আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রিভিউঃ ভালবাসার রং

আজ সকালে মুভি পাগল গ্রুপের শর্টফিল্ম “অবশেষে-১”এর আউটডোর শুটিং একটু আগে আগেই শেষ হয়ে যাওয়ায় সিদ্ধান্ত হল সবাই মিলে বলাকা সিনেমা হলে “ভালবাসার রং” দেখতে যাব। মোট দশ জন ছিলাম। হলে লোক ছিল খুব বেশী হলে ৩০/৩৫ জন। কদিন আগেও শুনেছি এই সিনেমা দেখবার জন্যে হলে ভীড় উপচে পড়েছে। যা হোক, প্রত্যেক সিনেমার মত জাজ মাল্টিমিডিয়ার এই সিনেমাটিরও বেশ কিছু ভাল ও মন্দ দিক রয়েছে।

এখানে পর্যায় ক্রমে আমি ভাল ও মন্দ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করব। ভাল দিকসমূহঃ ১. প্রায় ৬/৭ মাস আগে কাকরাইলের ফ্লিম পাড়ায় অনেক পোস্টারের মাঝে প্রথম বারের মত আমি ভালবাসার রংএর পোস্টারটি দেখি। দেখেই মুগ্ধ হই। এই সিনেমার একটিই মাত্র পোস্টার ছিল সেখানে। ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে নায়কের এক হাতে ভর দিয়ে উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার থিমটুকু বলা যেতে পারে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের সিনেমার পোস্টার জগতে একটি আধুনিকতা ও নুতনত্ব সংযোজন করেছে।

এজন্যে এই পোস্টারের ডিজাইনারকে সাধুবাদ জানাই। ২. প্রচারণার বিষয়টি জাজ মাল্টি মিডিয়া খুবই সুনিপুন ভাবেই সম্পন্ন করেছে। তার প্রমান কিছুদিন আগেই হলগুলোতে দর্শকের উপচে পড়া ভীড়। বোঝাই যায় জাজ মাল্টিমিডিয়ার মার্কেটিং বিভাগ যথেষ্ঠ শক্তিশালী। ৩. ভালবাসার রং জাজ মাল্টি মিডিয়ার প্রথম সিনেমা।

কিন্তু এই সিনেমাটি আর দশটা সিমেনার মত শুধুই সিনেমা নয়, কারণ এই সিনেমার হাত ধরেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সিনেমা হলকে আধুনিকায়ন করা হযেছে। এবং যত দূর জানি আরো বেশ কিছু সংখ্যক হলকে এই আধুনিকায়নের আওতায় আনা হবে। সারা দেশ ব্যাপি যেখানে সিনেমার মন্দা ব্যবসার কারনে হলগুলো শপিং কমপ্লেক্স হয়ে যাচ্ছে সেখানে এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি মহৎ পদক্ষেপ। ৪. আমাদের দেশ বিভিন্ন দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও সিনেমা প্রযুক্তির ব্যাপারে আমরা সিনেমার জন্মের শুরু থেকে কখনওই উন্নত বিশ্বের থেকে পিছিয়ে ছিলাম না। (এই বিষয়ে আমার একটি লেখা রয়েছে, ঢাকাই সিনেমার বংশমর্যাদা)এবারও বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির রেড ক্যামেরা দিয়ে এই সিনেমাটি শুটিং করার মধ্য দিয়ে প্রমানিত হল যে সিনেমা প্রযুক্তির বিষয়ে আমরা কখনওই পিছিয়ে নেই, থাকবও না।

৫. সিনেমাটির সাউন্ড কোয়ালিটি অত্যন্ত শ্রুতিনন্দন। ৬. অমিত হাসান বোধ হয় তার জীবনের সেরা অভিনয়টা এই সিনেমায় করেছে। ৭. সিনেমাটিতে একটি আইটেম সং থাকলেও ‘তাকানোই যাচ্ছে না’ বা ‘শোনা যায় না’ এই রূপ কোন রূপ অশালীন দৃশ্য ছিল না। একসময় চলচ্চিত্র পরিচালকরা গলাবাজী করে বলত যে নগ্ন বা দৃষ্টিকটু নৃত্য, দৃশ্য বা সংলাপ না থাকলে দর্শক ধরে রাখা সম্ভব না। হুমায়ূন আহমেদ ও ফারুকী তাদের সিনেমা দিয়ে প্রমান করেছে যে যৌনতা ছাড়াও হলে দর্শক টেনে আনা যায়।

