ালে এলে দয়ারামের দোকানই তাঁর ঠেক। রমেশ বললেন, ‘জাতে রাজপুত, মানে ঠাকুর। চৌধুরী চরণ সিং ও তাঁর ছেলে অজিতের দলকেই বরাবর ভোট দিয়েছি।
কিন্তু এবার পদ্ম ছাড়া উপায় নেই। ’
বিজেপিও তা বিলক্ষণ বুঝেছে। জাঠভুমিতে দাঙ্গার ফায়দা তুলতে গেলে জাঠ সাহচর্য নিতান্তই জরুরি। এই প্রথম এই কেন্দ্রে তাই তারা একজন জাঠকে প্রার্থী করেছে। জোটসঙ্গী কংগ্রেসের প্রার্থী বানিয়া হওয়ায় তাঁকে জেতাতে অজিত সিংয়ের দায়ও কমে গেল।
জাঠ সঞ্জু বালিয়ানকে ভোট দেওয়া মানে মোদিকে আবাহন করা। মোদি এলে নাকি দাঙ্গাবাজেরা দূর হটবে। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।
বড় রাস্তার ওপরেই ডেরাবালি মসজিদ। ভেতরটা ঝকঝকে তকতকে।
পরিপাটি করে বিছানো মাদুরে বসে ইমাম মোহাম্মদ ইকবালের বড় ভাই সরফরাজ। ধীরে ধীরে জমা হলেন প্রবীণ মোহাম্মদ নাজির, সাকিবুল ইসলামেরা। মুলায়মের অন্ধ ভক্ত ছিলেন সবাই দাঙ্গার আগে পর্যন্ত। আজ তাঁরা বহেনজির হাতির ওপর ভরসার বাজি রাখতে চান।
কেন? সরফরাজ বললেন, ‘তিনটি কারণে।
প্রথমত, মায়াবতীর আমলে আইনশৃঙ্খলার এত উন্নতি হয়েছিল যে বলবার নয়। মুজাফফরনগর বাদ দিন। এখানে কোনো দিন দাঙ্গা হয়নি। কিন্তু মোরাদাবাদ, মিরাট, কৈরানায় যেখানে হুট বলতে ছোরাছুরি-গোলাগুলি চলে, সেসব জায়গাতেও মায়াবতী কাউকে ট্যাঁ ফুঁ করতে দেননি। দ্বিতীয় কারণ, দাঙ্গা বন্ধে প্রশাসন উদ্যোগই নিল না প্রথম কদিন।
তারপর যারা লাগাল, তাদের ধরতে গড়িমসি করল। একজনকেও এখন পর্যন্ত শাস্তি দিল না। অথচ সরকার সমাজবাদীর। প্রশাসন সমাজবাদীর। সরকার কেন এমন করল, সেটাই আমাদের আজও জিজ্ঞাসা।
আর তৃতীয় কারণ, একমাত্র বহেনজির প্রার্থী কাদির রানাই মুসলমান। ’
কাওয়ালের ভেতরে জামে মসজিদের বাইরে মোহাম্মদ আখতার ও মোহাম্মদ আসগর মোড়ায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। ধীরে ধীরে সেখানে ভিড় জমে গেল। নিহত শাহনেওয়াজের চাচা হাজি সাহেব চলে এলেন। গত সাত মাসে মিডিয়ার লোকজনের সঙ্গে কথা বলাটা তাঁদের কাছে জলভাত হয়ে গেছে।
তাঁরা বললেন, ‘দুঃখের কথা, সরকারটা আমাদেরই তৈরি করা। অথচ, আমাদের বিপদে চোখ ফিরিয়ে থাকল। ’
‘তাহলে আপনারা এবার সাইকেল ছেড়ে হাতির সওয়ারি?’ প্রশ্নটা শুনে হাজি সাহেব আমতা আমতা করতে লাগলেন। মিনমিন করে বললেন, ‘সাইকেল ছাড়তে চাই না। মোদিকে রুখতে মুলায়মই এখনো আমাদের বাজি।
কারণ, আর যাই হোক মুলায়ম কোনো দিন বিজেপিকে সঙ্গী করবে না। তা ছাড়া, এটা তো দিল্লির ভোট। কে জানে, শেষ পর্যন্ত বহেনজি কোন রাস্তায় হাঁটবেন?’
পাটিগণিতের সরল অঙ্ক এখানেই জটিল হয়ে যায়। এতকালের সুহূদ ‘মওলানা মুলায়ম’কে ত্যাগ করে মুসলমান বলে বহুজন সমাজ পার্টির কাদির রানাকে সমর্থন? শেষ পর্যন্ত যদি মায়াবতী বিজেপির সঙ্গে হাত মেলান? অতীতে যিনি তিনবার বিজেপির ঘর করেছেন, তিনি যে চতুর্থবার করবেন না কিসের গ্যারান্টি? ভোট শুরুর আগে পর্যন্ত এই দোলাচলেই দুলছে মুজাফফরনগর।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।