আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রামু সমাচার...

পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ অনন্য সাধারণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে পরিচিত। এই ব-দ্বীপে সকল ধর্মের, সকল বর্ণের মানুষ পাশাপাশি বসবাস করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। মাঝে-মধ্যে স্বার্থান্বেষী কিছু গোষ্ঠী রাজনৈতিক স্বার্থ বা অন্যবিধ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ঘটনা ঘটালেও সেসব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে হীন রাজনৈতিক ও গোষ্ঠী-স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনার রূপটি সামনে চলে আসে। এই ভূখ-ের বেশিরভাগ মানুষের ধাতটাই এমন যে, অতি উগ্রতা, ধর্মান্ধতা ও সঙ্কীর্ণতাকে তারা মনে-প্রাণে ঘৃণা করে। এ কারণে পাকিস্তান আমলে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়সহ পরবর্তী অন্যান্য সময়ে ধর্মের নামে এদেশে বড় রকমের সাম্প্রদায়িক বিভেদ-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি।

ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে দেশের জঙ্গিবাদের আমদানিকারকরাও ব্যর্থ হয়েছে। দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ জঙ্গিবাদ ও এর আমদানিকারকদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। সুতরাং এটি আজ প্রমাণিত বাস্তবতা যে, বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবগতভাবেই উদারতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থানকে পছন্দ করে। তবে নানান হীনস্বার্থ আর কুমতলবের আবর্তে যারা ঘুরপাক খায়, তারা সবসময়ই সংঘাত-সহিংসতার উপলক্ষ খোঁজে। এ কাজে তারা ধর্মীয় আবেগের বিষয় বা ক্ষেত্রকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

কারণ, ধর্ম অবমাননার বিষয়কে সামনে এনে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করা সহজ। ধর্মীয় বিষয় হলে কিছু মানুষ গুজবে কান দিয়ে কিংবা সত্যাসত্য যাচাই না করেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। কিন্তু এই বিক্ষুব্ধ আবেগের ছায়া অবলম্বন করে আসল অপকর্ম সম্পন্ন করে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর এজেন্টরা। তারা অবলীলায় পবিত্র ধর্মস্থানসহ নিরীহ জনগণের ওপর হামলা চালায়। লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ভয়ানক ত্রাস সৃষ্টি করে, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও স্বস্তিময় জীবন যাপনের বিরুদ্ধে প্রবল চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়।

কক্সবাজারের রামু, টেকনাফ ও উখিয়া এবং চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় সম্প্রতি বৌদ্ধ বিহার ও হিন্দু মন্দিরে হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ওইসব ন্যক্কারজনক অপপ্রয়াসের সর্বশেষ চেষ্টা। জানা যায়, এবারের ঘটনার পেছনেও অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ধর্মীয় আবেগকে। ঘটনার সূত্রপাত ফেসবুক ব্যবহারকারী এক বৌদ্ধ যুবকের একাউন্টে মুসলিম ধর্মগ্রন্থের অবমাননাকর ছবি ব্যবহার করা। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে, ওই যুবকের একাউন্টে ছবিটি আপলোড হয়েছে ইসরাইল থেকে। ছবি আপলোড হওয়ার পর বৌদ্ধ যুবকটি হয়তো বিষয়টি জানতেও পারেনি।

তার আগেই হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটানো হয়েছে কক্সবাজারের বিস্তৃত বৌদ্ধ পল্লীগুলোতে। অভিযোগ উঠেছেÑ বিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের ইন্ধন ও উগ্রপন্থী সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী স্বার্থান্বেষী মহল এবং কতিপয় রোহিঙ্গা সদস্য ও গুটিকয়েক এনজিও’র পৃষ্ঠপোষকতায় পরিকল্পিতভাবে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য সামনে নিয়ে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টার অংশ হিসেবেই চালানো হয়েছে এই অপকর্ম। ঘটনার মোটিভ ও প্রেক্ষাপট যা-ই হোক সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে এর সার্বিক কারণ খুঁজে দেখে দোষীদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। অবশ্য রামু ঘটনায় সরকারের তড়িৎ পদক্ষেপ সাধুবাদযোগ্য হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত না দায়ীরা চিহ্নিত ও শাস্তির মুখোমুখি না হয় ততক্ষণ দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ অস্বস্তিতে ভুগবে।

ঘটনার পর পরই ঘটনাস্থলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়–য়া, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ক্ষতিগ্রস্তদের সমবেদনা জানাতে ছুটে যান। পাশাপাশি সারা দেশের বিবেকবান মানুষ নানা প্রতিবাদ-বিবৃতির মাধ্যমে সমবেদনা জানাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্তদের। সরকারের তরফে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে অন্তত ২১৪ জনকে আটক করা হয়েছে। সহিংস ঘটনায় জড়িতদের খোঁজে কক্সবাজার সদর, রামু, উখিয়া ও টেকনাফে চলছে পুলিশের ব্যাপক ধরপাকড় অভিযান। পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত রয়েছে।

