আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রিকশাওয়ালা

খবরে ধান্দাবাজি রিকশা চালক নওশাদ ঘুম থেকে উঠে দেখল, তার চটি জোড়া নাই। বাঁশের মাচার উপর কাঠের তক্তা পেতে তৈরি বিছানার তলায় পানি ঢুকে গেছে। যেখানে চটি রেখে সে প্রতিরাতে ঘুমায়, গতকাল সেখানেই রেখেছিল। ঘুমানোর আগে আকাশে মোটেও মেঘ ছিল না। কিন্তু রাতের কোনো অংশে ঠিকই বৃষ্টি হয়েছে।

রঙ উঠে যাওয়া চটিতে মাসখানেক আগে লাগানো হয়েছে ফিতা। বহু খোঁজাখুঁজি করেও সে সেটা পেল না। পাশেই ছোটো একটা ডোবা। ডোবার এক পাশে ডাস্টবিন। পুরো ডোবা নোংরা পানিতে ভর্তি।

কলমি, হেলেঞ্চা, ঘাসসহ নানা লতা-পাতা গজিয়েছে। মশা-মাছি এমনকি সাপের আশ্রয়স্থল এখানে। সামনে খোলা মাঠ। মাঠের অর্ধেক অংশ ডুবে গেছে। মাঠের পশ্চিম পাশে বস্তি।

পূর্ব পাশে ৬ তলা বিল্ডিং। উত্তর পাশে কয়েকটি কারখানা। দক্ষিণ পাশে জোয়ারসাহারা রোড। বস্তি বলতে ৬০-৭০ হাতের লম্বা ৫-৬টি ঘর, বাঁশ ও টিন দিয়ে বানানো। ঘরে কোনো জানালা নাই।

মাঠের অন্য পাশে একটা টয়লেট। টয়লেটটা অটোমোবাইল কারখানার শ্রমিকদের জন্য তৈরি। ওইটা বস্তিবাসীরাও ব্যবহার করে। বস্তির যে ঘরটাতে নওশাদরা থাকে তার দুই পাশ খোলা, এক পাশে আরেকটা টিনের ঘর, আরেক পাশে বিল্ডিংয়ের দেওয়াল। সামনেটা একদম খোলা, উত্তর দিকে একটা ভাঙা টিন দেওয়া আছে, যাতে বৃষ্টির পানি না পড়ে।

বৃষ্টি শুরু হলে সামনে পলিথিন টাঙিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া ঘরের সামনে নারকেল গাছের গুড়ি ফেলানো আছে, যাতে বৃষ্টির সময় ভিতরে ময়লা না ঢোকে। হয়তো গুড়ির ফাঁক দিয়েই চটি জোড়া হাওয়া হয়ে গেছে। নওশাদ ছোটোবেলা থেকে যাকে জুতা বলা শিখেছে, সেটা নাকি পন্স, চটি, চপ্পল। জুতা হলো চাম দিয়ে ঘেরা, বড়লোকরা যাকে শু বলে।

আর স্যান্ডেল হলো চাম বা অন্য কিছুতে তৈরি, পেছনটা খোলা। খালি পায়ে রিকশা চালানো যায় না, যাত্রীরা কম টাকা দিতে চায়, দু’একজন ভদ্দরলোক বা স্মার্ট মেমরা ভয় পেয়ে দূরে থাকে, ৪০ টাকার চটির জন্য ভাড়াই পাওয়া যায়না। নওশাদ এসব ভাবছিল। মোটামুটি সবাই রিকশা নিয়ে ভোরেই বেরিয়েছে। সামনে ঈদ।

প্রচুর যাত্রী। গ্রাম থেকে নতুন কয়েকজন মৌসুমী চালক এসেছে। সবাই বেরিয়েছে। জামাল এখনও ঘুমে। এই এক আজব রিকশা চালক জামাল, মাথায় বড় বড় চুল, কাজের কোনো তাড়া নাই, দুপুর বেলা ঘুম থেকে ওঠে, মাঝরাতে ফেরে।

হঠাৎ করেই জামালের এই পরিবর্তন। কয়েকদিন আগেও তার মাথায় ছোটো ছোটো চুল ছিল। কারো কোনো বিপদ হলেই সে সমাধান করে দিতো। কাজ করতো মনোযোগ দিয়ে। কিন্তু ইদানিং সে অন্যমনষ্ক হয়ে থাকে।

জামালের মা অসুস্থ। পেটে কী একটা হয়েছে। ডাক্তার বলেছে, অপারেশন করাতে হবে। অনেক টাকা লাগবে। সে টাকা পাবে কোথায়? তাই সব সময় মন খারাপ করে থাকে।

