আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চ্যাপলিন, আজও চমৎকার

চ্যাপলিনকে নিয়ে ভাবতে বসলে একটা বিস্ময় ভর করে। পৃথিবীকে এক পৌরাণিক চরিত্র উপহার দিয়েছেন তিনি। নাকের নিচে ছোট গোঁফ, মাথায় টুপি, হাতে ছড়ি, ঢোলা প্যান্ট, বিশাল জুতা পরা ওই ভবঘুরে এখন বিশ্ব-ইমেজের অংশ। পর্দায় ওই ভবঘুরের কাণ্ডকারখানা দেখে কৈশোরে হেসেছি খুব। তারুণ্যে এসে টের পেয়েছি ব্যাপার আরও জটিল।

চ্যাপলিনের ছবি দেখতে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত প্রবল এক হাসি হাসতে হাসতে হঠাৎ টের পেয়েছি, বেদনায় ভারী হয়ে আসছে বুক; অপ্রস্তুত হয়ে আবিষ্কার করেছি চোখ ভিজে গেছে কখন। হাসি আর অশ্রুর মতো মানুষের মৌলিক দুটি প্রবৃত্তিকে সমান্তরালে উসকে দিয়ে আনন্দ-বেদনার নাগরদোলায় চড়িয়ে তাঁর চলচ্চিত্রগুলো জীবন, রাজনীতি, মানব সম্পর্কের আশ্চর্য জঙ্গমতায় ঠেলে দিয়েছে। আবিষ্কার করেছি, ওই ভবঘুরের পোশাকের ভেতর আসলে ঢুকে আছেন এক অনন্যসাধারণ শিল্পী। জেনেছি, চ্যাপলিন তাঁর চলচ্চিত্রের সেই অসাধারণ অভিনেতাটি শুধু নন; তিনি সেই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, শিল্পনির্দেশক, সংগীত পরিচালকও। বিস্ময়ের ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে, যখন জানতে পেরেছি কী করে চার্লি নামে লন্ডনের বস্তির এক খুচরো ছেলে পরিণত হলো বিংশ শতাব্দীর অন্যতম কিংবদন্তিতে।

ক্রমে বুঝে উঠেছি, চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রের বৈচিত্র্য, বিস্তার, গভীরতা আর বয়স; মেধা-নির্বিশেষে এর সর্বজন মর্মস্পর্শ দক্ষতাকে। টের পেয়েছি, কেন চ্যাপলিনকে জাঁদরেল চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ লুক গদার তুলনা করেছিলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির সঙ্গে, লেখক বুদ্ধদেব বসু শেক্সপিয়ারের সঙ্গে আর চলচ্চিত্রতাত্ত্বিক সের্গেই আইনস্টাইন আরিস্তোফেনিসের সঙ্গে।
লক্ষ করার বিষয় এই যে হলিউডে যখন চৌকস সুপুরুষ বীরেরা পর্দার নায়ক, চ্যাপলিন তখন হতদরিদ্র এক ব্যর্থ ভবঘুরেকে করলেন তাঁর মূল চরিত্র। খেয়াল করলে দেখা যাবে, ভবঘুরের বরাবর একজন সঙ্গী রয়েছে যে তার চেয়ে লম্বা, বলশালী, নির্মম। তার সেই সঙ্গীটির নাম আসলে ‘বাস্তব’।

অর্থ, লোভ, প্রতিযোগিতার রমরমা যে বাস্তব তার অ্যান্টি-থিসিস হিসেবে হাজির হয় বেমানান এই ভবঘুরে, যার পুঁজি কেবল আদিম সারল্য, অকৃত্রিম সততা আর অগাধ প্রেম। এই পুুঁজিবাজারে বিকায় না। পদে পদে অপদস্ত হয় সে। আমাদের মনে পড়ে দস্তয়েভস্কির ‘ইডিয়ট’কে।
চ্যাপলিন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমার কাছে সৌন্দর্য হচ্ছে নর্দমায় ভেসে যাওয়া একটা গোলাপফুল।

’ এর বিপরীতের দ্বন্দ্বে সৃষ্টি হয় যে সৌন্দর্য, তার মুখোমুখি করেই চ্যাপলিন আমাদের সামনে খুলে দেন বাস্তবতার খোলস। ক্লেদাক্ত বাস্তবতার নর্দমায় এক নিষ্কলুষ ফুল হয়ে ভেসে বেড়ায় এই ভবঘুরে। সে তার ‘সেলফ মকারির’ মাধ্যমে স্পষ্ট করে বাস্তবতার স্তরে স্তরে জমে থাকা ভণ্ডামি, স্পষ্ট করে আমাদের স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের দ্বন্দ্বকে। ভবঘুরের অপমান তাই মানবতার অপমান হিসেবে দেখা দেয় আমাদের কাছে।
সিটি লাইটস ছবিতে অন্ধ ফুলবিক্রেতা মেয়ে যখন দৃষ্টি ফিরে পেয়ে আর ভবঘুরেকে চিনতে পারে না, তখন আমাদের বুক হু হু করে ওঠে।

