আমি লিখি মানুষের কথা,মানুষ পড়ে না। --তুই একটা কিছু ব্যবস্থা কর, নইলে আমাদের মান-সম্মান আর থাকছে না। বলে খাটের উপর সাটপাট শুয়ে পড়ল গোপাল।
বুঝলাম সে বড়ই হতাশ। তবু আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, আরে
আমি সেই সকাল থেকেই বই মুখে ওই কথাটাই ভাবছি, মনে হচ্ছে,
এই রহস্যের কুলকিনারা না করতে পারলে স্কুলে মুখ দেখানোই
মুশকিল।
আমার কথায় আবার উঠে বসল গোপাল, এই জন্যেই তো তোকে
সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ভাবি, আমি ঠিক জানি, তোর কানে যখন কথাটা
তুলতে পেরেছি তখন সমাধান একটা হবেই।
গোপাল আমাদের স্কুলের দূরন্ত ছেলে। সে একবার কুকুরের
লেজে জলন্ত তারাকাঠি বেধেঁছিল, তাই পাড়ার সব কুকুর তাকে ভয়
করে। দুটো বেড়াল যদি কখনও পরস্পরের মুখোমুখি হয় আর
গোপাল যদি সেখানে থাকে, তবে চিত্তির। সে ঝুপ করে পানি ছিটিয়ে দেয়।
যুযধান দুই বেড়ালের ঝগড়া আর থামে না। পাড়ার বেড়ালগুলো
গোপালকে খুব সমীহ করে।
গোপালের নিত্যনতুন উদ্ভাবনী দেখে আমাদের স্কুলের ছেলেরা তার
ভক্ত। মাস্টারমশাইরা এমনকি হেডস্যার অব্দি সম্ভ্রম করেন তাকে।
সকলেই হয়ত আশঙ্কা করেন,বিচ্ছু ছেলে কখন কি বুদ্ধি খাটাবে কে
জানে!
সেই গোপালের প্রভাব-প্রতিপত্তি এবার বুঝি কমতে শুরু করেছে।
জয় নামের একটা ছেলে নতুন ভর্তি হয়েছে আমাদের স্কুলে। তার
বাবার বদলীর চাকরী। তিনি আমাদের গ্রামের সমবার ব্যাঙ্কের
ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হয়ে এসেছেন। গোপালের বক্তব্য,উনি
না হয় চাকরীর সুবাদে এলেন, তাই বলে ছেলেকে শহরের স্কুল
থেকে এখানে ভর্তি করার কি মানে হয়?
লম্বা-চওড়া চেহারার জয় আমেদকে আমার অবশ্য খুব খারাপ
লাগে না। তার ফরসা রং, হাসলে গালে শাররুখ খানের মত
দু-গালে টোল পড়ে।
সে সব সময় হাসিখুশি। তাই তাকে
সকলেই পছন্দ করতে শুরু করেছে।
গোপালের সাথেও ভাল সম্পর্ক ছিল জয়ের।
এখন সেটা মুখ দেখাদেখি বন্ধের পর্যায়ে চলে গেছে।
আমাদের ক্লাশের ছেলেমেয়েরা এখন দুই ভাগে বিভক্ত,
জয়-ভক্ত ও গোপাল-ভক্ত।
তবে গোপাল-ভক্তের সংখ্যা এখন
হেড-স্যারের টাঁকের চুলের মত, নগণ্য।
গোপালের অভিযোগ, খিচুড়ি খাইয়ে জয় ওদেরকে
বশ করে নিয়েছে। ও নাকি মন্ত্রের সাহায্যে খিচুড়ি বানায়।
বেশ কয়েকদিন ধরে গোপাল আমাকে বলছে, তুই ওর খিচুড়ির
রহস্য উদ্ধার করে দে।
আমাদের স্কুলে টিফিনের সময় যাদের বাড়ি কাছাকাছি তারা সব
বাড়ি চলে যায় খেতে।
গোপাল, জয়, আসলামদের মত আমিও
যাই। পনের মিনিটের মধ্যে খেয়ে স্কুলে ফিরি। ঘটনার সুত্রপাত
সেখান থেকেই।
জয় প্রতিদিন তার ক্লাশের কোন না কোন বন্ধুকে বাড়ি নিয়ে
যায়। তাকে মন্ত্রে তৈরী খিচুড়ি খাওয়ায়।
এখন তো শুনছি কে-কে
পাবে খিচুড়ির ভাগ তাই নিয়ে লটারী হয়।
আমি একদিন জয়কে বললাম, চল, আজ তোমার ম্যাজিকের
খিচুড়ি খেয়ে আসি।
জয় দুষ্টু হাসি হেসে বলল, উঁহু হবে না, আমার স্পাই খবর এনেছে,
তোমাকে খিচুড়ি খাওয়ানো চলবে না।
আমি বললাম, সামান্য খিচুড়ি তাতেও আবার স্পাই, যা: বাব্বা, কেন
কি দোষ করলাম আমি?
--তোমাকে গোয়েন্দা লাগিয়েছে ওই গোপাল।
গোপাল যে বেশ ক’দিন ধরে আমার কাছে ঘুরঘুর করছে সে কথা তো
কারো জানার নয়।
আমার পড়ার ঘরটা দোতলায়। সেখানে গোপাল যখন
আসে তখন তো কাক-পায়রা, বেড়াল ছাড়া কাউকে দেখি না। তবে কি
ওই বেড়ালটাই জয়ের স্পাই?
গোপালকে বললাম, হবে না রে গোপাল, আমাকে দিয়ে তোর ওই খিচুড়ি
রহস্য উদ্ধার হবে না।
গোপাল বিমর্ষ গলায় বলল, কেন?
