munirshamim@gmail.com এক.
s'আমার বাবার মৃত্যু দিন নেই। তাঁর মৃত্যু ক্ষণ নেই। কবর নেই। কবরস্থান নেই। কেননা বিগত একচল্লিশ বছর পরও আমরা জানি না বাবার কোথায়, কখন, কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল।
বাবাকে যখন খুন করা হচ্ছিল বাবার কি তখন পানির পিপাসা পেয়েছিল। বাবা কি তখন পানি পান করতে চেয়েছেন? বাবার লাশ কি দাফন করা হয়েছিল? তাঁর কি জানাজা হয়েছিল? তাঁকে কি গোসল দেয়া হয়েছিল? আমরা কিছুই জানি না, কিছুই জানতে পারিনি, আজও না’ - টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে অনেকটা এভাবেই বলছিলেন শহীদ বুব্ধিজীবী শিল্পী আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ। আলতাপ মাহমুদের মায়ের নাকি ধারণা ছিল পাকিস্তানী হায়েনারা, তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরা তাঁর ছেলেকে, আলতাপ মাহমুদকে খুন করেনি। পিটিয়ে ’পাগল’ বানিয়ে রেখেছে। তাই তিনি নিজের ছেলের খোঁজে মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
অপ্রকৃতস্থ মানুষ দেখলে নিজের ছেলে মনে করে ছুটে গিয়েছেন। গ্রাম-বাংলার ছাপ্নান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে এ রকম নির্মম বেদনার স্মৃতি আজো জিইয়ে আছে শতে শতে নয়; হাজারে হাজারে, লাখে লাখে। কারও স্মৃতি হয়তো হুবুহু শাওনের মতো, কারওটা তার কাছাকাছি, কারওটা একেবারেই ব্যতিক্রম। কিন্তু সবই স্বজন হারানোর। কেউবা হারিয়েছেন বাবা, কেউ মা, কেউ প্রিয়তম বর, কেউ প্রিয়তমা স্ত্রী, কেউ ছেলে-মেয়ে-বন্ধু, প্রতিবেশী, খুব কাছের জন।
খুব কাছের মানুষ। সব স্মৃতিই বেদনার। হাহাকারের। সবই রক্তাক্ত, এতটা লাল টকটকে যে, কিছুতেই মুছে যাবার নয়। মুছে যায়ও নি।
গত একচল্লিশ বছরে ক্ষমতা লিপ্সু সামরিক- বেসমারিক আমলা-রাজনীতিক আর ব্যবাসায়ীর হাতে পড়ে রাষ্ট্রীয় দর্শন পাল্টেছে। সংবিধানের মূলনীতি বদল হয়েছে। রাজাকার মন্ত্রী হয়েছে। রাজাকার মন্ত্রীর গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা কলংকিত হয়েছে। কোমলমতি শিশুদের মুক্তিযুদ্ধের ভুল-বিকৃত ইতিহাস পড়ানো হয়েছে।
কিন্তু কোন কিছুই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে তাঁদের প্রিয়জনদের মুছে দেয়া সম্ভব হয়নি। বরং নানা টানাপোড়ন ও রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যেও তারা একটা দাবিতে অবিচল ছিলেন। তারা একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং দেখছেন। এ স্বাধীন বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। হতেই হবে।
দুই।
হুমায়ুন আজাদের কিশোর উপন্যাস ’আব্বুকে মনে পড়ে’। কয়েকদিন আগে বইটি আবার কিনে পড়েছি। একবার নয়; বহুবার। এ বইটি যতবার পড়ি নিজের সাথে, নিজের শৈশবের স্মৃতির সাথে, নিজের বেড়ে উঠার সাথে মিল খুঁজে পাই।
বাবার আদর-ভালবাসা না পাওয়া, বাবার বকুনি থেকে বঞ্চিত হওয়া, বাবার আদর কেমন হয় সেটি না জেনেও বাবাকে বারবার, অসংখ্যবার মনে পড়ার কথা মনে পড়ে। আমি ঠিক জানি না, কবে কোন বয়সে বুঝতে পেরেছিলাম-আমার বাবা নেই। আমার শৈশবের খেলার সাথী সবার বাবা ছিল। আমিও জেনেছি সবার বাবা থাকে। বাবা থাকতে হয়।
বাবারা বোধহয় অন্য শহরে থাকে। দুরে কোথাও। মাঝে মাঝে আসে। কারণ আমার কোনও কোনও খেলার সাথীর বাবাও শহরে থাকতেন। মাঝে মাঝে আসতেন।
সম্ভবত আমিও ভেবেছিলাম বাবা শহর থেকে কোন একদিন আসবেন। আমার মা কোন দিন কি নিজে আমাকে বলেছিলেন যে আমার বাবা নেই? আমার মনে পড়ে না। সামাজিকায়নের স্বাভাবিক ব্যকরণেই বোধহয় এক সময় বুঝতে পারি যে, আমার বাবা নেই। তারও অনেক পরে জেনেছি বাবা শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে।
তিন.