গোল্ডরাশ-এ যখন ভবঘুরে তার নিজের জুতার স্যুপ বানিয়ে খায়, তখন সেই অসাধারণ দৃশ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে ক্ষুধার নির্মমতা। মর্ডান টাইমস-এ যখন ভবঘুরে মেশিনের ভেতর চাপা পড়ে নৃত্যের ভঙ্গিতে ঘুরতে থাকে, তখন সে দৃশ্য যন্ত্রসভ্যতার এক অভূতপূর্ব আক্ষরিক ক্রিটিক হয়ে ওঠে। গ্রেট ডিক্টেটর-এর গ্লোব নিয়ে নৃত্য হয় ক্ষমতালিপ্সার অপূর্ব প্রতীকী রূপায়ণ। নির্বাক চ্যাপলিন মঁসিয়ে ভের্দ্যুর মাধ্যমে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেও ঘটান বিস্ফোরণ। সবাইকে চমকে দিয়ে সেখানে আবির্ভূত হন এক খুনির চরিত্রে।

তর্ক তোলেন, একজনকে হত্যা করলে যদি কেউ খুনি হয়, তাহলে হাজারজনকে হত্যা করে সে বীর হয় কী করে? খুনির যদি বিচার হতে পারে, তাহলে মানুষ হত্যার জন্য যারা ফেঁদে বসিয়েছে বিশাল অস্ত্রের কারখানা আর অস্ত্রের ব্যবসা, তারা কেন থাকবে বিচারের বাইরে?
আমেরিকায় বসে নেহাত ঠাট্টা-মশকারার ভঙ্গিতে চ্যাপলিন তাঁর চলচ্চিত্রে এসব গুরুতর প্রশ্ন তুলছিলেন বিশ শতকের প্রথম ভাগে, যখন আমেরিকা পুঁজির দাপটে নিজেদের এক স্বপ্নপুরি গড়ে তোলার ঘোরে ব্যস্ত। সে দেশের আকলমন্দরা তামাশার আড়ালে তাই তাঁর চলচ্চিত্রে বিপদের ইশারা দেখতে পান। হলিউডের সংগঠন ‘মোশন পিকচার্স এলায়েন্স ফর প্রিজারভেশন অব আমেরিকান আইডিয়াল’ চ্যাপলিনকে কমিউনিস্ট ঘোষণা করে মামলা ঠুকে দেয়। স্নায়ুযুদ্ধের সেই দিনগুলোতে আমেরিকায় কমিউনিস্ট অভিধা ছিল গুরুতর অপরাধ। কথিত বাক্স্বাধীনতার দেশ আমেরিকা এই বিপজ্জনক কৌতুকাভিনেতাকে অবশেষে তাঁর দেশ থেকে বহিষ্কার করে ১৯৫২ সালে।

মজার ব্যাপার হলো, সে সময় কমিউনিস্ট হিসেবে পরিচিত সোভিয়েত ইউনিয়নেও তখন চ্যাপলিন নিষিদ্ধ। সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদে বিশ্বাসী নন বলে সেখানে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত। প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার এই দোলাচালে বিরক্ত চ্যাপলিন শেষে আশ্রয় নেন সুইজারল্যান্ডের এক নিভৃত গ্রামে। সেখানে তাঁর সঙ্গী, বন্ধু ও স্ত্রী প্রখ্যাত নাট্যকার ইউজিন ও নিলের মেয়ে উনার সাহচর্যে কাটে তাঁর শেষ জীবন।
চ্যাপলিন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি তাঁর শৈশবকেই বয়ে বেরিয়েছেন, যে শৈশব ছিল দুঃসহ।

বাবা তাঁর মাকে ত্যাগ করেছিলেন। মা কখনো সস্তা নাটকের দলে গান গেয়ে, কখনো সেলাই করে চালিয়েছেন সংসার। তাঁরা না খেয়ে থেকেছেন বহু দিন। কখনো ভিক্ষা করে, কখনো চুরি করে জোগাড় করতে হয়েছে খাবার। শৈশবের সেই বঞ্চনা আর অপমানকেই যেন চ্যাপলিন মোকাবিলা করেছেন তাঁর চলচ্চিত্রের ভেতর দিয়ে।

চ্যাপলিন লিখেছেন, প্রবল বঞ্চনার ভেতর দাঁড়িয়েও কী করে পৃথিবীকে ভালোবাসতে হয়, সে শিক্ষা তিনি পেয়েছেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে।
শিল্প কী, চ্যাপলিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘শিল্প হচ্ছে পৃথিবীর কাছে লেখা এক সুলিখিত প্রেমপত্র। ’ তাঁর অনবদ্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে চ্যাপলিন এমন একেকটি প্রেমপত্রই পাঠিয়েছেন পৃথিবীর মানুষের কাছে। সেই প্রেমপত্রগুলো আজকের এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পৃথিবীতেও সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর চলচ্চিত্রগুলো দেখতে গিয়ে এখনো প্রাণবন্ত হাসির স্রোতে ভাসতে ভাসতে মহৎ বেদনায় আর্দ্র হওয়া যায়।

চ্যাপলিন তাই আমাদের কাছে আজও চমৎকার।

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.