আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেশভাগ একটি ভুল ছিল

ভারত-পাকিস্তানের দেশভাগ একটি ভুল ছিল বলে মন্তব্য করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট কুলদীপ নায়ার। তিনি বলেন, ‘হিন্দু-মুসলিম-ভারতীয়-পাকিস্তানি এসব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে এখন আমাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো ঐক্যবদ্ধ একটি দক্ষিণ এশিয়া গড়তে হবে। ’ আজ শুক্রবার বাংলা একাডেমীর নতুন মিলনায়তনে নিজের আত্মজীবনী ‘বিয়ন্ড দা লাইনস’-এর প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠানে কুলদীপ নায়ার এসব কথা বলেন। ‘ডেইলি স্টার’ তাঁর আত্মজীবনীমূলক এই বইটি প্রকাশ করেছে। অনুষ্ঠানে কুলদীপ নায়ার বলেন, ‘বইটিতে আমি ইতিহাসের অনেক ঘটনা লিখেছি।

কিন্তু দেশ বিভাগের পর যে মুহূর্তে আমি পাকিস্তান ছাড়ি, আমার পরিবারের সঙ্গে বিদায়ের সময় কান্নার যে মুহূর্ত—এমন অনেক কিছুই আমি তুলে ধরতে (ক্যাপচার) পারিনি। ’ কুলদীপ নায়ার বলেন, ‘দেশ বিভাগের পর লাখ লাখ উদ্বাস্তু মানুষ যখন দেশ ছাড়ছিল, তখন হেলিকপ্টার থেকে তা দেখে জিন্নাহ কপাল চাপড়ে বলেছিলেন, এ তিনি কী করলেন? আমার অনুভূতি হলো, দেশ বিভাগ ভুল ছিল। দেশ বিভাগের প্রেক্ষিত না হলে এই উপমহাদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা হতো না। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর আমরা ভেবেছিলাম, এমন একটি ভারত গড়ব যেখানে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। কিন্তু গুজরাটে আমাকে সেই একই ঘটনা দেখতে হয়েছে।

’ ঐক্যবদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া গড়ার ওপর জোর দিয়ে কুলদীপ নায়ার বলেন, ‘আমরা হিন্দু-মুসলমান-ভারতীয়-পাকিস্তানি-বাংলাদেশি যা-ই হই না কেন, এসব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ হিসেবে গর্ব করতে পারি। আমাদের পরস্পরকে সহযোগিতা করার যে অভাব, সেটি দূর করতে হবে। এই অঞ্চলের মানুষ আজকে পশ্চিমা বিশ্বে ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা ঐক্যবদ্ধ হলে তাদেরই একদিন এখানে আসতে হবে। ’ প্রখ্যাত এই সাংবাদিক বলেন, ‘ধন-সম্পদ-ক্ষমতা দিয়ে মানুষকে মূল্যায়ন করলে চলবে না।

মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে তাঁর মূল্যবোধ দিয়ে। তাই মূল্যবোধ বজায় রাখতে হবে। যে পরিণতিই হোক না কেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেই চুপ না থেকে প্রতিবাদ করতে হবে। ’ বই নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, ‘১৯৭১ সালে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। এই উপমহাদেশের নানা ইতিহাস, নানা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তিনি।

আর সেগুলোই তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। এর মধ্যে একটি বিষয় লক্ষণীয়, সারা জীবনই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সাম্যবাদী সমাজ এগুলোর পক্ষে যুদ্ধ করেছেন কুলদীপ নায়ার। ’ গণফোরামের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘“বিয়ন্ড দা লাইনস” একটি অসাধারণ বই, কারণ অসাধারণ একজন মানুষ এই বইটি লিখেছেন, যেখানে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো ফুটে উঠেছে। কুলদীপ নায়ারের যে বিষয়টির কথা উল্লেখ করতে হয় তা হলো, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা, তাঁর যে প্রতিশ্রুতি, এর কোনো তুলনা হয় না। এই বয়সেও তিনি তাঁর লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি।