তবে রামু, উখিয়া ও টেকনাফের বৌদ্ধ পল্লীগুলোর মানুষের মন থেকে এখনও আতঙ্ক কাটেনি। বড়–য়া সম্প্রদায়ের লোকজন এখনও এ ঘটনা নিয়ে হতভম্ব। তাদের মতে, যেসব প্রতিবেশী মুসলমানদের নিয়ে বাপ-দাদার জীবন কাটিয়ে দেয়া হয়েছে, আপদে-বিপদে যারা এগিয়ে এসেছে, বাড়িতে আগুন লাগলে আগুন নিভিয়েছে আজ তাদের হাতে নিমেষেই শেষ হয়ে গেছে হাজার বছরের ধর্মীয় নিদর্শন ও ঐতিহ্য। তারা কিছুতেই এর হিসাব মেলাতে পারছেন না। রামুর ঘটনায় বিপুল টাকার লেনদেন! গত ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে সংঘটিত দেশের সাম্প্র্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসে ভয়াল ঘটনার নেপথ্যে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

এই লেনদেনের সঙ্গে একাধিক ব্যক্তি এবং সংগঠন জড়িত থাকতে পারে। গত ১ অক্টোবর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সমন্বয় সভায় এ বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে বলে জানা গেছে। ১ অক্টোবর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সমন্বয় সভা সূত্রে জানা যায়, কোটি টাকার বিনিময়ে যথেষ্ট সময় নিয়ে আঁটঘাট বেঁধে পরিস্থিতি তৈরির ছক এঁটে হামলা চালানোর বিষয়টি আলোচ্য বৈঠকে খুব গুরুত্ব পায়। এর পেছনে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ, রোহিঙ্গা সংশ্লিষ্টতা, জঙ্গিদের নাশকতা এবং এনজিও সংশ্লিষ্টতাও আলোচনায় উঠে আসে। বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা জানান, একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তার ক্লু খুঁজে পেতে অনেক কিছুই আলোচনার মধ্যে রাখতে হয়।

ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আলোচনায় স্থান পেয়েছে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের কথাটিও। ওই রাতের ঘটনায় মানুষ কেবল ধর্মীয় উন্মাদনার বশীভূত হয়ে এত বড় ‘ম্যাসাকার’ করে দেবে তা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তারা অভিমত ব্যক্ত করেন। ওই কর্মকর্তা জানান, একই পাড়া বা এলাকার মানুষগুলো যেখানে সকাল-সন্ধ্যা সুখে-দুঃখে একাকার থাকে, তারাই কি না মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিবেশীদের ঘরবাড়ি, উপাসনালয় এবং হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে পরিচিত মন্দিরে আগুন ধরিয়ে দেবেÑ তা কল্পনাতীত বলে মনে করা হচ্ছে। তদুপরি হামলায় জড়িতরা অপরিচিত মুখ হওয়ার কারণেই সন্দেহ করা হচ্ছে, ঘটনাটি পরিকল্পিত। আর এ রকম পরিকল্পিত ঘটনার নেপথ্যে টাকার লেনদেন না থাকাটাই বরং অস্বাভাবিক।

সে রাতের তা-বে যোগ দেওয়ার জন্য পার্শ্ববর্তী বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা, রামুর দুর্গম পাহাড়ি এলাকা গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, ঈদগড়, চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী, ঈদগাঁও, জোয়ারিয়ানালা, খুরুশকুল, কক্সবাজার শহরসহ আশপাশের আরো বিভিন্ন এলাকা থেকে গাড়িতে করে লোকজন আনা হয়। এমন অন্ধকার রাতে শুধু তাৎক্ষণিক উন্মাদনারবশে কেউ কারো ঘরবাড়ি এবং উপাসনালয়ে হামলা চালাতে যেতে পারে কি না সে প্রশ্ন ওঠে আলোচনায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানানো হয়, কক্সবাজার শহরের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রহমানিয়া মাদ্রাসা এলাকার প্রচুর রোহিঙ্গাকে সেই রাতে ভাড়ায় রামুতে নেওয়ার কথা কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন। তদুপরি দাহ্য পদার্থ নিয়ে পরিকল্পিতভাবে রাত ১১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত উপজেলা সদরের চারটি বৌদ্ধপল্লীতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি ঘটেছে কোনো হতাহতের ঘটনা ছাড়াই। যদি শুধু ধর্মীয় উন্মাদনায় এ কাজ করা হতো, তাহলে হতাহতের ঘটনা ঘটত বলে মতামত দেন অনেকে।