সুখের বিষয় যে ভালবাসার রং এই ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমদ ও ফারুকীদের তৈরী করা পথেই হেঁটেছে। ৮. এ্যকশন দৃশ্যে কিছু এফেক্টের ব্যবহার করা হয়েছে। এফেক্টগুলোর ব্যবহার যথাযথ কিনা সেই প্রশ্ন থাকলেও আমাদের সিনেমায় এই নুতন সংযোজনকে আমি স্বাগত জানাই। মন্দ দিকসমূহঃ ১. কাহিনী খুবই গতানুগতিক, নুতনত্ত্ব নেই। আমাদের পাশের দেশ ভারতের কাহিনী যেখানে প্রতি দশকেই একটু একটু করে পরিবর্তীত হচ্ছে সেখানে আমরা এখনও সেই বহুল চর্চিত কাহিনীতেই পড়ে আছি।

এটা অত্যন্ত দুঃখ জনক। এই দিকে পরিচালক, প্রযোজকদের বিশেষ নজর দেয়া উচিৎ। কাহিনী যদি আর্কষনীয় না হয় তবে শেষ পর্যন্ত কতটুকু র্দশক ধরে রাখা যায় আমার মনে হয় জাজ মাল্টি মিডিয়ার মার্কেটিং বিভাগ হাড়ে হাড়ে টের পেযেছে। ২. অমিত হাসান, রাজ্জাক, দারোয়ান চরিত্রের অভিনেতা ও ডাক্তার চরিত্রের অভিনেত্রীটি বাদ দিয়ে বাকি সবার অভিনয় অতি নিম্নমানের। তুলনামূলক ভাবে নায়িকার অভিনয় নায়কের চেয়ে সামান্য ভাল হলেও বর্তমান সময়ের র্দশক, যারা মাধূরী, বিদ্যা বালন, রানী মূখার্জী বা ক্যাটরিনার অভিনয় দেখে অভ্যস্ত তাদের চাহিদা কি এই মেয়ের বর্তমান অভিনয় মেটাতে সক্ষম? জাজ মাল্টি মিডিয়া বলতেই পারে যে ভারতীয় সিনেমার সাথে তুলনা করে আমি তাদের সাথে সুবিচার করছি না।

সে ক্ষেত্রে তাদের কাছে প্রশ্ন থাকল মাহি যদি তার অভিনয় দক্ষতার উন্নয়ন না ঘটায় তবে কি সে আমাদের শবনব, সুজাতা, রোজি সামাদ, কবরী, ববিতা, চম্পা, রোজিনা, শাবনাজ এমন কি অতি সাম্প্রতিক সময়ের শবনূর, মৌসুমি বা পূর্নিমার উত্তরসূরী হওয়ার ক্ষমতা রাখে? আর নায়কের অভিনয় নিয়ে আলাদা করে বলে সময় নষ্ট করার কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি না। একটা বিষয় ভুলে গেলে হবে না যে অনেক সিনেমা শুধু মাত্র ভাল অভিনয়ের কারনেই র্দশক প্রিয়তা পেয়েছে। অপর দিকে শুধু মাত্র খারাপ অভিনয়ের কারণেও বহু সিনেমার ফ্লপ করার রেকোর্ড রয়েছে। ৩. সিনেমার পাত্র পাত্রীদের পোষাক আষাক এলাকার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন মনে হয়নি। শুধু তাই নয় এখানে এমন অনেক কিছুই দেখানো হয়েছে যা মফস্বল শহরে থাকার কথা নয়।

