যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবী করছি বাংলাদেশের বিশিষ্ট কলামিস্ট এবং বাম রাজনৈতিক নেতা বদরুদ্দিন উমরের একটা লেখা পড়ে খুবই হতাশ হতে হলো। একজন প্রাজ্ঞ এবং প্রতিযশা মানুষ কোন করানে ইতিহাস বিভ্রান্তিতে ভুগেন বা নিজেই ইতিহাস বিকৃত করে - তা বলা কঠিন।
প্রধানমন্ত্রীর পাকিস্তান না যাওয়ার বিষয় বিশ্লেষনের এক পর্যায়ে উনি বলছেন -
১৯৫ জন সামরিক যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেয়ার পর তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো কথা আর বলেননি। উপরন্তু বাংলাদেশে আটক যুদ্ধাপরাধীদের তিনি কারামুক্ত করে দেশ গড়ার কাজে যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাদের ক্ষমা করলেও যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ অপরাধ হিসেবেই থেকে গেছে, যেমন খুন-ধর্ষণের সাধারণ অপরাধও অপরাধ হিসেবেই থাকে।
কাজেই এখন অতিরিক্ত দেরিতে হলেও, যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার হচ্ছে তা যথার্থ। শেখ মুজিব তাদেরকে ক্ষমা করা সত্ত্বেও জনগণ তাদের ক্ষমা করেননি
(২)
এখানে ইতিহাসের ঘটনাটা একটু ভিন্ন - পাকিস্তানী ১৯৫ জন সামরিক যুদ্ধাপরাধী কখনই বাংলাদেশে সরকারের অধীনে বন্দী হিসাবে ছিলো না - তাই তাদের ছেড়ে দেওয়ার কথা আসে কিভাবে। প্রকৃত ঘটনা হলো - ৯০ হাজার পাকিস্তানী সেনার আত্ন সমর্পনের ভিত্তি ছিলো জেনেভা কনভেনশান এবং বাংলাদেশে যখন জাতি সংঘের সদস্য ছিলো না বিধায় জেনেভা কনভেনশনের কোন পক্ষ হতে পারেনি। পাকিস্তানীরা তাই ভারতের সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে চরে গিয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফেরার পর ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের দাবী করলে - ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায় এবং তাদের সাথে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ১৯৫ অফিসারসহ সকল সৈন্য নিয়ে যায়।
বলা দরকার - আত্নসমর্পনের পরপরই পাকিস্তানী সেনাদের ধীরে ধীরে ভারতীয় জেলে পাঠানো হচ্ছিলো।
১৯৭৩ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তির অধীনে ভারত থেকে পাকিস্তানী সৈন্য ফিরিয়ে নেওয়া হয় - কিন্তু বাংলাদেশের দাবী অনুসারে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর প্রত্যাবসন বন্ধ থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্যে আরেকটা সমস্যা ছিলো গুরুত্বপূর্ন - তা হলো পাকিস্তানে আটকে পড়া কয়েক হাজার বাঙালীর দেশে ফেরার বিষয়টির সাথে বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তনীদের ফিরে যাওয়ার বিষয়টি। সে অবস্থায় বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মাঝে দিল্লীতে ১৯৭৪ সালে একটা সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরিত হয় - যার মুল ভিত্তি ছিলো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসে সুষ্পষ্ট ভাবে বাংলাদেশের জনগনের কাছে ৭১ এর অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাইবে এবং আটকে পড়া বাঙালী এবং বিহারীদের প্রত্যাবাসন কাজ ত্বরান্বিত করা হবে। বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছে আটকে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের দাবী ছেড়ে দেবে।
যদিও ক্ষমা, বিচার এবং বিহারী প্রত্যাবাসনে বিষয়গুলোতে পাকিস্তান পরবর্তীতে কথা রাখেনি - কিন্তু আটকে পড়া বাঙালীরা যথাসময়ে ফিরে আসতে পেড়েছে। সুতরাং বদরুদ্দিন উমরের দাবী অনুসারে যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়েছেন বা তার বিচার চায়নি বাংলাদেশের সরকার - কথাটা সঠিক নয়। ১৯৭৪ সালের এই সমযোতার কয়েকমাসের মধ্যেই বংগবন্ধু চার নেতা সহ নিহত হলে দেশের পরিস্তিতি পালটে যায় - এবং যুদ্ধাপরাধীর বিচার, ক্ষমা বা বিহারী প্রত্যাবাসের বিষয়ে পরবর্তী (সামরিক এবং বেসামরিক) সরকারগুলো এক ধরনের অনীহায় ভুগেছে।
