আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কওমি মাদরাসা : যে কথা যায় না বলা

ভালো আছি আমরা কওমি মাদরাসার সন্তান। জাতির অবহলেতি অহংকার। দুনয়িার সকল চাওয়া পাওয়া জলাঞ্জলী দিয়ে দীন ইসলাম বাঁচাতে আখরাতের মহড়ায় রাতদনি গুজরান করি আমরা। তাই পত্র-পত্রকিার নিত্য নতুন চমক কিংবা সামাজকি নানা আয়োজন থেকে সদা র্সবদা নিজেদেরে রাখি সর্তক হুঁশয়িার। দূরে থাকি শয়তানি প্রবঞ্চনার গা-ছোঁয়া থেকে একদম একশ’ হাত।

অপরূপ পৃথিবীর লোভনীয় রূপরস এবং পার্থিব জাকজমকরে তুমুল সম্মোহন কভু, কখনো, কোনকালওে আমাদের হাতছানি দিয়ে কাছে টানতে পারে না, পাশে ডেকে মায়ায় জড়িয়ে বেঁধে রাখতে পারনো কিছুতেই। সুতরাং এই মায়াবী পৃথিবীতে শূন্যতা ছাড়া আর কিচ্ছুটি যদি আমাদের নাও থাকে, কোন শুভসন্ধায় শুকতরার ঝলমলানি যদি আমরা নাও পাই, তবুও কি আক্ষেপের কিছু আছে আমাদের ? থাকতে পারে ? পারে না। পারেনা বলইে না পাওয়ার বেদনা মুখে বুকে সয়ে আখেরাতে এর উত্তম প্রতিদান পাবার আশায় কখনো কলম তুলিনা আমরা। ভয় পাই, পাছে কাঙ্ক্ষিত ফসলে ছাই পড়ে যায়। তাই কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারিনি, আমাদের মাদরাসায় এমন একটা ক্যাম্পাস নাই, যে ক্যাম্পাসে অ্যাপ্রন ঝুলিয়ে হাঁটবে আগামি দিনের বর্ণিল স্বপ্নচারী কওমি সন্তানরা।

তাতে আফসোসেরও কিছু নেই। কারণ ওসব অ্যাপ্রন বা ইউনিফর্ম র্মাকা চাকচিক্য মানায় না মাদরাসায়। তাছাড়া খোলামেলা ক্যাম্পাস থাকলে সেখানে গোলাগুলি মারামরি হবে, প্রতিদিন যাবে খুনের মিছিল। অবশ্য সেখানে আনন্দ র‌্যালি কিংবা র্বণাঢ্য শোভাযাত্রাও কদাচিৎ হয় বটে । একটা অপরাজেয় বাংলা কিংবা টিএসসি চত্বর অথবা উদীচি-রমনা বটমূলের মতো আড্ডা দেওয়ার জায়গা আমাদের নেই।

কী করে থাকবে ? অশ্লীল ঢলাঢলি আর বেপরোয়া নোংরামিতে হরদম মাতাল-উন্মাতাল থাকে বলে ওইসব পল্লী-পাড়ায় বোমাবাজরি ফতোয়া দেই নাকি আমরা ! অবশ্য আমাদের অমন কটা চত্বর থাকলে সেখানটা আরবি নাহু-সরফের সীগা-র্গদান টানাটানি, উসূলে ফিকহের তাকরার অথবা হাদিস-কোরআনের মোযাকারায় গুঞ্জরতি হতে পারতো । যদি আমরা চাইতাম। ঠিক এমনি করে স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনারের মতো জাতীয় স্থাপনাগুলো আর সবার জন্য উন্মুক্ত হলেও এই আমাদের জন্য থাকে অঘোষিত ‘প্রবশে নিষেধ’। আর চিড়িয়াখানা, জাদুঘর কিংবা জাতীয় উদ্যান বোটানিক্যাল গার্ডেনের কর্তৃর্পক্ষরাও আমাদের ওপর মহাবিরক্ত। কোনমতেইে তারা মেনে নিতে পারেন না এই টুপি-দাড়িওয়ালা আদম সন্তানগুলোকে।

একুশে বইমলোর মতো কোন আর্ন্তজাতিক গ্রন্থমেলা, বছরের নির্দিষ্ট একটা সময় নবীন-প্রবীন শত সহস্র লেখক-পাঠকের পদচারণায় মুখরিত জ্ঞানভূমি, কখনো কি আমাদের ছিলো ? নাকি হবে কোনদিন ? হবে না। কারণ মেলা-টেলা ইসলামসদ্ধি নয়। অতএব বেশি থেকে বেশি দু’একটা মাকতাব ষ্টলের অনুপ্রবেশ সেখানে ঘটানো যেতে পারে, ব্যস। যেন অতি বইপ্রেমি হুজুর ছাত্ররা র্বণ লুকিয়ে আড়ং- এর পাঞ্জাবি গায়ে ঝুলিয়ে সবার অলক্ষ্যে ঢুকে তৃষ্ণা মেটাতে পারে। ইসলামসদ্ধি নয়, তাই কোন বিজ্ঞান উৎসব অথবা কোন কম্পিউটার মেলায় অংশগ্রহনের সাহস তো ভালো, প্রয়োজনটুকুও অনুভব করি না আমরা।

