আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সৃষ্টির সেরা জীব

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। সৃষ্টির সেরা জীব মোহাম্মদ ইসহাক খান সিটি কর্পোরেশনের একজন কর্মী জয়তুন বিবি। তার পরনে সবুজ পোশাক।

তাতে বড় বড় করে হলুদ অক্ষরে লেখা আছে, "পরিচ্ছন্নতা কর্মী"। তার কাজ হচ্ছে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই এলাকার সড়কে জমে থাকা সব ময়লা একটা ছোট্ট চাকা লাগানো গাড়িতে ঝেঁটিয়ে তোলা, তারপর সেগুলো ঐ বড় ডাস্টবিনটাতে রেখে আসা। সে এই কাজ করে আসছে আজ পাঁচ বছর ধরে। কাজটি মোটেই সুখকর নয়, প্রথম-প্রথম তার মোটেই ভাল লাগতো না, নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসতো, খাবার খেতে কষ্ট হতো, বমি আসতো। কিন্তু ঘরে অকর্মা স্বামী, গাঁজার পয়সা না যোগালে মারধোর করে, কাজেই ঘরে বসে থাকলে চলবে কেন? এই কাজ করলে আর কিছু না হোক, ছেলেপুলেকে নিয়ে দুটো ভাত খাওয়া যায়।

কাজেই সে দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করে গেছে, এখন আর তার নাকে কোন দুর্গন্ধই লাগে না। বরং এমন হয়েছে যে একদিন ডাস্টবিনের গন্ধ নাকে না গেলে তার হাঁসফাঁস লাগে, মনে হয় কী যেন নেই, কী যেন ছিল! অভ্যেস বড় বিচিত্র জিনিস। সেদিনও সে রোজকারের মতো ময়লার গাড়িটা ঠেলে ডাস্টবিনের কাছে হাজির হয়। লোকজনের অবস্থা দেখো, মনে মনে ভাবে সে। সব ময়লা যদি বাইরেই ফেলবে, তাহলে আর ডাস্টবিন রেখে লাভ কী? থিকথিকে নোংরা অর্ধতরল ময়লা রাস্তার অর্ধেক পর্যন্ত গড়িয়ে চলে এসেছে।

সাধারণ মানুষ নাকে কাপড় চেপে ধরে দ্রুত পার হয়ে যায় জায়গাটা, খুব হুঁশিয়ার থাকে, যেন ময়লা পানি গায়ে কিংবা কাপড়ে না লাগে। জয়তুন বিবি নিয়ে আসা ময়লাগুলো উপুড় করে ঢেলে দিতে যাবে, তখনই একটা জিনিস তার চোখে পড়ে। দলা পাকানো পুঁটুলির মতো এটা কী পড়ে আছে? কাছে গিয়ে দেখে সে, কৌতূহল নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে। ভাল করে দেখে আক্কেলগুড়ুম হয়ে যায়। আরে, একটা বাচ্চা, একদিন কি দুইদিন বয়স হবে।

তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে কে যেন এখানে ফেলে রেখে গেছে। জয়তুন বিবি স্বগতোক্তি করে, আহা, এই দুধের বাচ্চাডারে এইহানে কেডা ফালাইয়া গেলো গো! সে কোলে তুলে নেয় বাচ্চাটিকে। বুকটা ধক করে ওঠে সাথে সাথেই। বাচ্চাটা বেঁচে নেই, মরে গেছে, তার ক্ষুদ্র শরীরটাতে প্রাণের স্পন্দন নেই, দেহটি নীল হয়ে আছে। বোঝাই যায় গতকাল গভীর রাতে কেউ এখানে ফেলে দিয়ে গেছে।

