আমি সত্য জানতে চাই
বাংলা ও অসমীয়াতে 'গণ সঙ্গীত" ধারার প্রতিষ্ঠাতা সঙ্গীতশিল্পী এবং সুরকার হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৮৭ সালের আজকের দিনে (২২ নভেম্বর) মৃত্যুবরণ করেন। বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী এবং সুরকার হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে তাঁর মৃ্ত্যুদিবসে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। অসমের বাঙালি কিম্বা অসমিয়া হয়ে উঠার অর্থ যে অন্তর থেকে অর্জিত প্রতিবেশি চেতনা, দীক্ষা এবং শিক্ষা তিনি তাঁর গোটা জীবন দিয়ে গেছেন তা তাঁর মৃত্যুর সাথে হারিয়ে যাবার নয়।
১৯১২র ১৪ জানুয়ারি তারিখে হেমাঙ্গ বিশ্বাস তখনকার অসমের , এখনকার বাংলাদেশের সিলেটের হবিগঞ্জের মিরাশি গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন।
তাঁর বাবা হরকুমার বিশ্বাস ছোটখাটো হলেও জমিদার ছিলেন। তখনকার দিনের মেট্রিক পাশ হলেও বাংলা ইংরেজি সংস্কৃতে তাঁর বেশ চর্চা এবং জ্ঞান ছিল। ফলে পাঁচ গাঁয়ের ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের মধ্যেও তাঁর বেশ সম্মান ছিল। মা সরোজিনী বিশ্বাসের পরিবারটিও সঙ্গীত কাব্য চর্চাতে সমৃদ্ধ ছিল।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস হবিগঞ্জ হাইস্কুল থেকে পাশ করার পর তিনি শ্রীহট্ট মুরারিচাঁদ কলেজে ভর্তি হন ।
ক্লাস সেভেনে পড়বার সময়ে বাবার হঠাৎ খেয়ালে তিনি চলে এলেন উজান অসমের ডিব্রুগড়ে। জর্জ হাইস্কুলে ভর্তি হলেন, থাকার ব্যবস্থা হলো বিখ্যাত ওম বাবার আশ্রম বা বিরাজ আশ্রমে। এখানে অসমিয়া গান কবিতা সাহিত্যের প্রতি তাঁর সমান আগ্রহে পেয়ে বসল। কিন্তু এখানে স্থায়ী হলেন না। ধর্মমতি বাবারই মনে হলো, এই আশ্রমে অধর্ম বেশ ঘাটি গেড়েছে।
নিয়ে গিয়ে আবার ভর্তি করে দিলেন হবিগঞ্জের সরকারী হাইস্কুলে। সেখানেই ১৯৩০শে তিনি মেট্রিক পাশ করেন।
হবিগঞ্জে তিনি যখন ছাত্র তখনি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গোটা ভারত চঞ্চল হতে শুরু করেছে।
সেখানে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন । ‘অনুশীলন সমিতি’তে যোগ দিয়ে কিছুদিন অনুশীলন করলেও, গান্ধির অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
সেই ১৯৩০এই ১৪৪ ধারা ভাঙার অপরাধে হেমাঙ্গের হাজতবাস হলো। বয়স তাঁর তখন মাত্র সতের। হবিগঞ্জ, সিলেট হয়ে পরে তাঁকে নগাওঁ জেলে নিয়ে আসা হয়। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে কারাবন্দী থাকাকালে তিনি যক্ষারোগে আক্রান্ত হন। তখন যক্ষা মানে মারণ রোগ! উপায়ুক্ত মোলান সাহেব রাজনীতি করবেন না বলে দাসখত লিখে দেবার শর্তে মুক্তি দিতে রাজি হলেন।
