'মানুষ কাছে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়' মধ্যবিত্তের মান কোন চরায় গিয়ে ঠেকে ! পূর্ববঙ্গের বাস্তুহারা এক স্কুলমাস্টারের খেদোক্তি এটা । ততোদিনে সব শ্যাষ । দেশ ভাগ হয়েছে । পূর্ববঙ্গের স্কুলমাস্টারের বিশাল পরিবারের ঠাই হয়েছে কলকাতার এক গিঞ্জি বস্তিতে । চক্রবর্তী মশায় অনেক কষ্টেসৃষ্টে একটা স্কুলে চাকুরীও জুটিয়ে নিয়েছেন ।
কিন্তু সংসারের চাকা যে সেই চরকার তেলে চলেনা , টিউশনি দিয়েও ছ'জনের সংসারের রাশ টানা যাচ্ছেনা । সোমত্ত দুই মেয়ে,ধাড়ি দুই দুইটা ছেলে আর কর্তা গিন্নি এই নিয়েই বাঁশের বেড়া আর হোগলা পাতার ছাউনি দিয়ে আটকানো ছোটো ছোটো তিনখানা ঘর নিয়ে চক্রবর্তী মশায়ের সংসার । বড় ছেলে কোনোরকমে টেনেঠুনে পাশটাশ করে বেকার । তবে তার অসম্ভব ভাল গানের গলা ; প্রতিদিন নিয়ম করে রেওয়াজও করে ।
তারপর নীতা ।
ভালো ছাত্রী । পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে । তারপর আরেক ভাই সবার ছোটো গীতা । ও হ্যা , নীতাই আমাদের আজকের প্রধান চরিত্র যাকে কেন্দ্র করে আমরা কিছু বিষয়কে গতকালের আজকের আগামীর চোখে দেখবো । সেই দেখাতে মোহ-সম্মোহ দুই ই থাকতে পারে কিংবা বিপরীতটাও , তাতে বরং কিছু যায় আসেনা ।
বাঙালি আট দশটা মেয়ের মতোই আমাদের নীতা । সাদামাটা নম্র ভদ্র শিক্ষিত। প্রকৃতির ঘুরপাকেই প্রেম আসে নীতার জীবনে । ছেলেটা যথেষ্ট মেধাবী সৎ এবং পদার্থ বিজ্ঞানে ভালো ডিগ্রীধারী । নীতার স্বপ্ন সনৎ গবেষনা করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে , তাই তার চাকরি বাকরি এখন ই তার জন্যে না ।
নীতা টিউশনির টাকা বাঁচিয়ে সনৎকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য সহযোগীতা করে । নীতাও এমএ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে ।
এর ই মাঝে সংসারের হিসাব নিকাশ একটু এলোমেলো হয়ে যায় । নীতার বাবা স্ট্রোকে অচল হয়ে যান । সংসারের হাল নীতার ঘাড়েই চেপে বসে ।
নীতার বাধ্য হয়েই একটা চাকরি নিতেই হয় । প্রতিদিন ই সকাল সন্ধ্যা অফিস করতে করতে নীতাও কেমন জানি হয়ে যায় । সনৎও নীতার চাকরি করা মেনে নিতে পারেনা , শংকর বড়ছেলে নীতাদের সংসারে সেই সংসারের হাল ধরবে তা না নীতা ক্যান সংসারের ঘানি টানবে , এই যুক্তি সনতের কিন্তু নীতা যে উমা! তার কী কোনো যুক্তি থাকে ! নীতার কথা একটাই আমি করবো নাতো কে করবে , বেশ তো আমার জন্যে একটা কাঠের একটা বাক্স বানাও তাতে আমাকে আটকে রাখো । সনতও বদলে যায় , জানে উমাকে ভালবেসে পুজো দেয়া যায় স্ত্রী করা যায়না ! তাইতো নীতার বোন গীতাকে হুটহাট বিয়ে করে বসে । ভাল মাইনের চাকুরিও একটা জুটিয়ে নেয় ।
নীতার বড়ো ভাই সনত আর গীতার বিয়ে মেনে নিতে পারেনা , তাই বিয়ের রাতেই শংকর প্রতিবাদ স্বরূপ ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যায় ।
সবাই যার যার দায়িত্ব ছেড়ে পালালেও নীতা কী পালাতে পারে ! নীতা যে উমা ! দেবি উমার কি পালাতে আছে , পালালে যে উমা আর উমা থাকেন না । শতো কষ্টেও উমাদের দায়িত্ব পালন করে য্বত্ব হয় । রোগ-শোক, জ্বরায়ও তাদের কর্তব্য পালনে অবহেলা করতে নেই , দুখের কথা, রোগের কথা কাউকেই বলতে নেই । নীতার দিনরাত খাটুনীর ফল হাতেনাতে ফল দেয় , নীতার রাজরোগ দেখা দেয় ।