অবশ্য এটা কেবল মাত্র এই সিনেমার দোষ নয়, এদেশের বেশীর ভাগ সিনেমাতেই এই সমস্যাটি থাকে। তবে ভালবাসার রং যেহেতু একটি বিগ বাজেটের সিনেমা তাই আশা করেছিলাম এখানে এই বিষয়গুলো খেয়াল করা হবে। ৪. কালার কারেকশন করা হয়নি। প্রায় পুরোটা ছবিতে একটা রেডিশ টোন ছিল। মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই কিছু কিছু দৃশ্যে কন্ট্রাস্ট বেশী হওয়ায় সেই দৃশ্যের কালার কড়া হয়ে যাচ্ছিল।

এত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি দৃষ্টি নন্দন ছবিই না পাওয়া যায় তবে সেই প্রযুক্তির কি মূল্য? ৫. এবার আসি সব চেয়ে গুরত্বপূর্ন বিষয়টিতে- ক্যামেরা ফ্রেমিং বা কম্পোজিশন। প্রচুর পরিমানে ওয়াইড শটের ব্যবহার সিনেমাটিতে রীতিমত অশৈল্পিক করে তুলেছে। সব চেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে অভিনেতা অভিনেত্রীর উপরে নিচে ডানে বাঁয়ে অনেকটা জায়গা রেখে ফ্রেম করা হয়েছে। আমার আমি ক্যামেরা কম্পোজিশন সর্ম্পকে যতটুকু জানি তার সবটা ব্যবহার করেও এটা কোন ধরনের ফ্রেমিং তা আবিষ্কার করতে পারিনি। ক্যামেরাম্যান ও পরিচালকের কাছে আমার প্রশ্ন এটা কি সুপার (!) ওয়াইড শট? ক্যামেরার নিজেস্ব একটা ভাষা আছে।

প্রত্যেকটা শটের কিছু মিনিং থাকে। এখানে যেহেতু প্রায় ৮০% শটই ওয়াইড সেহেতু কোন শটটির ব্যাবহার যথার্থ হয়েছে বা হয়নি সেই আলোচনা অবান্তর। জাজ মাল্টিমিডিয়ায় যারা আছেন আমি বিশ্বাস করি তারা সিনেমা বোঝেন, সেই সাথে একটি সিনেমায় ক্যামেরার কাজের গুরুত্ব কতটুকু এটাও তারা জানেন। আশা করছি সামনের সিনেমাগুলোতে তারা এটা বিশেষ ভাবে খেয়াল করবেন। কারণ খুব সাদামাঠা একটা কাহিনীকেও অসাধারণ ক্যামেরা ওয়ার্ক দিয়ে অসাধারণ সিনেমায় পরিনত করা যায়।

সর্বোপরি বলল, জাজ মাল্টি মিডিয়া বাংলাদেশের সিনেমা জগৎকে উন্নত করার জন্যে কাজ করছে, যা সবাই সাদরে গ্রহণ করেছে। ঠিক যেমন ভাবে চ্যানেল আইএর সিনেমা তৈরী বিষয়টিকে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এখন চ্যানেল আইয়ের সিনেমা মানুষকে কতটুকু আলোড়িত করে তা সবারই জানা। চ্যানেল আইয়ের সিনেমাগুলোতে সমস্যা হল সীমিত বাজেট। জাজ মাল্টিমিডিয়ার সেই সমস্যা নেই বলেই জানি।

কিন্তু চ্যানেল আইয়ের সিনেমায় যতটুকু শৈল্পিকতা আছে ভালবাসার রংএ তার কনা মাত্রও নাই। এই বিষয়ে জাজ মাল্টি মিডিয়া কতৃপক্ষকে বিশেষ নজর দেয়ার অনুরোধ করছি। উল্লেখ্য যে, শুধু কিছু দিন আগ পর্যন্ত আমি একটা বুটিকস চালাতাম। তার শ্লোগান ছিল ‘শৈল্পিক, বানিজ্যিক, স্বদেশিক’। অর্থাৎ শুধু শিল্প নয় বা শুধু ব্যবসা নয় এই দুটোর মাঝে অবশ্যই মিশেল ঘটাতে হবে।

সেই সাথে যদি স্বদেশীকতাটুকু রাখা যায় তবে সোনায় সোহাগা। আশা করছি জাজ মাল্টি মিডিয়া আমার বক্তব্যের মূল সুরটুকু ধরতে পারবে। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।