হেমাঙ্গ থুড়িই দেবেন! সরকার নিজেই পরে উপায় না দেখে মুক্তি দিল। মুক্তি পেয়ে হেমাঙ্গ ১৯৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দে বিনয় রায়, নিরঞ্জন সেন, দেবব্রত বিশ্বাস প্রমুখের সাথে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আই.পি.টি.এ গঠন করেন। পঞ্চাশের দশকে এই সংঘের শেষ অবধি তিনি এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন ।
"হিন্দু ঐক্য নয়, চাই শোষিত মানুষের ঐক্য...মানুসের সেবা, বিশেষতঃ, শোষিত জনগণের সেবা আমার ধর্ম। ” পরিবারের ভেতরে এরকম কিছু লড়াই করার কারণে ১৯৪২এ বাড়ি থেকে বিতাড়িত হন হেমাঙ্গ।
সে বছরই ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার প্রগতিশীল লেখক শিল্পীদের আমন্ত্রনে তিনি প্রথম কলকাতায় আসেন সঙ্গীত পরিবেশন করতে । ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর উদ্যোগে এবং জ্যোতিপ্রকাশ আগরওয়ালের সহযোগিতায় সিলেট গণনাট্য সংঘ তৈরি হয় । স্বাধীনতার আগে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের গানের সুরকারদের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রধান । ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তেলেঙ্গানা আন্দোলনের সময়ে তিনি গ্রেফতার হন এবং তিন বছর বন্দী থাকেন । ক’মাস পরে জেল থেকে ছাড়া পেলেন।
হেমাঙ্গ গিয়ে সিলেট মুরারি চাঁদ কলেজে বিজ্ঞানে নাম লেখালেন। কিন্তু আইন অমান্য আন্দোলনে সময় গান্ধির আহ্বানে প্রকাশ্য জনসভাতে নিজে আবার কলেজ ছাড়ার কথাও ঘোষণা করলেন। ইতি পড়ল তাঁর প্রথাগত শিক্ষাতে। ইতিমধ্যে কংগ্রেসে নেতাজি সুভাষের প্রভাব বাড়ছে। নেতাজি সিলেটে এলে সেই সভা সংগঠনে হেমাঙ্গ অগ্রণী ভূমিকা নিলেন।
সুভাষের প্রভাবেই হোক, আর বাড়ির কাছে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার মতো ঘটনার জন্যেই হোক, কিম্বা রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ , গোর্কির ‘মাদার’এর বাংলা অনুবাদ কিম্বা বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে ফেলবার জন্যেই হোক-- ধীরে ধীরে গান্ধির প্রতি তাঁর আকর্ষণ কমছিল। তাই নিজে থেকেও কিছু সঙ্গীকে নিয়ে এক সময় তিনি কংগ্রেসের স্বীকৃত পথের বাইরে গিয়ে কিছু রাজনৈতিক প্রচারে মন দিলেন। ফলে আবার গ্রেপ্তার। এবারে আড়াই বছর। আবারো একই জেল বদলের অনুক্রমে নগাওঁ এলেন, পরে গুয়াহাটিও গেলেন।
সে সময় একবার হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচঙে ম্যালেরিয়া রোগ মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এতে হাজার হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে। এ সময় বানিয়াচঙে মানুষের সেবাতে ছুটে গিয়েছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। সে সময়ই গান লিখেছিলেন, 'বাইন্যাচঙে প্রাণ বিদরী ম্যালেরিয়া মহামারী/হাজার হাজার নর-নারী মরছে অসহায়,/শান্তি ভরা সুখের দেহ/শূন্য আজি নাইরে কেহ/মৃত সন্তান বুকে লইয়া কান্দে বাপ-মায়...'
ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করেছে, ফ্যাসীবাদের বিপদ ঘণ্টাও আতঙ্কিত করে তুলেছে বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষকে। স্পেনের গৃহযুদ্ধে কডওয়েল , লোরকার মতো কবি বুদ্ধিজীবিদের মৃত্যুও লেখক শিল্পীদের আতঙ্কিত করতে শুরু করে।
রম্যাঁ রল্যাঁ, গোর্কি, আইনষ্টাইন, আদ্রেঁ জিদ প্রমুখদের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক স্তরে গড়ে উঠে ‘ফ্যাসীবাদ বিরোধী লেখক শিল্পী সঙ্ঘ’। এর সঙ্গে বিশ্ব জুড়েই কমিউনিষ্টরা ছিলেন বটে, কিন্তু কমিউনিষ্টরা ছাড়াও অনেকে এর সঙ্গে জুড়েছিলেন, ফ্যাসীবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা যারাই আক্রান্ত বোধ করছিলেন সেই সমস্ত লেখক শিল্পীরা। যেমন ভারতে এর সঙ্গে জুড়েছিলেন জহরলাল নেহরু, রবীন্দ্রনাথের, পণ্ডিত রবি শঙ্কর, পৃথ্বিরাজ কাপুর , বুদ্ধদেব বসুদের মতো ব্যক্তিত্বও । ১৯৩৬এ লক্ষ্ণৌতে এঁদের সবার উদ্যোগে এবং মুন্সি প্রেমচান্দের পৌরহিত্যে আয়োজিত হয় এর প্রথম অধিবেশন। ভারতে এর নাম হয় ‘সারা ভারত প্রগতিশীল লেখক শিল্পী সংঘ’ ।
এই সংগঠন দীর্ঘস্থায়ী না হলেও শিল্প সাহিত্যের অঙ্গনে ‘প্রগতিশীল’ শব্দটি এই সংঠনের নামের থেকেই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। পরের বছর রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে এর কলকাতা বা বঙ্গীয় শাখা গড়ে উঠে। ১৩৩৮এ কলকাতাতে সর্বভারতীয় সংগঠনটির দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি, জাপানের ভারতের দোরগড়াতে এসে ব্রহ্মদেশ আক্রমণ, ৪২এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সংগঠনে কিছু মতভেদ এবং বিশৃঙ্খলাও দেখা দেয়। কমিউনিষ্ট পার্টি তখন সাংস্কৃতিক কাজে কর্মে সরাসরি হস্তক্ষেপ করবার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৪৩এ পার্টির মুম্বাই কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গড়ে উঠে ভারতীয় গণ নাট্য সংঘ , যেটি পরে আই পি টি এ নামে বিখ্যাত হয়। কায়ফি আজমী, বলরাজ সাহনী, শংকর, শৈলেন্দ্র, পৃথ্বিরাজ কাপুরেরা উদ্যোগ নিয়ে সংগঠনটি গড়তে তোলেন। বাংলার প্রাদেশিক কমিটিতে মনোনীত হন সুনীল চ্যাটার্জী, দিলীপ রায়, সুধী প্রধান, বিজন ভট্টাচার্য,দেবব্রত বিশ্বাস , শম্ভু মিত্র, সুজাতা মুখার্জী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, স্নেহাংশু আচার্য, বিষ্ণু দে’র মতো ব্যক্তিত্ব। হেমাঙ্গ বিশ্বাস এর আগেই ১৯৪২এ তাঁর শিল্পীদল নিয়ে এসে কলকাতাতে অনুষ্ঠান করে গেছিলেন।
১৯৪৮এ খোয়াঙে অনুষ্ঠিত জনজাতি ছাত্র সম্মেলনে হাজির হয়ে গণনাট্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে জ্যোতিপ্রসাদের পরামর্শে।
১৯৫৫তে গুয়াহাটির জাজেস ময়দানে অসম গননাট্য সঙ্ঘের তৃতীয় অধিবেশনের আয়োজনে বিষ্ণু রাভা, ভূপেন হাজারিকা মূল উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গণনাট্যেরে স্বর্ণযুগে ১৯৫৫র গুয়াহাটি সম্মেলনই ছিল শেষ। ১৯৫১তে জ্যোতিপ্রসাদের অকাল প্রয়াণ হলো, ১৯৫৫র সম্মেলনের পর হেমাঙ্গও সুস্থ রইলেন না তেমন । হেমাঙ্গ বিশ্বাসের শরীরের সেই পুরোনো অসুখ মাঝে মধ্যেই চাগিয়ে উঠত। ১৯৫৮তে চিকিৎসার জন্যে তাঁকে চিনে পাঠানো হলো ।