রোগ হবে সে কী আর সাদামাটা রোগব্যাধি হলে চলে ! এবার বুঝি প্রকৃত উমা দেবির পুরো ভর নীতার উপরে!দেবি বুঝি নীতাকে প্রকৃত উমাজ্ঞান করে যক্ষাব্যাধি উপহার দেয় । দেবির কি সাধারন হলে চলে , তাই নীতাও আলাদা ঘরে স্থান হয় এমনকী থালা বাসনও আলাদা হয়ে যায় ।
মেঘে মেঘে বরষা নামে শঙ্করও দিল্লি থেকে নাম কামিয়ে বাড়িতে আসে । এখন সে যথেষ্ট টাকা পয়সা কামিয়েছে । কিন্তু নীতা তো তখন যোজন যোজন দুরে ।
নীতার যক্ষা শংকর যেনে যায় । সেই রাত্রেই স্কুলমাস্টার বাবার আদেশে নীতা ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় । নীতার কাজ ছিলো পরিবারটিকে দাড় করিয়ে দেয়া সেটা সে ভালোভাবে করতে পেরেছে । নীতার এখন ছুটি ।
ফ্ল্যাশব্যাক ... নীতা যক্ষা হসপিটালে ভর্তি ।
শংকরদের দোতলা বাড়ি উঠেছে , গীতার এক ছেলে হয়েছে এখন সারা বাড়িময় ছুটাছুটি করে । এরই মাঝে গীতার চিৎকার হাহাকার আর্তনাদ দাদা আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম , আমি বাঁচতে চাই দাদা...আমার যে বাঁচার বড় শখ দাদা... শংকর শুধু প্রতিউত্তরে বলে , তুই কি পাগল হয়ে গেলি ! মানে কী নীতার বেঁচে থাকাটা আর কোনো যৌক্তিকতা নেই , সে যে দেবি , উমা !
আবার ফ্ল্যাশব্যাক শংকর বাড়ি ফিরছে... বংশীদা'র দোকানের সামনে এসে কী মনে করে থমকে দাঁড়ায় । বংশীদা নীতার কথা জিজ্ঞেস করে, শংকর উত্তরে কিছুই বলতে পারেনা । বংশীদা তখন আপন মনে নীতার স্মৃতি মনে করে বকবক করে । এখানে উল্লেখ্য যে, এই বংশীদা'ই নীতাকে 'সিন্ধুবাদ নাবিক' বলতো !
তারপর ক্যামেরার লেন্স একটু নতুন কাকর কংক্রিট মেশানো পথের দিকে চলে যায় ।
একটা মেয়ে হেটে যাচ্ছে...নীতার মতো সাদামাটা ধরনের, হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে অর জুতোর একপাটি ছিঁড়ে যায় । মেয়েটা কেমন জানি বিব্রতবোধ করেই জুতোজোরা হাতে নিয়ে চলতে থাকে । এখানে খেয়াল করতে হবে যে এই কাহিনি শুরুর দ্বিতীয় ফ্ল্যাশব্যাকেই ঠিক একইভাবে নীতার জুতো ছিরে গিয়েছিলো ! শেষও হলো একইভাবে ।
এতোক্ষন ধৈর্যধরে আমরা যে কাহিনি পড়লাম তা ঋত্বিক ঘটকের 'মেঘে ঢাকা তারা' সিনেমার পাঠ । খেয়াল করতে হবে ঋত্বিক যখন সিনেমা করছেন ততদিনে বাংলা সিনেমায় একটা যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটে গেছে ।
মানে সিনেমায় সত্যজিতের মতো মহারথী এসে গেছেন । অন্যদিকে ঋত্বিকও এসে গেছেন । এই যে , দু'জন বাংলা সিনেমায় পরম্পরা সৃষ্টি করলেন তা বিস্ময়কর ।
সত্যজিত চিরন্তনী,সমতা,শিল্পে আর মানবিক বোধাবোধ আর শ্বাশ্মত সত্যকেই শিল্পে উন্নীত করলেন অন্যদিকে ঘটক সিনেমায় আনলেন কাহিনি মানুষের সুখ দুঃখ পাওয়া না পাওয়ার বয়ান । সিনেমায় নিয়ে আসলেন দেশভাগ ।
প্রচলিত পথেই হা্টলেন , কিন্তু পথের মতের নানা জায়গায় ক্যামেরার ল্যান্স এমনভাবে ফেললেন যা দেখে আমরা আঁতকে উঠলাম । প্রতিদিনকার ঘটনারই রেশ এই ঘটনাগুলো । সিনেমা আর শিল্প কিংবা মোটা দাগে বললে বলা যায় যে,বুদ্ধিভিত্তিক যে পরম্পরা সৃষ্টি করলো তা থেকে ইঞ্চি খানেক দুরে দাঁড়িয়ে ঘটক বললেন যে না,সিনেমা শুধু বুদ্ধিভিত্তিক ধারায় ই হাঁটবে তা না । সিনেমা হবে মানুষের সুখ দুঃখের অভাব অভিযোগ ঘাত প্রতিঘাত বাদ প্রতিবাদ মতবাদের মিশেলে বৌদ্ধিক মাধ্যম । আমরা যদি 'মেঘে ঢাকা তারা' নিয়ে আলোচনা করি এই দিকগুলো মাথায় থাকলে ভালো হয় ।
