আমার কথা সিরিয়াসলি নিয়া বাঁশ খাইলে নিজ দায়িত্বে বাঁশ খাইয়েন মিসেস সালামের বয়স এখন বায়ান্ন। এক ছেলে-এক মেয়ের জননী। ছেলের বিয়ে দিয়ে নাতনীর মুখও দেখে ফেলেছেন। কিন্তু শরীরের গড়ন দেখে বোঝার উপায় নেই যে তার বয়স পঞ্চাশের ঘরে। মেয়ে আর বউয়ের পাশে এখনও তাকে বড় বোনের মত মনে হয়।
কিন্তু মনে হওয়াই তো শেষ কথা নয়। আজকাল একটু হাটাহাটি করলে তার কোমর ব্যাথা শুরু হয়। আগে একা একাই শপিং-এ যেতেন। কিন্তু আজকাল আর তা পারেন না। শপিংব্যাগগুলো টানার জন্য মানুষের দরকার।
ছেলের বউ আসার পর বউই তার শপিং-এর সঙ্গি হয়েছিল। কিন্তু মিসেস সালামের নাতনী জন্ম নেয়ার পর শপিং-এ যাওয়া বউটার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে। এখন মিসেস সালামের এক মাত্র সম্বল তার মেয়েটা!
কিন্তু মেয়েটা হয়েছে বদের হাড্ডি!জান যাবে তবু শপিং-এ যাবে না। শপিং-এ গেলে নাকি তার সব এনার্জি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু শপিং-এ যাওয়ার সময় ব্যাগ টানার জন্য একটা মানুষ না থাকলেই নয়।
উপায়ন্ত না দেখে মিসেস সালাম তার মেয়েকে টোপ দিলেন। বললেন, “তুই যদি আমার সাথে শপিং-এ যাস,তাহলে তোকে চাইনিজ খাওয়াবো!”
মেয়েটার আবার বাইরের খানাদানার প্রতি বেশ দূর্বলতা!এমন অফার সে হাতছাড়া করতে পারবেনা। কিন্তু তারপরেও সে দোটানায় পরে গেল। তার আম্মুর সাথে শপিং-এ যেতে তার আসলে ভয় লাগে। তার আম্মু শপিং-এ গিয়ে একটা জিনিস কেনার জন্য কমপক্ষে পনেরটা দোকান ঘুরবে।
অতঃপর কোনোটা পছন্দ হলে জিজ্ঞাসা করবে, “আচ্ছা,এটার দাম কত?”
বিক্রেতা বলবে, “আপা,এক দাম ্০০০ টাকা। ”
অতঃপর মেয়েটির মা ওরফে মিসেস সালাম বলবেন, “ওহ এটা একদামের দোকান নাকি?স্যরি!”
মিসেস সালাম যখন বের হয়ে যেতে নেবেন তখন বিক্রেতা বলবে, “আহা আপা কই যান?একদাম বলেছি বলেই কি একদাম নাকি?আপনি কত হলে নেবেন?”
মিসেস সালাম তখন খুব স্বাভাবিক ভাবে বলবেন, “ওটা ৩০০টাকায় দেবেন?”
এই কথা শুনে মেয়েটার ভীষন আতংক লাগে। আশ্চর্য,কিভাবে মানুষ ৩,০০০টাকার একটা জিনিস্র দাম ৩০০টাকা বলে?মেয়েটার মনে হয় এখনি হয়তো বিক্রেতা তাকে আর তার মাকে গলা ধাক্কা দিয়ে দোকান থেকে বের করে দেবে। এই ভেবে যখন মেয়েটা পালানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে তখনি সে বিক্রেতার মধুর কন্ঠ শুনে আবার সোজা হয়।
বিক্রেতা বলে, “আপা এইটা কি দাম বললেন?এই দামে কিভাবে দিব?”
এই কথা শুনে মিসেস সালাম আবার দোকান থেকে বের হয়ে যেতে চান।
তখন আবার বিক্রেতা বলেন, “আপা আর একটু বাড়ান!”