গ্রামের বাড়ীতে মা ছাড়া তার আর কেউ নাই। মাকে নিয়েই তার দুনিয়া। বাবা ছোটো বেলায় মারা গেছেন। কাস টুএ পড়ার সময় বাবার মৃত্যুর পর আর স্কুলে যেতে পারে নি। ওই পর্যন্ত তার বিদ্যা।

সেই বিদ্যাতে সে শহরের সব সাইনবোর্ড পড়তে পারে। মাঝেমধ্যে পেপার পড়ে শোনায় সবাইকে। ২ টাকা দামের পেপারে যে দুনিয়ার এতো খবর থাকে জামাল ছাড়া তারা কেউই তা বুঝতে পারতো না। সেই জামাল আজকাল মন খারাপ করে থাকে। চুল বড় হয়েছে, কাটেনি।

তার সখ, মা মরার আগে একখান ফটো তুলে রাখবে। মাকে জড়িয়ে ধরে সে বসে থাকবে। ছোটো চুলে ফটো ভালো হয় না। তাই সে বাবড়ি চুল রাখা শুরু করেছে। ফটো তোলার জন্য চুলে সে নিয়মিত সাবান মাখে।

মাঝেমধ্যে তেল লাগায়। কোথা থেকে জেল এনেছে, সেটাও লাগায়। গতরাতে অনেকক্ষণ কুকুর ডেকেছে। কুকুরে ডাকলে নাকি অমঙ্গল হয়। কথাটা সত্যি কিনা নওশাদ জানেনা।

কিন্তু আজ রাতে তার চটি ভেসে গেছে, এটা সত্য। কুকুর বা কাক ডাকলে তার দাদি সহ্য করতে পারতো না। যেখানেই থাকুক তাড়িয়ে দিতো। রাতে ঘরের মধ্যে থেকেই হুটহুট শব্দ করে কুকুর তাড়াতো। ভয়ে কুকুর পালাতো।

অনেক দিন আগের কথা। সে বছর সারারাত পাড়াজুড়ে কুকুর ডেকে চললো। জামাল তখন গ্রামে থাকতো। সে তখন খুব ছোটো। ঘুম থেকে উঠে দেখে, উঠানে বন্যার পানি চলে এসেছে।

সে বছর ঘরেও পানি উঠেছিল। কুকুরের ডাক যে বিপদসঙ্কেত সে কথা জামাল তখনই বুঝেছে। এই রিক্সা গ্যারেজের মালিকের নাম কুতুব। কুতুবের দুইটা বউ। প্রথম বউ অন্য এক বস্তিতে।

দ্বিতীয় বউ এখানে। রান্না করে, খায়, ঘুমায়- এই তার কাজ। কুতুবও আজকে দেরীতে ঘুম থেকে উঠেছে। বাইরে এসে পুরো ব্যাপারটাই বুঝলো। কিন্তু নওশাদের বসে থাকার ব্যাপারটা সে বুঝতে পারলোনা।

সে জিজ্ঞেস করলো, কি নওশাদ মিয়া, বয়া রইছো ক্যা? - জুতা হারায়া গেছে। - বয়া থাকলে কি জুতা পান যাইবো? - কি যে করি। - কামে যাও। কামে গেলে ৫টা জুতা কেনার ট্যাকা পাইবা। - কিন্তু জুতা ছাড়া গেলি যে ভাড়া কম পামু।

- এই নবাবি কতা শুরু করলা। তোমারে না কইছি নবাবি কতা কইবা না। নবাবি কতা আমি একদম পছন্দ করি না। কুতুব মিয়া এই বলে চলে গেল। নওশাদ বুঝলো আজ কপালে আরো দুঃখ আছে।

সে খালি পায়েই বের হওয়ার জন্য রিক্সা পরিষ্কার করা শুরু করলো। রিক্সার বেলের টুংটাং আওয়াজে জামালের ঘুম ভাঙলো। কিন্তু তার মনটা খারাপ। সে নওশাদকে জানাল, রাতে তার ভালো ঘুম হয়নাই। সে আর ঢাকায় থাকবে না।

একবারে গ্রামে চলে যাবে। চুলটা মোটামুটি বড়ই হয়েছে। এখন ফটো তুললে বেশ ভালই দেখা যাবে। নওশাদ জানে এই শহরে যারা একবার আসে তারা সহজে ফিরে যেতে চায় না। শহরটা তাদের স্বপ্ন কেড়ে নেয়।

