“আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুলতুলিতে যাই,
ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাই”
শৈশবে যখন ছড়াটা ঝুঁকে ঝুঁকে পড়তাম তখনই প্রথম আবিষ্কার করলাম, আসলে আমার কোন মামা নেই। মায়ের কাছে যেয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকি, মা বাংলা বইয়ের বীর শ্রেষ্ঠ সিপাহী মোঃ মোস্তফা কামালের যুদ্ধরত ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন, মনেকর এইটাই তোমার মামার ছবি, তোমার মামা ১৯৭১ সালে এইভাবে যুদ্ধ করতে যেয়ে শহীদ হয়েছেন। সেই থেকে উনিশ সাত এক রক্তের প্রতিটা কণিকায় বাসা বেঁধে আছে।
যখন একটু বুঝতে শিখেছি, তখন নানা-নানী, মা-খালাদের কাছ থেকে এক বীরের বীর গাঁথা ইতিহাস শুনেছি, একজন বীর প্রতীকের দেশ মাতৃকার জন্য আত্মদানের ইতিহাস শুনে শুনে বেড়ে উঠেছি।
মায়ের ৪ বোনের একটি মাত্র ভাই ছিলেন সিরাজুল ইসলাম।
আদর করে সবাই সিরু বলে ডাকত। নানা নানীর অনেকটা ইচ্ছের বাইরে যেয়ে বাংলাদেশ আর্মিতে জয়েন করেন মামা।
দেশ তখন উত্তাল। যশোর সেনানিবাসে থাকা অবস্থায় যুদ্ধ বাঁধে, টানা কয়েকদিনের যুদ্ধে চোখের সামনে পাখীর মত মানুষ হত্যা দেখে বাবা-মায়ের কথা খুব মনে পড়ে, মামা যুদ্ধের মাঝে একটিবারের জন্য তার মা-বাবা কে দেখতে ঝিনাইদহে যান। নানা সেদিন মামার পীঠে হাত রেখে বলেছিলেন “যা বাবা, দেশটাকে স্বাধীন করে ঘরে ফিরে আয়”
নানী শুধু বোবা দৃষ্টি দিয়ে মামার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
মামার এংগেজমেন্ট করা ছিল, শেষ বারের মত হবু বধূর মুখ দর্শন করে মামা আবার যুদ্ধে গিয়েছিলেন। এইবার ময়মনসিংহ অঞ্চলে। ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আন্ডারে থাকার কারনে যুদ্ধ ক্ষেত্রে ভুমিকাটা একটু বেশি রাখতে হত।
দীর্ঘ দিন যুদ্ধের মাঝে থাকা অবস্থায় নানা-নানীর কাছে একটি মাত্র চিঠি দিতে পেরেছিলেন। সেই চিঠিতে দেশ কে স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের চেহারা কেমন হবে তার বিস্তারিত বিবরন ছিল, তার বিয়েতে তার কয়েকজন সহযোদ্ধা আসবে তাদের বিবরন ছিল...............।
মামা একটা ইউনিট লিড দিয়ে উপায়ন্তর না পেয়ে সুইসাইড স্কোয়াড নিয়ে পাকিদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন, সেইটাই ময়মনসিং-জামালপুর ট্র্যাজেডি নামে পরিচিত। মামা শহীদ হলেন। সরকার মরণোত্তর বীর প্রতীক (বীর প্রতীক শহীদ সিরাজুল ইসলাম, ঝিনাইদহ জেলার একমাত্র বীর প্রতীক, বাংলাদেশের ৪২৬ জন বীর প্রতীকের এক জন) খেতাব প্রদান করলেন।
নানা নানী হারালেন একটি মাত্র ছেলে, মা-খালারা একমাত্র ভাই, আর আমরা যারা এই বীরের ভাগ্নে তারা চির দিনের জন্য মামা ডাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত হলাম।
বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে তার ছোট্ট ভাইটি হারানোর কষ্ট যতটুকু কিম্বা খালেদা জিয়ার কাছে জিয়া, আমার মায়ের কাছেও তার ভাইটি হারানোর অনুভূতি একই রকম।
এই ৪১ বছরেও আমার মা তার ভাইটিকে একটি বারের জন্যও ভুলতে পারেন নি। চোখ বন্ধ করলেই হাজারটা ঝাপসা স্মৃতি ক্রমে ক্রমে পরিস্কার হতে থাকে।
প্রতিটা মুক্তিযোদ্ধা আমার মামা, আমার মায়ের ভাই। আজ ওরা স্বর্গে দাঁড়িয়েও দু-দণ্ড শান্তিতে নেই। স্বর্গও হয়তো ওদের কাছে নরক সমান হয়ে যাচ্ছে।
হাজার হাজার প্রশ্নবাণে জর্জরিত আমার মায়ের ভাইয়েরা। বিশ্বজিতের মত হাজার হাজার মানুষ তাদের চার পাশ থেকে প্রশ্নের পীঠে প্রশ্ন করে তাদের স্বর্গীয় মস্তিস্ক কে দুর্বল করে দিচ্ছে, “ কেন এই স্বাধীনতা এনেছিলে? কেন একটা বীজয় দিবস রেখে এসেছ? আমাদের প্রত্যেকটা মৃত্যুর জন্য তোমরাই দায়ী!”
এইসব পাপী মুক্তি যোদ্ধাদের কপালের ঘামে স্বর্গ হয়তো প্লাবিত হচ্ছে।
মামা, আমিও আসছি, বিশ্বজিতের মত হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে, তোমার কপালের ঘাম যেন শুকিয়ে না যায়!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।