--- জয় আমাকে খিচুড়ি খেতে নিয়ে যেতে চাইছে না।
---কি করবি তুই ওর ওই খিচুড়ি খেয়ে, তোকে আমি খিচুড়ি খাওয়াব, আজকেই মাকে গিয়ে বলছি, রাতে তোকে ডেকে নিয়ে যাব।
--- তাতে কি তোর সমস্যার সমাধান হবে?
যেন খুব অবাক হয়েছে এমন গলায় গোপাল বলল, হবে না, কিন্তু ওই
খিচুড়ি খেয়ে তুই করবি টা কি তাই বুঝছি না, ধর, বাইচান্স পেটের
গন্ডোগোল হয়ে গেল, তখন কি করে রহস্যের সমাধান করবি?
---আমি জানতে চায়ছি, ওই খিচুড়ি খেতে কেমন, কিসে, কোথায়
তৈরী করে?
আমার কথায় গোপাল হেসে লুটিয়ে পড়ল। বলল, এই সামান্য কথা
জানার জন্য তোকে ওর খিচুড়ি খেতে যেতে হবে, প্রশ্ন গুলোর উত্তর
তুই আমার কাছে নে।
--- তুই কি করে জানবি, তুই তো কখনও জয়ের খিচুড়ি খাসনি।
আমার কথায় আরো একবার হেসে লুটিয়ে পড়ল গোপাল। বলল,
শুধু জয়ের বুঝি স্পাই আছে, আমার নাই ভাবছিস?
আমার অবিশ্বাস হলো না, যে ছেলেকে পাড়ার বেড়ালরা সমীহ
করে, তারা তার হয়ে স্পাইগিরি করবে, এ আর আশ্চর্য কি।
বললাম,
বেশ বল তোর স্পাই-রিপোর্ট।
--- খিচুড়িটা খেতে সাদামাটা, জয়ের একটা কাঠের বাক্স আছে।
ওতেই খিচুড়ি তৈরী হয়। বাক্সটা ওদের ছাদে থাকে।
---বাক্সটা একবার আনতে পারবি?
--- বাক্স নিয়ে কি করবি, ওটা একটা যাচ্ছে-তাই বাক্স, চারদিকে
কাঁচ লাগানো।
---কাঁচের কথাতেই কিছু একটা আঁচ পাচ্ছি, তুই বাক্সটা পাঁচ
মিনিটের জন্যে আনার ব্যবস্থা কর।
গোপাল গালে হাত দিয়ে বসে পড়ল। বলল, দোতলার ছাদ থেকে
বাক্স আনা,খুব কঠিন কাজ বুঝলি।
---কেন সেদিন তো খুব বলছিলি, তোর নাকি স্পাই আছে, তা
বেড়াল-স্পাইদের মত দু-একটা বানর-স্পাই কি নাই?
গোপাল অবাক চোখে একবার আমার দিকে তাকাল। তারপর যেন
নিজেকে শুনিয়েই বলল, আচ্ছা দেখছি চেষ্টা করে।
টিফিনে বাড়ি ফিরলাম। মা বললেন, গোপাল তোর পড়ার ঘরে
বসে আছে।
বিরক্ত হয়ে বললাম, ওই হতচ্ছাড়াটা শুধুশুধু স্কুল কামাই করে,
তারপর এখানে এসে ঘ্যানোর-ঘ্যানোর করবে, পড়া দেখিয়ে দে।
খাটের উপর শুয়ে আছে গোপাল। চোখ বন্ধ করে বলল, তোর
এই বাক্সের জন্য আমাকে স্কুল কামাই করতে হল।
বাক্সটা খাট থেকে নামিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলাম। বললাম, হুঁ,
যা ভেবেছিলাম, তাই, এটা একটা কৃত্রিম সোলার কুকার।
--- সোলার কুকার? খাট থেকে লাফিয়ে উঠল গোপাল। বললাম,
সাবধানে, মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে।
--- আরে ফ্যান নয়, আমার মাথার উপরে পৃথিবী ঘুরছে এখন।
ব্যাপারটা, একটু বুঝিয়ে বল তো।
--- বাক্সটা খুললে এর ডালার ভেতর আয়না সেট করা আছে দেখেছিস,
ভেতরেও সব আয়না ফিট করা। সূর্যের আলো বিভিন্ন ভাবে এর ভেতরে
ঢুকবে এবং তাপ সঞ্চয় করবে। চাল-ডাল-পানি ভেতরে রাখা টিফিন
ক্যারিয়ারে রাখলে তা খুব অল্প সময়ে খিচুড়ি হয়ে যায়।
--- হুঁ-হুঁ এবার বুঝেছি,বেশী খিচুড়ি অল্প সময়ে হবে না বলেই জয়বাবা
লটারীর মাধ্যমে খিচুড়ি খাওয়ায়।
চল, একবার স্কুলে যাই।
স্কুলে যাওয়া মাত্র জয় আমার হাত ধরে বলল, গোপালকে বলো
রহস্যটা যেন ফাঁস না করে।
গোপাল তার হাতে ধরা বাক্স দোলাতে-দোলাতে বলল, খিচুড়ি নয়
আমাকে কিন্তু চাউমিন খাওয়াতে হবে।
জয় হেসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তাই হবে রে হতচ্ছাড়া।
আমি সরে গেলাম অন্যদিকে।
মনে ভাবলাম, জয়-গোপাল তো
জুটি বেঁধে গেল, এবার আমার ভাগ্যে দূর্ভোগ আছে কিনা কে জানে!
*
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।