মুখে ঠেসে দেয়া আছে কাপড়, যাতে সে চিৎকার করে কেঁদে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারে। জয়তুন বিবি তারস্বরে চিৎকার করে ওঠে। ডাস্টবিনটা যেখানে, তার আশেপাশে অনেকগুলো অটোমোবাইলের দোকান সারি সারি করে দাঁড় করানো। অনেক মেকানিক ছোকরা কাজ করছিলো। জয়তুন বিবিকে তারা অনেকদিন থেকেই চেনে, সে এই সময়ে এখানে ময়লা ফেলতে আসে।

কাজেই তার চিৎকারে চুপ করে বসে না থেকে তারা ব্যাপার দেখতে সেদিকে এগিয়ে যায়। দেখতে দেখতে সবগুলো দোকান থেকে মানুষজন ভেঙে পড়ে, পথ চলতি পথিকও ভীড় দেখে উঁকি দেয়। এসব খবর দ্রুত ছড়ায়। সংবাদপত্রের দুয়েকজন রিপোর্টারও চলে আসে, খবরের কাগজে এক কোণায় একটা ছোট্ট খবর হবে, কোন উদ্দাম তরুণ-তরুণীর ব্যভিচারের অবৈধ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ফসল তারা ঘরে রাখতে সাহস পায় নি, কাজেই ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে। *** সেই ডাস্টবিনের একপাশে রাস্তার ধারে একটা বিশাল গাছ।

সেই গাছে দুটো ছানা নিয়ে থাকতো এক পাখি। চেঁচামেচি শুনে অনেক আগে থেকেই তারা নিচে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি দেখছে, গভীর কৌতূহলে। পাখির ছানাগুলোর এখনো ভালোমতো চোখ ফোটে নি, সবকিছু জানতে তাদের মা পাখির ওপর নির্ভর করতে হয়। একটা ছানা কিচিরমিচির করে মা'কে জিজ্ঞেস করলো, ওরা কারা, মা? মা পাখি গলা ফুলিয়ে বলল, ওরা মানুষ। দো-পেয়ে মানুষ।

ওদের বুদ্ধি অনেক, বুদ্ধির সুবাদে শক্তিও অনেক। সবকিছুতেই ওরা সবার চেয়ে এগিয়ে আছে বলে ওদেরকে বলে সৃষ্টির সেরা জীব। নিচে কী হয়েছে? একটা মানুষের বাচ্চাকে কে যেন ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে গেছে। কে আবার, মানুষই হবে। এবার দ্বিতীয় ছানাটি জিজ্ঞেস করে, সৃষ্টির সেরা জীব নিজেদের বাচ্চাকে ময়লার মধ্যে ফেলে রেখে গেছে কেন, মা? মা পাখি বলে, এত কিছু তোমার জানতে হবে না, সোনা।

নাও, তোমার বাবা একটা ফড়িঙ ধরে এনেছে, এটা খাও। ছানাটির মুখে খাবার তুলে দেয় সে। মনে মনে ভাবে, বাচ্চাদের সে কী জবাব দেবে, যখন তারা জিজ্ঞেস করে যে নিজের সন্তানকে কী করে পিতামাতা আবর্জনার মতোই ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এসব তো সে কস্মিনকালেও শোনে নি। বোধহয় যুগ পাল্টেছে, এখন "ভোগ"-ই আসল, সন্তান কিছু নয়।

কিছু পাখি নিজের সন্তানকে ঠুকরে বাসা থেকে ফেলে দেয়, এটা সত্যি। কিন্তু ওরা তো মানুষ, পশুপাখি তো নয়, ওদের কী সমস্যা? নিজে অন্যায় করতে পারবে, আর অন্যায়ের ফল ভোগ করতে চাইবে না, রাতের অন্ধকারে সব ঢেকে ফেলতে চাইবে, এটা কী করে মানা যায়? জানি না বাপু, মানুষের ব্যাপারস্যাপার আমার মতো নগণ্য পাখির বোঝার ক্ষমতা বোধহয় নেই। কচি ছানা দুটোকে নিজের ডানা দিয়ে ঢেকে নেয় সে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।