সোজা হিসাব, এসব আমাদের নয়, আমাদের জন্যও নয়। এইগুলি সব দুনিয়া দুনিয়া, মিথ্যা মায়া-ছায়া। দুনিয়ার মায়ায় জড়াতে নেই, ছায়াও মাড়াতে নেই। দুনিয়াদারদের কারবারে মাথা ঘামালে ইবাদাতে মনোযোগ নষ্ট হবে, খোদার নিবিড় সান্নিধ্য অর্জনে বিঘ্ন ঘটবে। মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন (!) একজন উস্তাদ বড় আফসোস করে একবার বলেছিলেন, হায়, র্দীঘ দশ বারটি বছর ধরে যেই দাড়ি-টুপি-জুব্বাবিহীন মানুষের দান খয়রাত খেয়ে খেয়ে ইলম শিখি, আলমে হই,পাস-ফারেগের পর তাদেরকেই ‘দুনিয়াদার’ বলে ভ্রুকুটি করি, আর আমরা সাজি পাক্কা দীনদার-সমঝদার।

তাই সন্দেহ জাগে, কোন ‘ক্লোজআপ ওয়ান’ অথবা ‘গণিত শেখো’ টাইপের প্রতিযোগিতা-অনুষ্ঠান কোনোদিনও কি গড়তে পারবো আমরা। কোন মাহেন্দ্রক্ষণে কি আমাদরে ঘরানার হুজুররা ধরা দিবেন একটা গতিশীল ‘পাঠচক্রে’ অথবা একটা সৃজনশীল গল্পের আসরে ? এখনও কবিতা, হ্যাঁ, শুধুই বাংলা কবিতা এই কওমি সমাজে অনাহুত, ঘরছাড়া, নীড়হারা বেগানা পাখির মতন। কোন নৈশকালীন কবিতা উৎসবরে নান্দনিকতায় বিমুগ্ধ হবো না আমরা কোনোদিন। কারণ ‘আশশুয়ারাউ য়াত্তাবিউহুমুল গঊন’। মিডিয়ার একটা খোলা আকাশ, যে আকাশের সবটুকু নীলিমা হবে আমাদের, রাতের সবক’টা তারা, গোঁধুলির লাল লাল আবীর, এমনকি বাদলদিনের ভাঙাচোরা মেঘ- সব, একদম সবটুকু হবে আমাদের; এমনটা কখনোই কি হতে পারে না ? একেবারেই কি হওয়া যায় না ? ইলমের পরশ আর নববী রোশনি মেখে যে আকাশকে আপন হাতে আমরা সাজাবো, রাঙাবো ! কোনোদিনও কি হবেনা ? আমরা জানি, আমাদের মাদরাসা, এটা কোন সাধারণ বিদ্যালয় নয়।

এখানে বিশ্বস্রষ্টা কর্তৃক অবতীর্ন জ্ঞানের চর্চা হয়। তাই অন্যসব বিদ্যালয়ের মতো একটা র্বাষিক ক্রীড়ানুষ্ঠান কল্পনাই করা যায়না এখানে। কোন দৌড়-সাঁতারের অবকাশ নইে এই ইলমের দরবারে। কোন স্বাধীনতা দিবস অথবা কোন বিজয় দিবসে দেশপ্রেমের পতাকা ওড়েনা এই স্বীকৃতিহীন পরাধীন অঞ্চলে। রপ্ত করা হয় না র্মাচপাষ্ট অথবা কুচকাওয়াজ ঢংয়ের কোন সৈনিকি কৌশল।

আমাদের সর্তীথ-সহপাঠীরা রাজপথে ব্যানার টাঙানো শিক্ষাসফরের গাড়িঘোড়া দেখেই শুধু পরান জুড়ায়। সুর্দীঘ একযুগের ইলমি সফরে মাদরাসা আমাদেরকে কোন সুদূর জঙ্গলে বনভোজনে পাঠিয়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিতে চায় না কোনভাবেই। কারণ ‘আদ্দুনয়া সিজনুল মু’মিনি...’। তবে ইসলাম যেহেতু বিনোদনকে কুল্লে হারাম বলেনি, তাই হয়তোবা কোথাও কোথাও সপ্তাহ বা মাস শেষে গুটানো হয় ক্লাসের তেপায়া-টেবিল। দুলে ওঠে বিরস ম্লান জলসার র্পদা।

