বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানে অবস্থান করছে। সম্প্রতি সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সুইজারল্যান্ডের আইএমডিএমবিএ বিজনেস স্কুলের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের শুরু থেকে এ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে থাকলেও বাংলাদেশ সর্বোচ্চ অগ্রগতির তালিকায় রয়েছে। সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের তালিকায় চীন, ব্রাজিল, সিঙ্গাপুর ও তুরস্কের পরেই রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের 'বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন-২০১৩' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে নিয়ে আশার কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনের বলা হয়েছে, কিছু দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভালো করেছে, কিছু দেশ ভালো করেছে মানব উন্নয়ন সূচকে। যে কয়টি দেশ উভয় সূচকেই ভালো করেছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৫০ বছর ধরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে নগরায়নের ফলে যে উন্নয়ন ঘটেছে তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান মোটামুটি প্রথম দিকে। রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরকে কেন্দ্র করে দেশটিতে দ্রুত শিল্পায়ন হচ্ছে। অর্থনীতিতে বর্তমানে শিল্প খাতের অবদান ৩০ শতাংশ।
আজ থেকে ২০ বছর আগে যা ছিল ২০ শতাংশ। ১৯৯০ সালে দেশটির জিডিপিতে রপ্তানি খাতের অবদান যা ছিল, ২০১০ সালের মধ্যে তা বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য, যাতে নারী শ্রমিকদের অবদান বেশি। এই শিল্পে এখন ৩০ লাখ নারী কাজ করছেন। এছাড়া বহু শ্রমিক দেশের বাইরে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করছেন।
দেশটির প্রবাসী আয় প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এর পাশাপাশি কৃষি খাতের উন্নয়নে দেশটির জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে দ্রুতগতিতে।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর লেখা বইয়ে দেশটিকে উন্নয়নের 'পরীক্ষা ক্ষেত্র' হিসেবে বলা হয়। অধিক জনসংখ্যা, সীমিত সম্পদ, অনুন্নত অবকাঠামো, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে এই নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত রাখায় বাংলাদেশ সম্পর্কে এ ধারণার পরিবর্তন হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রযুক্তির ব্যবহার দেশটির কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে। বেশিরভাগ কৃষি জমিতে এক ফসলের জায়গায় দুই ফসল ও উচ্চফলনশীল জাত বেছে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে কৃষকের ঋণ পাওয়ার বাধা দূর হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে কৃষিতে উদ্বৃত্ত শ্রমিক রয়েছে। মঙ্গা সময়ের মৌসুমি ক্ষুধা এখন আর নেই।
তবে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু সীমাবদ্ধতাও উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, দুর্নীতি দেশটির একটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিচালন ব্যয় বেশি। বিদ্যুৎ সংকট এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশটি। রাজধানী এবং দেশের বড় শহরগুলোর রাস্তাঘাটে রয়েছে নিত্য যানজট।
তবে বাংলাদেশ যে অর্থনীতির উভয় সূচকে ভালো করছে এমনটি মনে করছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালান গোল্ডস্টেইন ও সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তাদের মতে, যদিও সরকার বাজেটে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলেছে তারপরও বলা যায় চলতি অর্থবছরে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও বাংলাদেশের জন্য স্বাস্থ্যকর। কারণ ইউরো জোনের অর্থনৈতিক সংকট সত্তেও বাংলাদেশ ভেঙে পড়েনি; তবে রপ্তানি প্রত্যাশার চেয়ে কম হয়েছে। আইএমএফ যে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রকাশ করেছে তাতে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসের দিক দিয়ে বিশ্বের ১৫০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৫তম।
গোল্ডস্টেইন ও জাহিদ হোসেনের মতে, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা।
কারণ ইউরোজোনের দেশগুলো বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অন্যতম ক্রেতা। এই ক্রেতারা তাদের অর্থনীতি পুনর্নিমাণ করতে সংকোচনমূলক নীতি গ্রহণ করায় এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিতে। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশকে ৬ শতাংশ বা তার কিছুটা বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। চলমান বিশ্বমন্দার প্রভাবে উন্নয়নশীল তো বটেই, গ্রিস ও ইতালির মতো শক্তিশালী অর্থনীতির দেশও মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর বিপরীতে সীমিত সম্পদের দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ উন্নয়নের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
কৃষি, শিক্ষা, মা ও শিশুমৃত্যু, তথ্য-প্রযুক্তি ও বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ বিভিন্ন খাতে যুগান্তকারী উন্নয়নের পাশাপাশি শিল্প ও কৃষিজ উৎপাদন, মাথাপিছু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারের হার, শিক্ষা বিশেষত নারীশিক্ষার ব্যাপক প্রবৃদ্ধিসহ অন্যান্য সূচকে দেশটি ব্যাপক উন্নতি করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০তম বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে নিউইয়র্কে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে একটি উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছে। দেশটির সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নতুন গন্তব্যে পেঁৗছেছে। গত তিন বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ শতাংশেরও বেশি হারে বেড়েছে এবং এটি সম্ভব হয়েছে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রতি বছরই ফসলের বাম্পার ফলনে।
বাংলাদেশে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টানা ১৫ বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ৩.২ শতাংশ হারে বেড়েছে।
আবার ১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি গড়ে ৪.৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। আর এখন বাড়ছে ৬ শতাংশেরও বেশি হারে। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার পাকিস্তান, নেপালসহ এ অঞ্চলের অপরাপর দেশ থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ২০০৬ সালের ৪৮৭ ডলার থেকে বেড়ে ২০১১ সালে ৮১৮ ডলারে পেঁৗছেছে যা বাংলাদেশকে দ্রুতই একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন সম্প্রতি বাংলাদেশের এসব সাফল্য অকপটে স্বীকার করেছেন।
২০১৫ সালের মধ্যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যে ১৬টি দেশ সাফল্য দেখাতে পেরেছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, নারী উন্নয়ন, তথ্য-প্রযুক্তি, শিক্ষা ও কৃষি উন্নয়ন বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করবে বলে জাতিসংঘের মহাসচিব তার বাংলাদেশ সফরে এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতিতে স্পষ্ট করেই বলেছেন। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে উত্তরোত্তর সাফল্য অনেক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞের কাছে আদর্শ হিসেবে কাজ করছে। জাতিসংঘের ৬৬টি শান্তি মিশনের মধ্যে ৪৫টি মিশনেই বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করেছে এবং দুটি মহিলা শান্তিরক্ষা দল পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, জঙ্গিবাদ, সহিংসতাসহ সব আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
তথ্যসূত্র: অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।