তিনি তরুণদের অনুপ্রাণিত করছেন এখনো। ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেবেকা হক বইটির ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, নৈতিক দিক থেকে সব সময় শক্ত ছিলেন কুলদীপ এবং তিনি ছোটবেলায় তাঁর মায়ের কাছ থেকেই এই শিক্ষা পেয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, ‘এই বই কেবল একটি ইতিহাস নয়, একটি বিশ্বকোষ। এই বইয়ের মধ্যে এত ব্যক্তি রয়েছেন যাঁরা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের রূপকার।

দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ ও ইতিহাস বুঝতে এই বই একটি প্রামাণ্য দলিল। আরেকটি বিষয়, বইটি আত্মজীবনী হলেও লেখক নিজেকে আড়াল করেছেন। ’ অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘“ডেইলি স্টার”-এর প্রতিষ্ঠাতা এস এম আলীর সঙ্গে কুলদীপের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল এবং আমার সঙ্গেও তা অব্যাহত আছে। বিভিন্ন সময় সাংবাদিকতা নিয়ে তিনি আমাকে পরামর্শ দেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক এই বইটি প্রকাশনার মধ্য দিয়ে আমরা বই প্রকাশ শুরু করলাম।

’ মাহফুজ আনাম বলেন, ‘২০ বছর আগে কুলদীপ নায়ার পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার কাজও করেছেন তিনি। তিনি সত্যিকারভাবেই বাংলাদেশের বন্ধু এবং বিভিন্ন সময় তিনি বাংলাদেশের পক্ষে থাকেন। তিনি বিশ্বাস করেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এক হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো শক্তিশালী হতে পারে। ’ ‘প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তানের বিভক্তি, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, এ সবকিছুই বইটিতে তুলে ধরেছেন কুলদীপ নায়ার।

আসলে তাঁর যে অভিজ্ঞতা, তা দিয়ে পাঁচ হাজার পৃষ্ঠার একটি বই হতে পারত। ’ কুলদীপের জীবনী তুলে ধরে মতিউর রহমান বলেন, ১৯২০ সালে পাকিস্তানের শিয়ালকোটে জন্ম কুলদীপ নায়ারের। দেশ বিভাগের সময় তাঁকে ভারতে চলে আসতে হয়। দিল্লিতে এসে তিনি একটি উর্দু পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরে ভারতীয় একটি বার্তা সংস্থায় এবং তারপর ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় যোগ দেন।

এক বছরের বিরতি ছাড়া দীর্ঘ ৪৫ বছর তিনি বিয়ন্ড দ্য লাইন শিরোনামে কলাম লিখেছেন। ১৪টি ভাষার ৮০টি পত্রিকায় তাঁর ওই কলাম ছাপা হয়েছে। মতিউর রহমান আরও বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সামরিক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে যুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা জেনে প্রতিদিন তিনি ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় লিখেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু, দুই নেত্রী, ড. ইউনূসের রাজনীতি—এসব নিয়েও তিনি বিস্তারিত লিখেছেন বইটিতে। দুটি বিষয় নিয়ে তিনি এখনো কাজ করছেন।

তিনি মনে করেন, লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনো ঘটনা আছে। তিনি সেই কারণ খুঁজে ফিরছেন। এ ছাড়া জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে লেডি মাউন্টব্যাটনের একটি সম্পর্ক ছিল, যা নিয়ে এখনো অনুসন্ধান করছেন কুলদীপ। মতিউর রহমান বলেন, গণতন্ত্র, তথ্য-অধিকার, মানবাধিকার এসব নিয়ে বরাবরই উচ্চকণ্ঠ কুলদীপ নায়ার। ইতিহাস, বাংলা, সাংবাদিকতা, সর্বোপরি যাঁরা দক্ষিণ এশিয়া বুঝতে চান, তাঁদের জন্য একটি অসাধারণ দলিল এই বই।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.