ঘন্টা দুয়েক অবোধ চাতকের ন্যায় মুখ গুজে বসে থাকতে হয় আমাদের কিছু লৌকিক হামদ-না’ত অথবা চিরায়ত ওয়াজ-বয়ানের নরম পালকে। কথা আরও আছে। ভারতর্বষের স্বাধীনতা আন্দোলনে ওলামায়ে কেরামের বীরত্বর্পূণ ইতিহাস আমরা জানি বেশ ভালো করেই। আমাদরেকে সেটা জানতে হয়, জানানো হয়, শোনানো হয়, পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয়। কিন্তু এই বাংলাদেশের ইতিহাস, আমাদের জন্মভূমির জন্মকথা, শেরে বাংলার লাহোর প্রস্তাব থেকে শুরু করে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, ছয়দফা দাবি, বঙ্গভঙ্গের গন্ডগোল, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনী প্রহসন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরর্বতী বংলাদেশ গড়ার দেদীপ্য কাহিনী কতটুকু আমরা জানি এবং কতটুকুই বা আমাদের জানানো হয়।

আমাদের পাঠ্য তালিকায় একটা বই অথবা ন্যুনতম একটা প্রবন্ধ কি থাকা উচিৎ ছিলো না এই ইতিহাসের আশ্রয় নিয়ে ? জানি না। এই যে এত নেই নেই, এরপরেও সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে কোন আবেদন-আবদারও কিন্তু আমাদের নেই। কারণ, এই সমাজ ও রাষ্ট্রটাকে কোনদিন আমরা বুঝি আপন ভাবতে পারি নি। তাছাড়া যার তার কাছে যত্রতত্র আবেদন করার অভ্যাস নেই মোটেও আমাদের। আমাদের সব আবদার-আবেদন কেবল রমজানের যাকাত-ফেতরা আর কোরবানির গরুর চামড়াকে ঘিরে।

তাই বুঝি আমাদের ছাত্ররাও ‘বোর্ডিং-এ ফ্রিখানা জারি’ আর রোগ-বিমারে 'ছুটি মঞ্জুররে আবেদন’ ছাড়া আর কোন আবেদনপত্র লিখতে জানেনা। জানানো হয়ও না। নিরুপম ঋতু বৈচিত্রের দেশে বড়ো হয়ে উঠি বটে আমরা কিন্তু গ্রীষ্মের আমপাকা দুপুর, ভাদ্রের বিলভরা শাপলা সোহাগ, শরতের কেশর দোলানো কাশফুল, শীতের খেজুর রসে ভেজানো পিঠাপুলি আর বসন্তের চৈতালি হাওয়া অথবা মুকুল ছড়ানো আম্র-শাখের ছায়ায় প্রাণ জুড়ানোর আনন্দ অনাদরেই চলে যায় গোমড়া মুখে আমাদের পাশ কাটিয়ে। হোস্টলে জীবনের র্দীঘসূত্রতা পেরিয়ে মায়ের স্নেহ-মমতায় জড়ানোর সময় হয় না এতটুকু। সমাজের তৃতীয়শ্রেণী কিংবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলে হোক অথবা সুদ-ঘুষের অর্থনীতিকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে হোক হেলায় হেলায় টুকটাক ব্যবসা, ছোটখাটো ইসলামি এনজিও, না হলে আবারও চলে যাই মসজিদ-মাদরাসার অবারিত চার দেয়ালে।

এরপর না পাওয়ার বেদনা ঘোচাতে কখনো যদি সত্যিই এই জগতকে কিছু দিতে ভেতরে একটা জাগ্রত মানুষ অথবা কোন ঘোরভাঙা প্রেরণা জেগে ওঠে, তাহলে ছুটে যাই ইসলামি রাজনীতির শতধাচ্ছিন্ন নাতিশীতোষ্ণ ময়দানে। আর তাও না হলে হয়তো দু’চার লাইন লিখি এবং অবশেষে দু’একটা বই পুস্তক সাজিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। এইতো আছে আমাদের। এভাবেই পূণ্যের বিরাট জ্বালা নিয়ে কদম কদম আখেরাতের পানে ধেয়ে চলছি আমরা, আমাদের কওমি সন্তানরা। কোনদিন কাগজ কলমে হিসাব কষা হয়নি, এই করে করে আসলে কী পেলাম আমরা, আর কিইবা পেলো এই অভাগা জাতিটা।

দিনদিন কাঁঠালের কোষের মতো যেভাবে সমাজ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছি আমরা, তাতে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমাদেরকে উপজাতীয় আদিবাসী কিংবা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মতো বিশ্বের সামনে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে- এমন আশঙ্কা কিন্তু একেবারেই অমূলক নয়। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.