দেশভাগ ও দেশহীন মানুষের কথা :
' ...শুন্যে দিলাম উড়ারে ভাই যাইতে চান্দের চর,
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর ।
তোমরা আমায় চিনোনি ... '
দেশভাগের যে যন্ত্রণা তা ঋত্বিক খুব ভালোভাবেই বুঝেছিলেন । দেশহীন মানুষের যে আকুতি হাহাকার তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউই বুঝবে না । ডানা ভাঙা পাখি ঋত্বিক । উদ্বাস্ত হয়ে পূর্ববঙ্গের বাঙাল কী করে কইলকাত্তায় আশ্রিত হয়ে জীবন যাপন করে তা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলেন ঘটক ।
ঘটক সারাজীবন ই কইলকাত্তায় নিজ দেশের ছায়া খোঁজে বেড়িয়েছেন । দেশভাগের দুঃসহ স্মৃতি তাঁকে আজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে । আমৃত্যু দুই বাংলার মিলন ই চেয়েছেন । 'মেঘে ঢাকা তারা' সিনেমাচিত্রে আমরা তাই ই দেখি । বাস্তুহারা উদ্বাস্তু পরিবারটি কলকাতায় গিয়ে যে টানাপোড়নে পড়ে কিংবা পূর্ববঙ্গের ভাষা আদিগন্ত বিস্তৃত যে সবুজ জলাভুমি ধানক্ষেত খোঁজে ফেরা তা খুব চুখে পড়ার মতো ।
ঋত্বিকের চোখে নারী কিংবা নীতা'রা :
আজও নারীরা সন্তান উৎপাদন আর ঘর গেরস্থালির সহায়ক ছাড়া আর কিছুই নয় । কী পশ্চিমে কী ভারতবর্ষে সর্বত্রই একই অবস্থা । ঘটক সেই জায়গাতেই আমাদের আঘাত করেন । 'মেঘে ঢাকা তারা' সিনেমায়ও আমরা নীতাকে একই জায়গায় দেখি । নীতাকে কী করে একটা পরবার তিলে তিলে শ্যাষ করে দেয় তারই চিত্রভাষ্য 'মেঘে ঢাকা তারা' ।
সংসারের বর মেয়ে নীতা তাকে রেখে ছোটোবোন গীতার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তারই ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে । নীতা নিশ্চল বাকহীন । মা বাবাও তাই চান । নীতা চলে গেলে যে সংসারের চাকা চলবেনা, নীতাহীন সংসার ভঙ্গঅর । তাই নীতাদের আশা ভালোবাসা থাকতে নেই ।
কিছু চাওয়া পাওয়ারও আবদার করতে নেই । নীতাও সেই আবহমান বাঙালি নারীরই প্রতিমূর্তি , যা দেখে বা দেখতে অভ্যস্থ আমরা কিংবা পুরুষেরা । জ্ঞানে অজ্ঞানেই আমরা নারীকে সচেতনভাবেই মন্ত্র দেই ... ঝিনুক নিরবে সহ !
কিন্তু ঋত্বিক সেই জায়গাতেই নীতাকে দাঁড় করিয়ে দ্যান কথিত ঘুনেধরা পুরুষতন্ত্রের বিপরীত স্রোতে । নীতার সেই গগনবিদারী আর্তনাদ ... দাদা আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম ... ! খসে পরে কথিত পুরুশালি মুখোশ । প্রকাশ পেয়ে যায় আজকের কথিত নারীর ছদ্মবেশে পুরুষালি মুখোশ ।
ঋত্বিক নীতাকে দাঁড় করিয়ে দ্যান সমগ্র পৃথিবীর মুখোমুখি । নীতা আর তখন নীতা থাকেনা , হয়ে যায় এক ভয়াবহ সত্যের নাম । তখন ই হয়তো দর্শকের পুরুশালি সত্তায় রক্ত চনমন করে উঠে । হয়তো করুণার উদ্রেকও করে । কিন্তু একথা তো সত্যি যে , নীতা এইসব ঠুনকো করুণা কিংবা পুরুশালি সত্তাকে উপেক্ষা করে যে সত্যকে আমাদের সামনে উন্মোচিত করে তা আজোও বর্তমান ।
এইখানেই আমাদের থেকে ঋত্বিক কিংবা নীতার পার্থক্য ।
সবশেষে বলবো আপনারা এই সিনেমাটি দেখুন । এই সিনেমা নিয়ে আমার আরো কিছু বিষয় যুক্ত করে লেখার ইচ্ছে আছে । সবাই ভালো থাকুন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।