এমতাবস্থায়, প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুরুত্বসহকারে বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বলে সূত্র মতে জানা যায়। মামলা ও গ্রেপ্তার বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জেলার ৪ থানায় ১৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত মিলিয়ে প্রায় ২০০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামির তালিকায় থাকা বেশির ভাগই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে জানা গেছে। মামলায় আসামি হওয়া উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির তালিকায় রয়েছে, জেলা জামায়াতের নেতা ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূর আহমদ আনোয়ারী, উখিয়া উপজেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক সরওয়ার জাহান চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক সোলতান মাহমুদ চৌধুরীসহ বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা।

তবে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২১৪ জনকে আটক করা হয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা যায়। মিলছে না যেসব প্রশ্নের উত্তর ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর থেকে বৌদ্ধ বিহারগুলোর আশপাশে খ- খ- মিছিল হওয়ার খবর এলেও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, রাত সাড়ে ৮টায় বিক্ষোভ হওয়ার পর রামু সর্বোচ্চ বিহারে আগুন লাগানো, প্রথম বৌদ্ধ বিহারটি পুড়িয়ে দেয়ার ৩ ঘণ্টার মধ্যে একে একে আরও ১১টি বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, ২০টিরও বেশি বসতঘরে ভাঙচুর, উত্তেজিত স্লোগান দিয়ে লাঠিসোটা নিয়ে মহড়া দেয়ার বিষয়টি বৌদ্ধ বিহারের ভান্তেরা স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করার পরও ১৪৪ ধারা জারি না করা, গান পাউডার ব্যবহার করে বুদ্ধমূর্তিগুলো জ্বালিয়ে দেয়া, পেট্রোল ছিটিয়ে বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, ঢিল ছোঁড়ার জন্য চার কোনা কনক্রিটের ব্লক যোগাড় করা, ট্রাক-বাস-পিকআপে করে গ্রাম থেকে লোক আনা, পবিত্র কোরআন অবমাননার ছবিসংবলিত ফেস্টুন তৈরি করা ইত্যাদি ঘটনা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কিভাবে হলো, কারা করলোÑ এসব প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি। রামুর ইউএনও দেবি চন্দ্র জানান, এসব প্রশ্ন সামনে রেখেই উচ্চপর্যায়ের গোয়েন্দা টিম কাজ করছে। তিনি বলেন, শিগগিরই ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। ধরাছোঁয়ার বাইরে মূল হোতারা গত ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে ঘটে যাওয়া ন্যক্কারজনক ঘটনার পর উল্লেখযোগ্য সময় পার হলেও মূল হোতারা রয়েছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, তাদের পক্ষ থেকে দেয়া ঘটনায় জড়িতদের নামের তালিকার ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বৌদ্ধদের একাধিক নেতা জানান, এখন পর্যন্ত পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত মূল হোতাদের কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি। অথচ ঘটনাটি কাদের উস্কানিতে হয়েছে তা পরিষ্কার। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টায় চৌমুহনী চত্বর, ফকিরাবাজার, ম-লপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় কারা কোরআন অবমাননাকারীর শাস্তির দাবিতে উস্কানিমূলক মিছিল করেছে তা সবাই দেখেছে। পুলিশের সামনেই সেই মিছিল হয়েছে।

এমনকি পুলিশ মিছিলকারীদের নিরাপত্তা দিয়েছিল। জঙ্গি মিছিলের মাধ্যমে উস্কানিদাতাদের কেউ গ্রেপ্তার হচ্ছে না জানিয়ে বৌদ্ধ নেতারা অভিযোগ করে বলেন, ঘটনাটিকে এখন রাজনৈতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কিছু স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীও জড়িত। একটি সূত্র জানিয়েছে, ২৯ সেপ্টেম্বর রাতের ঘটনার সঙ্গে জড়িত এমন সন্দেহভাজন ৩০ থেকে ৪০ জনের নাম পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের ভূমিকা এবং গত এক সপ্তাহের কর্মকা- পর্যালোচনা করলে আসল রহস্য বের হয়ে পড়বে।

তাদের মোবাইল ফোনের কল লিস্ট পরীক্ষা করলেও তারা কাকে কিভাবে এই সহিংসতায় ব্যবহার করেছে তা বেরিয়ে আসবে। হামলাকারীরা ছিল পরিচিত! হামলাকারীদের বেশির ভাগই ছিল স্থানীয়। তাদের সবার হাতে ছিল লাঠিসোটা। অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরে অংশ নেয়া অনেকেই দেখে দেখে মন্দির ও বৌদ্ধদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে।