এই ভাবে কিছুক্ষন নাটক চলার পর মেয়েটির মা ওরফে মিসেস সালাম জিনিসটি কিনে ফেলেন। কিন্তু মেয়েটার ততক্ষনে বিক্রেতা আর তার মায়ের কান্ড কারখানা দেখে শ্বাসকষ্ট হওয়ার জোগার হয়(মেয়েটির যদিও শ্বাসকষ্ট নাই। কিন্তু তার নানার শ্বাসকষ্ট ছিল। তাহলে মেয়েটার শ্বাসকষ্ট হতে কতক্ষন?)।
যাই হোক,অনেক আতংক থাকার পরেও মেয়েটা তার মায়ের প্রস্তাবে রাজী হয়।
তার মা কেনাকাটা করতে গেলে এরপর থেকে সেও তার মায়ের সঙ্গী হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা সে তার মায়ের পিছে পিছে ঘোরাঘুরি করে মায়ের শপিং করা দেখে।
একটা সময় ছিল যখন মেয়েটা খুব ছোট ছিল। তার মায়ের সাথে শপিং গিয়ে হেটে হেটে বিরক্ত হয়ে মেয়েটা কান্না কাটি শুরু করলে মেয়েটার মা তাকে এক পিস চুইংগাম কিনে দিত। সেটা পেয়ে মেয়েটা কিছু সময় চুপ থেকে আবার কান্নাকাটি শুরু করত।
তখন আসলে মেয়েটা বিরক্ত হয়ে কাদত না। কাদত আবার চুইংগাম খাওয়ার জন্য। কিন্তু তখন আর কেদে কাজ হত না। মেয়েটার মা তখন সবার আড়ালে মেয়েটাকে কষিয়ে একটা চিমটি দিয়ে দিত। চিমটি খেয়ে মেয়েটা চুপ হয়ে যেত।
এখনো মায়ের সাথে শপিং-এ গেলে মেয়েটার ইচ্ছা করে ছোটবেলার মত বিরক্তিতে কাদতে। কিন্তু সে অনেক কষ্টে বিরক্তি চাপিয়ে রাখে। এই সবই সে করে কেবল একটু ভালমন্দ খাওয়ার আশায়।
মিসেস সালামও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। শপিং থেকে ফেরার পথে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে মেয়েকে ঘুষ দিয়ে দেন!
কিন্তু মেয়েটা তো বদের হাড্ডি।
রেস্টুরেন্টে গিয়েই অর্ডার দেবে, “এই যে ভাইয়া,দুইটা মুরগীর রান নিয়া আসেন!সাথে থাই স্যুপ!”
মেয়ের মুরগীর রান আর থাই স্যুপ খাওয়া শেষ হতে দেখলে মিসেস সালাম যেই বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেবেন তখন তার গুন্ধর কন্যা বলবে, “আম্মু কই যাও?আমার খাওয়া তো শেষ হয়নাই!এখনো তো কোক খাই নাই!”
মিসেস সালামের মাথা গরম হয়ে যায়। তিনি তেজ দেখিয়ে বলেন, “বাসায় কোক আছে!বাসায় গিয়ে কোক খাইস!”
কিন্তু মেয়ে তো ইবলিসের সকল ছলাকলা মুখস্থ করে রেখেছে। মেয়ে খুব গদগদ ভাব করে তার মাকে বলবে, “আম্মু তুমি হাজী মোহাম্মদ মহসীন!ভালো খানাপিনা খেয়ে কোক না খাইলে আমার মনটা উদাস উদাস লাগে!”
মেয়ের এহেন ছলাকলায় মিসেস সালাম কোক কিনে দিতেই বাধ্য হন। মেয়ে কোকের বোতল হাতে নিয়ে মায়ের পিছন পিছন ছোটে!বাসায় ফেরার পুরো পথটায় মিসেস সালাম তার মেয়ের সাথে গজগজ করতে থাকেন। আর তার গুনবতী কন্যা উদাস ভঙ্গীতে সিটে হেলান দিয়ে চুকচুক করে কোক গেলে।
সেদিনও প্রতিদিনের মত মিসেস সালাম তার মেয়েকে নিয়ে শপিং-এ গেলেন। পুরো শপিং-এ মেয়ে ভদ্র ভাবে তার সাথে ঘুরল। অতঃপর ফেরার পথে গাড়িতে ওঠার পর মিসেস সালামের মনে পরল যে আজকে তিনি তার মেয়েকে ঘুষ দেন নি।
তিনি মেয়েকে বললেন, “আজকে কোন রেস্টুরেন্টে খাবা?”