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারগুলোর মূল লড়াই-সংগ্রাম শুরু হয় মূলত মুক্তিযুদ্ধের পর। এ এক নতুন যুদ্ধ। অন্তত নিজের অভিজ্ঞতা, নিজের স্মৃতি তাই বলে। আমার মা যে বয়সে বিধবা হয়েছেন এখন সে বয়সে বেশির ভাগ মেয়েই অবিবাহিত থাকেন। অথচ সে বয়সেই তিন শিশু সন্তান নিয়ে তার শুরু হয় এক নতুন লড়াই।
আমাদের লেখাপড়া, পোষাক-পরিচ্ছদ, উৎসব-আনন্দের খরচ জোগানো সেসময়কার একজন নারীর জন্য কতটা কঠিন ছিল-এটি বলার অপেক্ষা রাখে না। বাবা-হারা তিন সন্তান কে বাবার অনুপস্থিতি বুঝতে না দেয়ার কঠিন কসরত করতেই করতেই হয়তো মার স্মৃতিতে কখনও কখনও জেগে উঠতো তার সবচেয়ে কাছের মানুষটির স্মৃতি। কখনও কখনও দেখতাম তার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা। মা কাঁদছেন। ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ, ২১ ফেব্রুয়ারি এলেই বেশি কাঁদতেন।
আবার সে কান্নার জল শুকিয়ে যেত। নতুন করে সিক্ত হতো নতুন ১৬ ডিসেম্বরে, নতুন ২৬ মার্চ-এ। আমি নিশ্চিত, শুধু আমার মা নন, মুক্তিযুদ্ধে যারা স্বামী হারিয়েছেন তাদের বেশির ভাগই শিশু সন্তানদের নিয়ে এ রকম লড়াই-সংগ্রামে পড়তে হয়েছে খুব তরুনী বয়সে। কাঁদতে হয়েছে খুব তরুনী বয়সে। যে বয়সে তাদের আনন্দ-উল্লাস আর উচ্ছলতায় উদ্বেল থাকার কথা।
মুক্তিযুদ্ধে যারা বাবা হারিয়েছে, মা হারিয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই বয়স এখন কমপক্ষে চল্লিশ-একচল্লিশ। আমাদের শৈশব, আমাদের কৈশোর, আমাদের তারুন্যে, আমাদের বেড়ে উঠার প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে রাজাকার-আলবদর-আল শামস এর পৈশাচিকতায় আমরা যারা বাবা অথবা মা হারা হয়ে বড় হয়েছি, আমরা সবার অন্তত একটা সম্মিলিত প্রত্যাশা ছিল। প্রত্যাশা আছে। এ প্রত্যাশা নয়। এ হচ্ছে দাবি।
এ রাষ্ট্রে, এ মানবজমিনে একদিন রাজাকারদের বিচার হবে। আলবদরদের বিচার হবে। ঘাতক-দালালদের বিচার হবে। এ বিচার হতেই হবে।
চার.
আমার, আমাদের চারপাশে কিছু মানুষ আছে।
অন্তত এরা চেহারায় মানুষের মতো। হয়তো মানুষের মতো রক্তও আছে এদের গায়ে। এরা মানুষের মতো হাটে। খায়। চলাফেরা করে।
এদের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কেউ গবেষক। কেউ এনজিও কর্মী। কেউ সাংবাদিক অথবা অন্য কিছু। সময় বিচারে এদের কাউকে রাজাকার-আলবদরও বলা যায় না।
অথচ চলনে বলনে তার চেয়েও মারাত্বক। এরা সুযোগ পেলেই যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার বিরুধীতা করেন। চলমান বিচারিক প্রক্রিয়ার কোন সীমাবদ্ধতা চোখে পড়লে এরা কষ্ট পান না। আতংকিত হন না। বরং খুশীতে আটখানা হন।
যুদ্ধাপরাধ এর বিচার প্রশ্নে এরা উন্নয়ন-গণতন্ত্রের বুলি কপচান। এত বছর পর দেশকে বিভাজন করা ঠিক হবে না বলে তত্ত্ব দেন। যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর ট্রাইবুনালে দেয়া অশ্লীল বাক্য চালাচালি করেন। বারবার পড়েন আর অট্র হাসিতে ফেটে পড়েন। আমার-আমাদের চারপাশে এ সব দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় এ কোন শ্বাপদ অরণ্যে বসবাস আমাদের।
এ কোন ছোবলের প্রস্তৃতি চলছে ভেতরে ভেতরে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে বেড়ে উঠা এ কোন প্রজন্ম এরা। তবু এ শ্বাপদ অরণ্যে দাঁড়িয়ে দাবি করছি- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই হবে। ভোট ও ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতির চোরাবালিতে আমাদের দীর্ঘ প্রতিক্ষিত দাবি যেন কোন ভাবেই হারিয়ে না যায় এবারের বিজয় দিবসে এটাই প্রত্যাশা। এটাই দাবি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।