আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দর্শন এবং দার্শনিক

দর্শন জ্ঞানের অন্যতম প্রাচীন একটি শাখা। ফিলোসফি শব্দটির প্রথম ব্যবহার করেছিলেন গ্রিক চিন্তাবিদ ও গণিতজ্ঞ পিথাগোরাস। দর্শন শব্দটি ইংরেজি philosophy শব্দ থেকে এসেছে। ফিলোসফি শব্দটি এসেছে প্রাচীন গ্রিক ভাষা থেকে। দার্শনিক যিনি দর্শন চর্চা করেন তাকেই দার্শনিক বলা হয় ।

পিথাগোরাস সারা জীবন প্রজ্ঞার সাধনা করেছেন, কখনও জ্ঞানের গরিমা অনুভব করেননি। দর্শনের উৎপত্তি সুপ্রাচীনকালে যখন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি আজকের চেয়ে অনেকটা অপরিপক্ব ছিল। দর্শন বিষয়টিই জ্ঞানের একটি অনন্য শাখা হিসেবে শিক্ষার অন্যান্য বিষয় যেমন জীববিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, ইতিহাস, ভূগোল এগুলো থেকে বৈশিষ্ট্যগতভাবে আলাদা। অন্যান্য বিষয়ের মতো দর্শনের যেমন কোন সুনির্দিষ্ট বিষয় নেই, তেমনি সম্ভাব্য সকল বিষয়বস্তুই দর্শনের অন্তর্ভুক্ত এবং কোন না কোনভাবে যে কোন বিষয়েই দর্শনের প্রবেশাধিকার থাকে। দর্শন জগৎ ও জীবন ব্যাখ্যা এবং তার সমস্যা সমাধানের দিক নির্দেশনা প্রদান করে।

মানুষের বর্তমান জীবনই একমাত্র জীবন । পরজন্ম বলে কোন কিছু চার্বাকগণ বিশ্বাস করেন না । কারন পরজন্মের অস্তিত্বের কোন প্রমান নেই । সুতরাং মৃতুর পরেও মানুষকে তার কুকর্মের জন্য দুঃখভোগ এবং সুকাজের জন্য মানুষ সুখভোগ করবে – এইসকল কথা তাঁদের মতে অর্থহীন । ভারতীয় দার্শনিকগণের মধ্যে অনেকেই আত্মার মুক্তি বা মোক্ষ লাভকে মানব জীবনের পরম কল্যান তথা চরম লক্ষ্য বলে অভিহিত করেছেন ।

কিন্তু চার্বাকগণ বলেন , আত্মারই যেখানে কোন সত্তা নাই সেখানে আত্মার মুক্তির প্রশ্ন অবান্তর মাত্র । তাঁদের মতে ইন্দ্রিয়-সুখই মানুষের পরম কল্যান । তাই এই ইন্দ্রিয়-সুখই তাদের জীবনের চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত । ‘মানুষ’ মানুষ হয়েছে দর্শন চর্চার মাধ্যমে। মানুষ জানতে চেয়েছে, অতিক্রম করে যেতে চেয়েছে।

প্রতিটি মানুষই হচ্ছেন এক একজন দার্শনিক। আপনি ঈশ্বরবাদী, নিরীশ্বরবাদী বা সংশয়বাদী যা-ই হোন কেন আপনি একটি দার্শনিক মতেরই অনুসরণ করছেন। চিন্তা করে দেখুন জীব সৃষ্টির পেছনে কত বড় একটা ব্যাখ্যা চার্বাক সেই যুগেই দিয়ে গেছেন। যদিও আধুনিক বিজ্ঞানের মতো জীব সৃষ্টির জৈব-রাসায়নিক কোন উন্নত ব্যাখ্যা নেই। তবু আপনি চার্বাক ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করতে পারবেন না।

বৌদ্ধ-দর্শন একটি যথার্থ শান্তির দর্শন । মেনে চললে এই পৃথীবিতে শান্তি অবশ্যম্ভাবী। বুদ্ধের দর্শনের প্রধান অংশ হচ্ছে দুঃখের কারণ ও তা নিরসনের উপায়। বাসনা সর্ব দুঃখের মূল। বৌদ্ধমতে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য।