মেয়ে বলল, “আজকে খাবো না। বাসায় চল।
”
মিসেস সালাম অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভারকে প্রিন্সের সামনে গাড়ি রাখতে বললেন। অতঃপর প্রিন্সে গিয়ে নিজেই চপসি অর্ডার করল। মায়ের এহেন মহানুভবতা দেখে মেয়ে টস্কিতো!
মেয়ে তার মাকে জিজ্ঞাসা করল, “হঠাৎ এত মহানুভতা কি মনে করে আম্মু?বিয়া-শাদী দিবা নাকি?(একটা বয়সের পর মা-মেয়ে বন্ধু হয়ে যায়। এই টাইপ কথা বলাটা অস্বাভাবিক কিছু না!”
মিসেস সালাম মেয়ের কথায় হেসে বললেন, “তুমি কি নিজেরে বিশ্ব সুন্দরী ভাবো নাকি যে তোমারে বিয়া দেয়ার জন্য তোমারে আমার চপসি খাওয়াইতে হবে?”
মেয়ে পালটা জবাব দিল, “তাইলে এত দয়া দেখানোর হেতু কি?”
মিসেস সালামের কন্ঠটা হঠাৎ বেশ ভারী হয়ে উঠল। ভেজা ভেজা গলায় বলতে লাগলেন, “তোরা যখন ছোট ছিলি তখন তোর আব্বুর বেতন এত কম ছিল আর এত বার্ডেন ছিল যে তোরা চাইলেও কিছু দিতে পারতাম না।
একবার তুই ছাইয়্যা-ছাইয়্যা পুতুলের জন্য কান্না করলি। কিন্তু দিতে পারিনাই। এখন মানুষের ছেলে মেয়েদের দেখলে অবাক লাগে। চাওয়ার আগেই সব পেয়ে যায়। কিন্তু আমরা তোদের দিতে পারিনাই।
তাই এখন সেইটা পূর্ণ করে দিতে ইচ্ছা করে!”
মেয়েটা তার মায়ের কথা শুনে আবেগ আপ্লুত হয়ে গেল। তারও গলাটা বেশ ভারী ভারী যখন হয়ে এসেছে তখনি চপসি হাজির!মেয়েটা তার মায়ের প্লেটে চপসি দিতে দিতে ভারী গলায় বলল, “আম্মু,ছোটোবেলায় যে অনেক কিছু দিতে পারো নাই,তাতে কিন্তু একদিক থেকে বেশ ভালোই হইছে!”
ফাজিল মেয়ের গলায় এমন ভারিক্কি কথা শুনে মিসেস সালাম হয়তো ভেবেছিলেন মেয়ে বলবে, “সব কিছু কম কম পাওয়ার কারনেই এখন আমাদের চাহিদা কম অথবা আমরা এখন অল্পতেই খুশি হই কিংবা এই টাইপ কিছু!”
কিন্তু মেয়ে সেই সব কোনো কথাই না বলে বলল, “ছোটবেলায় তুমি সব কিছু কম কম দিয়েছো বলেই এখন তোমার ভিতর অনুতাপ কাজ করে। আর এই চান্সে আমি তোমারে ভাঙ্গায়ে খাইতেছি!ভালো না?ভালো তো!”
মিসেস সালাম মেয়ের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার সমস্যা হইল তুমি সব কিছুরেই ফাইজলামী মনে কর!”
মেয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আবার চপসি খেতে শুরু করল।
মেয়ের মনের কথা যদি মিসেস সালামের শোনার ক্ষমতা থাকত তাহলে হয়তো শুনতে পেতেন মেয়ে বলছে, “আম্মু,হয়তো আমি একটু ফাজিল। কিন্তু তাই বলে যে আমি যে তোমার কষ্ট বুঝিনা-তা কিন্তু না।
আমি অতি সিরিয়াসনেস দেখাতে গিয়ে তোমার চোখের পানি দেখতে পারব না। এতটা সিরিয়াস হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তার চেয়ে আমি বরং ফাজিলই থাকব!”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।