চিনে গিয়েও অবসরে কাল কাটাবার মানুষতো আর তিনি নন, বিপ্লবোত্তর চিনকে দেখে নেবার বুঝে নেবার সুযোগ ছাড়বেন কেন? সেই অভিজ্ঞতাগুলো লিখে পাঠালেন ‘নতুন অসমীয়া’ কাগজে অসমিয়াতে। সম্পাদক তিলক হাজারিকা সেগুলো ধারাবাহিক ভাবে ছেপে গেলেন। পরে সেগুলোই সংকলিত করে প্রকাশ পায় ‘চীন চাই আহিলোঁ। ’ পরে এর বাংলা সংস্করণও প্রকাশিত হয়। অসমিয়া এবং বাংলা সাহিত্যে এই ভ্রমণ কাহিনির সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অপরিসীম! বিপ্লবোত্তর চিন সম্পর্কে এটি কেবল অসমিয়াতে নয়, যেকোনো ভারতীয় ভাষাতে প্রথম বই।
১৯৫৯তে তিনি পার্টি কর্মী রুনু দত্তকে বিয়ে করেন। পরের বছর তাঁর পুত্র মৈনাকের জন্ম।
চিন থেকে ফিরে আসার ক’দিন পরেই ১৯৬০ এর ভাষা আন্দোলন এবং পাশাপাশি ভাষা সংঘর্ষ শুরু হয়। সেই সময় তিনি ভূপেন হাজারিকাকে সঙ্গে নিয়ে নানা ভাষা সম্প্রদায় থেকে শিল্পী নিয়ে শিলং থেকে যাত্রা শুরু করেন। ‘Let us meet cultural troupe’ ছিল নতুন স্কোয়াডের নাম।
বিখ্যাত ‘হারাধন –রংমনে’র গীতি আলেখ্য সহ আরো প্রচুর গান, কবিতা, নাটক নিয়ে দু’ই তাঁরা যেন সংগ্রামী ঐক্যের যুদ্ধ জয় করলেন। বাংলা অসমিয়াতে ভূপেন হাজারিকার সাগর সঙ্গমে গানটিও ছিল সেই অভিযানের অন্যতম জনপ্রিয় গান। যে দিকে গেলেন, গানের সুরেই দাঙ্গাবাজদের প্রতিহত করতে করতেই এগুলেন তাঁরা।
১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর ‘মাস সিঙ্গার্সে’র সঙ্গী রত্না সরকার, প্রীতি চৌধুরী, মিঠুন মুখার্জি, টুঙ্কু সরকার ও দীপক পাত্রকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গেছিলেন বাংলাদেশে । পুরোনো সংগ্রামী সাথি নজরুল ইসলাম খানের গোপীবাগের বাড়িতে উঠেছিলেন।
তাঁর সে ভ্রমণের উদ্যোক্তাদের মধ্যে সেদেশের প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী তাত্বিক বদরুদ্দীন উমরও ছিলেন । ছিলেন ফকির আলমগীরের মতো শিল্পীরাও। সেবারে ঢাকাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে গান গেয়ে গেয়ে যোগ দিয়েছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে ঢাকার ২৭টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের জোট 'গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রন্ট' হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে সংবর্ধনা দিয়েছিল । দেশ ছেড়ে আসার পর এই প্রথম এবং শেষবারের জন্যে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন তার পৈতৃক ভিটে হবিগঞ্জের মিরাশি গ্রাম।
জয়দেবপুরে গিয়েছিলেন কবি গোবিন্দ দাস ও কবিয়ালগুরু হরি আচার্যের ভিটে দেখতে। তিনি সেদিন গোবিন্দ দাসের একটি গান সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন ফকির আলমগীরকে , "স্বদেশ স্বদেশ করছ যারে, এদেশ তোমার নয়। ” সত্যিতো যে দেশকে বাল্যে নিজের বলে জেনেছিলেন, সেই দেশই তাঁর রইল না! তাঁর একখানা গান রয়েছে,” হবিগঞ্জের জালালি কইতর, সুনাম গঞ্জের কুড়া, সুরমানদীর গাংচিল আমি শূণ্যে দিলাম উড়া/শূণ্যে দিলাম উড়ারে ভাই যাইতে চান্দের চর/ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাতার উপর/তোমরা আমায় চিননি/তোমরা আমায় চিননি। ” তাঁকে চেনাতো সত্যি আমাদের এখনো অনেক বাকি। কলকাতা প্রবাস তাঁকে যে সুখি করতে পারেনি এওতো এই গানে বোঝাই যায়।