বুদ্ধের দর্শনের প্রধান অংশ হচ্ছে দুঃখের কারণ ও তা নিরসনের উপায়। বৌদ্ধমতে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য। বুদ্ধ দুঃখের কারণ, দুঃখ দূর করার উপায় সমন্ধে উপদেশ দিয়েছেন। তার মতে জীবন দুঃখপূর্ণ। দুঃখের হাত থেকে কারও নিস্তার নেই।

জন্ম, জরা, রোগ, মৃত্যু সবই দুঃখজনক। আর বাসনাই হল সব দুঃখের মূল। বৈদিক বা হিন্দু দর্শনের মূল উৎস হল বেদ । প্রাচীন উপনিষদগুলিকে ভিত্তি করে বেদান্ত দর্শন গড়ে উঠেছে । দর্শনের মুল ভিত্তি হচ্ছে নিরপেক্ষ যুক্তি আর ধর্মের মূল ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস।

একজন ধার্মিক বেহেশত দোজখ ইত্যাদি ধর্মীয় বিশ্বাসের আলোকে ঈমান আনেন। তেমনি এই বিশ্বাসের দার্শনিক ভিত্তিও থাকতে বাধ্য। কারন ইসলাম কোন বোধহীন রহস্যবাদী ধর্ম নয়। আবার দর্শন যখন ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে, তখন চিন্তা নিছকই অন্তঃসার শূণ্য দৃষ্টিভঙ্গি আকারে উপস্থিত হয়। ধর্ম নিতান্তই বিশ্বাসের ব্যাপার।

আর দর্শন নিরাবেগভাবে ধর্মীয় আচরনকে পর্যালোচনা করে থাকে, যেখানে আবেগ এবং পূর্ব বিশ্বাসের সুযোগ নেই। যারা বিশ্বাস করেন যে, ধর্ম মাত্রই আবেগ এবং বিশ্বাস আর দর্শন মাত্রই চিন্তা বা ধারণা তাদের এই বক্তব্য সঠিক নয়। সহজ অর্থে দর্শন মানে দেখা, কিন্তু এই দেখা নিছক সাদামাটাভাবে চোখ দিয়ে দেখা নয়, বোধ-বুদ্ধি দিয়ে সামগ্রিকভাবে দেখা। সমাজ, প্রকৃতি মানুষের চিন্তার সাধারণ বিষয়গুলির বিজ্ঞান। দর্শনকে বলা হয় সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের জননী।

দর্শন বিশ্বজগৎকে দেখে বা ব্যাখ্যা করে খণ্ড খণ্ড করে নয়, সামগ্রিকভাবে। আবার সমাজে অন্যায়, অবিচার, শোষণ থাকা উচিৎ কিনা, তার উত্তর কোনো পদার্থ বিজ্ঞান বা জীব বিজ্ঞানের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এই প্রশ্নের জবাব দিতে পরে দর্শন। সকল জ্ঞানী মানুষ দার্শনিক কী না, -কথাটির সত্যতা নিয়ে বোধ হয় স্বয়ং জ্ঞানীদের মধ্যেই যথেষ্ট সংশয় থাকতে পারে। ’দর্শন’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ যদি হয় ‘জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা বা অনুরাগ’, তাহলে প্রত্যেক জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিকে দার্শনিক বলা যায়।

দার্শনিকদের মতে মহাবিশ্ব আর মহাবিশ্বের ‘’ধারণার’’ মধ্যে একটা পার্থক্য হচ্ছে, একটি বাস্তব এবং এর বস্তুগত অস্তিত্ব আছে; আরেকটি হলো ধারণা সংক্রান্ত, দার্শনিকরা যাকে বলেন চিন্তা। হিন্দু ধর্মে অনেক দর্শনের সমন্বয় ঘটেছে, কেউ বৈষ্ণব, কেউ শৈব, কেউ শাক্ত। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকে প্রধানত মুসলমানরা বাহিরের দার্শনিক চিন্তাধারার সাথে পরিচিত হতে থাকে। পৃথিবীর বেশিরভাগ আস্তিক মানুষের ধর্ম উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। জন্মসূত্রে যে ধর্ম কাঁধের ওপর চেপে বসে তার ইমেজ রক্ষা করার দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নেন ধর্মপরায়ন মানুষ।