বিনিময়ে দুই মুঠ পেট পুড়ে খেতে দেয়। তাই জামাল-নওশাদরা ইচ্ছে করলেই শহর ছাড়তে পারে না। জামাল জানাল, আজকাল সে ভাড়া বেশি পায়। স্কুল-কলেজের পোলা-মাইয়ারা তার গাড়িতে খুব ওঠে। ভাড়া নিয়াও বেশি ক্যাচাল করে না।

চুল রাখায় আর কিছু না হোক কামাই বেড়ে গেছে। অবশ্য খরচও বেড়ে গেছে। চুলের নিয়মিত যত্ন নিতে হয়। শ্যাম্পু বা জেল নিয়ে রাস্তায় বোরোলে লোকজন তাকায়া তাকায়া দেখে। নওশাদ বললো, ‘জামিল ভাই, মনে অয়, রিকশা চালান ছাইড়া দেই।

ছোটোবেলায় সুন্দর বাঁশি বাজাইতাম। লোকজন খুব মনোযোগ দিয়া শুনতো। মায় কিরা করাইলো, যতদিন ভাতের অবাব থাকপো ততদিন বাশি বাজাবিনা। আমিও কিরা কাটলাম, ভাত ছুইয়া। তারপর থিকা আর কুনুদিন বাশি বাজাই নাই।

মাঝেমধ্যে খুব কষ্ট অয়। বাশি বাজাইতে মন চায়। বাশি বাজাইলে মনে কুনু কষ্ট থাহে না। কিন্তু বাজাই না। মায় কষ্ট পাইবো।

এবার বাড়িত গিয়া মাক কমু, মা, তুমি কিরা তুইলা ন্যাও। আমি বাশি না বাজাইলে মইরা যামু। ’ নওশাদ চটি হারানোর কথা বলে। জামিল বলে, ‘নওশাদ বাই, ধীরে ধীরে আমরা জীবনটাই হারাইতাছি, টের পাইতাছি না। চটির মতো আমরা ভাইসা যাইতাছি অজানা কুনু জায়গায়।

’ এই হলো জামাল। কিস্তি নিতে যে স্যাররা আসেন তারা তাকে ডাকে সকরেটিস বলে। জামাল রিক্সার সিটের তলা থেকে নিজের চটি জোড়া বের করে দিয়ে বললো, ‘আমার জোড়া ন্যাও নওশাদ বাই। আমার মনটা আজ বালা নাই। রাইতে গুম অয় নাই।

আমি আরো গুমামু। মনে অইতাছে, বৃষ্টি নামবো। আমি আজ যামুনা। ’ নওশাদ সেদিন জামিলের চটি নিয়ে বের হলো। সারাদিন বৃষ্টি।

বৃষ্টির সাথে প্রচন্ড বাতাস। ঢাকার বেশ কিছু রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেল। সারাদিন ভিজল বটে নওশাদ কিন্তু অনেক টাকা সে আয় করলো। বৃষ্টি হলে ভিজতে হয়, কিন্তু ভাড়া বেশি পাওয়া যায়। অবশ্য সর্দি-জ্বর হলে তখন তার চেয়ে বেশি খরচ হয়ে যায়।

একদিনে প্রায় হাজার টাকা সে আয় করলো। বিকালে এক হোটেলে দুপুরের খাবার খেলো। সন্ধ্যায় ফুটপাত থেকে নতুন এক জোড়া চটি কিনলো। রাত ১০ টার দিকে সে গ্যারেজে ফিরল। গ্যারেজের কাছাকাছি আসতেই বাঁশির করুণ সুর ভেসে এলো তার কানে।

এই সুর শুনে তার শরীর কাঁপা শুরু করলো। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজেও যা হয়নি, এই বাঁশির বিষাদ মাখা সুরে তাই হলো। কষ্টে তার চোখ দিয়ে পানি বের হলো। গ্যারেজে ঢোকার আগেই আরেক রিকশাওয়ালা রহমান তাকে খবরটা দিল। জামিল আর রহমান একই এলাকার মানুষ।

রহমান যা জানালো তাতে নওশাদের ভেতরটা দুমরে-মুচরে গেল। নওশাদ জিজ্ঞেস করলো, `জামিল গেল না ক্যা?` রহমান বললো, `ভোলায় নদীপথ ছাড়া যাওয়া যাওন না। বঙ্গোপসাগরে ঘুর্ণিঝড় শুরু অইছে। নদীতে সিগনাল দিছে। লনচো ইস্টিমার বেবাক বন্দ।

` ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.