কলকাতা সত্যি তাঁকে আজও তেমন চেনেও নি, জীবনের শেষ দিকে বোধহয় দুটো মাত্র কেসেট বেরিয়েছিল এই মহান শিল্পীর। নিজে তিনি কখনোই সেরকম প্রকাশক খোঁজে ফেরেনও নি। হবিগঞ্জের মিরাশি গ্রাম, সুরমা নদী নিশ্চয় তাঁর স্মৃতিকে ভারাতুর করে তুলত। কিন্তু ভুলে থাকতে পারতেন না ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে তাঁর জীবনের সবচে’ উজ্জ্বল দিনগুলোকেও । সেতো তাঁর কলকাতার বাড়ির নামেই প্রকাশ-- ‘জিরণি’।
আর একমাত্র কন্যার নাম রেখেছিলেন –‘রঙিলী’।
সিলেট থেকে যাত্রা শুরু করে জীবনের এক উজ্জ্বল অধ্যায় অসমে যাপন করলেও বাংলা এবং অসমীয়াতে ‘গণ সঙ্গীতে’র ধারাটি প্রতিষ্ঠা পায় হেমাঙ্গ বিশ্বাসের দৃঢ় সাংগঠনিক এবং তাত্বিক অবস্থানের জন্যেই। গণসঙ্গীতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, “স্বাদেশিকতার ধারা যেখানে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার মহাসাগরে গিয়ে মিলেছে, সেই মোহনায় গণসঙ্গীতের জন্ম। ” শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যেমন ‘ঘরানা’, তার বিপরীতে লোক সঙ্গীতের ‘বাহিরানা’ নিয়েও তাঁর চিন্তা পরের চিন্তকদের ভাবনার দিশা দিয়েছে। সুরমা ভ্যালি কালচারাল স্কোয়াডের এবং গণনাট্যের শুরুর দিনগুলোতে তৈরি হয় তাঁর বিখ্যাত গান ‘তোমার কাস্তেটারে দিও জোরে শান’।
তখন এবং পরের জীবনে তাঁর লেখা এবং গাওয়া বিখ্যাত গানগুলো হলোঃ শঙ্খচিলের গান, জন হেনরীর গান, মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য, বাঁচব বাঁচব রে আমরা, মশাল জ্বালো, সেলাম চাচা, আমি যে দেখেছি সেই দেশ,‘হবিগঞ্জের জালালী কইতর সুনামগঞ্জের কুড়া’, ‘ও সোনা বন্ধুরে’, ‘আমার মন কান্দে পদ্মার চরের লাইগ্যা’ । ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘লালন ফকির’ ইত্যাদি ছায়াছবিতে, যাত্রাপালা ‘লেনিন’এ এবং কল্লোল, তীর, লাললণ্ঠন ইত্যাদি নাটকে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন । ‘লাললন্ঠন’ নাটকে তিনি বিভিন্ন চিনা সুর ব্যবহার করেছিলেন । তিনবার চিনে গিয়ে চিনা ভাষাটাও তিনি অনেক রপ্ত করেছিলেন। ফলে বেশ কিছু চিনা গান কবিতা বাংলাতে অনুবাদও করেছিলেন।
এছাড়াও দেশ বিদেশের প্রচুর বিখ্যাত গানকে তিনি ওমন ভাবে বাংলাতে অনুবাদ করে জনপ্রিয় করেছিলেন যে সাধারণ শ্রোতাদের অনেকেই এগুলোকে হেমাঙ্গের বিশুদ্ধ বাংলা বলেই জানেন এখনো। যেমন পিট সিগার কলকাতার ময়দানে এসে গেয়েছিলেন ‘উই শ্যাল অভার কাম। ’ হেমাঙ্গকে তিনিই ডেকে তুললেন মঞ্চে । তিনি গাইলেন ‘আমরা করব জয়। ’ এটি এর পর নানা ভাষাতে অনুদিত হয়ে এতো জনপ্রিয় হয় যে গোটা ভারত জয় করে।
লোকসঙ্গীতকে কেন্দ্র করে গণসঙ্গীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের অবদান উল্লেখযোগ্য। 'গণ সঙ্গীত" ধারার প্রতিষ্ঠাতা বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী এবং সুরকার হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে তাঁর মৃ্ত্যুদিবসে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
তথ্যসূত্রঃ
সঙ্গীতশিল্পী এবং সুরকার হেমাঙ্গ বিশ্বাস
১) হেমাঙ্গ বিশ্বাসঃ সাংস্কৃতিক চেতনার অমল সুবাস; সুভাষ সুরভি
২) হেমাঙ্গ বিশ্বাস; তপন মহন্ত; নাইন্থ কলাম’অসমের কৃতী বাঙালি
৩) সুরমা থেকে ভোলগা; শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার।
৪) বাংলা গণসঙ্গীত আন্দোলন ও হেমাঙ্গ বিশ্বাস; মাহফুজুর রহমান;সমকাল।
৫) ছবি নেট থেকে প্রপ্ত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।