একদিকে ইয়াহুদি-খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব ও দার্শনিক চিন্তাধারা ,অন্যদিকে গ্রীক ও রোমান চিন্তা এবং পার্সিয় ও ভারতীয় ধর্মীয় ও দার্শনিক ভাবনার সাথে তাদের পরিচয় ঘটতে থাকে। মানুষ যতদিন না বিজ্ঞানের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে, ততদিন মানুষ দর্শনের হাত ধরেই বিজ্ঞানের জগতে হাঁটি-হাঁটি-পা-পা করবে। বিজ্ঞান, সেদিনের আগ পর্যন্ত কখনও দর্শন থেকে নিজেকে ছিন্ন করতে পারবে না। খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দি থেকে গ্রিক গন স্বাধিনভাবে যে দর্শন চর্চা করে এসেছিলো, রোম সাম্রাজ্যের পতনের সাথে সাথে তা নিশ্চল হয়ে যায়। গণিতের দর্শন হল দর্শনের একটি শাখা যেখানে গণিতের পূর্বানুমান, ভিত্তি ও ফলাফলগুলো দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচিত হয়।

আত্মহত্যা যেসব কারণে সংঘটিত হয়, যেমন- বিষণ্নতা, মানসিক বেদনা বা অর্থনৈতিক দারিদ্র্য ইত্যাদি সমস্যা সাময়িক এবং এসব কারণের অনেকগুলোই উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দূর করা সম্ভব। একজন ব্যক্তিকে জীবন ও আত্মহত্যার মধ্যে বেছে নিতে দেয়ার স্বপক্ষে কিছু যুক্তি আছে। আত্মহত্যাকে ব্যক্তির ইচ্ছার উপর উপর ছেড়ে দেয়া উচিত বলে যারা যুক্তি দেখান, তাদের মতে আত্মহত্যা সবসময় অযৌক্তিক নয়, কখনো কখনো বাস্তব সমস্যার সঠিক সমাধান। যেখানে বিকল্প সকল উপায় আত্মহত্যার চেয়ে খারাপ বলে মনে হবে, তখন আত্মহত্যা একটি বৈধ কাজ। কিছু চিন্তাবিদের আত্মহত্যার প্রতি সমর্থনপুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী ছিল।

দার্শনিক প্লেটো'র মতে আত্মহত্যা করা অনৈতিক নয়। বিজ্ঞানী আইজাক নিউটন তার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটির নাম দিয়েছিলেন ফিলোসোফিয়া নাতুরালিস প্রিংকিপিয়া মাথেমাটিকা যাকে বাংলা করলে দাঁড়ায় প্রাকৃতিক দর্শনের গাণিতিক নীতিসমূহ। গণিতের মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক সূত্র আবিষ্কার করলেও তিনি এই জ্ঞানকে প্রাকৃতিক দর্শন নামেই আখ্যায়িত করেছিলেন। ভাববাদী দার্শনিকদের চিন্তার একটা বিরাট অংশ জুড়ে থাকে ‘আত্মা’। কত রকমের ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা যে আছে আত্মাকে ঘিরে।

বাংলা ভাষায় অনেক শব্দ ও শব্দাংশ প্রচলিত আছে ‘আত্মা’কে নিয়ে। মানুষ মরলেও আত্মা নাকি মরে না। সংশয়বাদীদের কথা আসলে একালের দার্শনিকদের মধ্যে বার্ট্রান্ড রাসেলের কথা সর্বাগ্রে আসে। তাঁর ‘দি প্রব্লেমস অব ফিলসফি’ গ্রন্থ আরম্ভই করেছেন তিনি এভাবে, “এমন কোন সুনিশ্চিত জ্ঞান কি আছে যাকে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনও সন্দেহ করবে না?” পড়শী যদি আমায় ছুঁতো, যম যাতনা সকল যেত দূরে। সে আর লালন একখানে রয় তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে।

বাড়ির কাছে আরশী নগর সেথায় এক পড়শী বসত করে, আমি একদিন ও না দেখিলাম তারে... ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৫৬ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।