(৩)
(কৃতজ্ঞতা নিঝুম মজুমদার)
আর বদরুদ্দিন উমরের দাবী - উপরন্তু বাংলাদেশে আটক যুদ্ধাপরাধীদের তিনি কারামুক্ত করে দেশ গড়ার কাজে যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কথাটি সত্য থেকে অনে দুরে চরে গেছে।
প্রকৃত ঘটনা হলো - মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুদিন পরই কোলাবরেটরস এক্ট নামে একটা অধ্যাদেশের অধীনে দেশে দালাল (রাজাকার আলবদর আলশামস এবং শান্তিকমিটির সদস্য) দের বিচার মুরু হয়। যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশে শাসন এবং বিচারিক অবকাঠামোর দূর্বলতার সুযোগ প্রচলিত ক্রিমিন্যাল আইনের আওতায় বিচার চলার সময় পুলিশ এবং প্রশাসনের অনিময়ের কারনে পুরো প্রক্রিয়াটি সমালোচনার সন্মুখিন হয়। সেই সময় সুনির্দিষ্ঠ অপরাধে অভিযুক্তদের বাদ দিয়ে সাধারন ভাবে পাকিস্তানী বাহিনীকে সহায়তা করার অভিযোগে অভিযুক্ত দালালদের মুক্তি দিয়ে বঙ্গবন্থু্ একটা সাধারন ক্ষমার ঘোষনা দেন এবং দালাল আইনের ( কোলাবরেটরস এক্টের সংশোধন) প্রনয়ন করা হয় - যার সুবাদে অনেক আটকে পড়া দালাল মুক্তি পেলেও সুনির্দিষ্ঠ অভিযোগের আওতায় প্রায় ১১ হাজার অপরাধীর বিচার চলছিলো। কিন্তু ১৯৭৫ সারে সামরিক সরকার এই বিচার প্রক্রিয়াটি বাতিল করে একটা সামরিক ফরমান জারী করে এবং বিচারাধীন সবাইকে মুক্ত করে দেয়। এই সামরিক ফরমানটি পরে জিয়াউর রহমান ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অংশ পরিনত করে।
এখন ৫ম সংশোধনী বাতিল হলেও বর্তমানে যে আদালতে বিচার চলছে তা দালাল আইনের অধীন না হয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল ১৯৭৩ এর আওতায় হচ্ছে।
এবার দেখা যাক সাধারন ক্ষমার ঘোষনায় কি আসলে কোন যুদ্ধাপরাধী মুক্তি পেয়েছিলো কি না -
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ৫নং ধারার (ক) অনুচ্ছেদে যে বিধান রাখা হয় তাতে সত্যিকার অর্থে কোন যুদ্ধাপরাধী মুক্তি পাওয়ার কথা নয়। কারণ ঘোষণার ৫ নং ধারায় বলা হয়েছে
" যারা বর্ণিত আদেশের নিচের বর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরোদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরোদ্ধে নিম্নোক্ত ধরা মোতাবেক কোনটি অথবা সবকটি অভিযোগ থাকবে
(১) ধারা ৩০২ (হত্য),
(২) ধারা ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা),
(৩) ধারা ৩৭৬ (ধর্ষণ),
(৪) ধারা ৪৩৫ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধণ),
(৫) ধারা ৪৩৬ (বাড়িঘর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার),
(৬) ধারা ফৌজদারী দন্ডবিধির ৪৩৮ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন) অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান। এসব অপরাধী কোনভাবেই ক্ষমার যোগ্য নন। "
উল্লেখ্য যে, সাধারণ ক্ষমা ঘোষনার পরেও প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী কারাগারে বন্দী ছিলেন।
আশা করা যায় পাঠক বুঝতে পারছেন - একজন বিদগ্ধ মানুষ বদরুদ্দিন উমন হয়তো ইচ্ছা করে বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে সত্যটাকে একটু দুরে রেখে ইতিহাসের তথ্যকে বিকৃত করেছে - যা সত্যই দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসকে বিকৃত করার মাধ্যমে প্রজন্মের কাছে বিকৃত তথ্য দিয়ে মুলত আমরা একটা বিভ্রান্ত প্রজন্মই আশা করতে পারি - আজ যেমন দেখছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধীতা করে বিভ্রান্ত একদল কিশোর যুবক রাস্তায় পুলিশকে আহত করছে - গাড়ী পোড়াচ্ছে বা সাধারন মানুষকে সন্ত্রস্ত করছে - এর মুল কারন ইতিহাস সম্পর্কে ভুল শিক্ষা বা বিকৃত ইতিহাসের শিক্ষা।
সুত্র:
১)বদরুদ্দিন উমরে লেখা -
Click This Link
২) সাধারন ক্ষমা নিয়ে নিঝুম মজুমদারে ব্লগ -
Click This Link
৩) দালাল আইনে বিচারাধীন কতিপয় দালাল (রাজাকার আরবদর শান্তিকমিটির সদস্যের তালিকা) -
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।