তাদের অভিযোগ অনুযায়ী অভিযুক্তরা হলেনÑ মৌলভী শফিক আহাম্মদ, হাফেজ হাবিবুল্লাহ, ফরিদ আহাম্মদ, রশিদ আহাম্মদ, মহিউদ্দিন, নূর আহাম্মদ, মৌলভী আবদুল রশিদ, আবুল ছৈয়দ, হানিফ, ছব্বির আহমদ, বদিউল আলম, রাহামত উল্লাহ, আবদুল কাদের, জাফর আলম, আবদুছ ছালাম, সৈয়দ আলম, মৌলভী নুরুল ইসলাম, আবদুল্লাহ, সেরাফত আলী, হেলাল, ফজল, ওয়াদুল, সাদ্দাম হোসেন, রমজান আলী, ওসমান গণি, মোজাফফর আহমদ, আমিনুল কবির, শফিউল কবির, সরওয়ার আলম, আবুল কাশেম, আবদুল মাসুদ, দেলোয়ার হোসেন, জহির আহমদ, দিদারুল আলম দিদার, আজিজ, জহির আহমদ, গিয়াসউদ্দিন, হাফেজ আহমদ, মিজান মেম্বার, সাফী, নুরুল উল্লাহ, ইলিয়াস, মেহেদী, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, সিরাজুল ইসলাম ভুট্টো। সন্দেহে স্থানীয় এমপি ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সন্দেহ রয়েছে স্থানীয় এমপি লুৎফুর রহমান কাজলের বিরুদ্ধেও। তবে তিনি অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অনুরোধে তিনি ২৯ সেপ্টেম্বর রাত ১২টার পর রামুর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। রামু সদরে পৌঁছে দেখেন বিক্ষুব্ধ লোকদের সমাবেশে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল বক্তব্য দিচ্ছেন। পরে তিনিও বক্তব্য দেন এবং লোকজনকে শান্ত থাকতে বলেন।

এ সময় ইউএনও, ভাইস চেয়ারম্যান মুন্নী, এএসপি সার্কেল এবং ওসি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় এমপি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ১৪৪ ধারা জারি করতে এবং পুলিশ সুপারকে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েনের অনুরোধ করেন। ফলে ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করার কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বক্তব্য মেরংলোয়া সীমা রাজবন বৌদ্ধবিহার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক তরুণ বড়–য়া জানান, ঘটনার পর থেকে চরম অসহায়বোধ করছেন তারা। তাদের মতে, যাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন একসঙ্গে বাস করছি, তারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাবে তা কল্পনাও করতে পারিনি।

পুলিশ প্রশাসনকে দায়ী করে তিনি বলেন, এটি রামুর ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। ন্যক্কারজনক এ ঘটনায় রামুর দীর্ঘদিনের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়েছে। মেরংলোয়া গ্রামের বাসিন্দা কলেজ শিক্ষক ববিতা বড়–য়া জানান, আচমকা অনেকগুলো লোক এসে তার বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট শুরু করে। পরে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগে এমন ঘটনা কখনও দেখিনি।

হঠাৎ করে কেন এ ধরনের হামলা হলো তার কারণও খুঁজে পাচ্ছি না। কাউয়ারখোপ হাকিম রহিমা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক সুমথ বড়–য়া জানান, রামুতে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধদের সম্প্রীতি অত্যন্ত চমৎকার। জেলায় এ উপজেলার আলাদা সুনাম ও ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু শান্ত রামুকে কারা হঠাৎ অশান্ত করে তুললো তা বুঝতে পারছি না। এ এলাকার বেশ কয়েকজন বলেন, ২৯ সেপ্টেম্বর রাতের হামলার ঘটনায় বাইরের লোকের সঙ্গে রামু সদরের স্থানীয় কিছু লোকের ইন্ধনও ছিল।

তবে এ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত বলে যাদের নামে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা সঠিক নয় বলে দাবি করছেন অভিযুক্তরা। তাদের দাবিÑ ব্যক্তিগত শত্রুতা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার হীন চক্রান্ত হিসেবে তাদের হয়রানি করার চেষ্টা করছে প্রতিপক্ষ স্বার্থান্বেষী মহল। উল্লেখ্য, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামু উপজেলার বড়–য়াপাড়ার উত্তম কুমার বড়–য়া নামের এক যুবকের ফেসবুক থেকে পবিত্র কোরআন শরীফকে অবমাননা করে একটি ছবি ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় রামুতে মধ্যরাতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ওই সহিংসতায় রাতেই রামুর প্রায় ২০টি বৌদ্ধ মন্দির, অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকান পুড়িয়ে দেয় উচ্ছৃঙ্খল জনতা। পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

সর্বশেষ অবস্থা এদিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়, ঘটনাস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরাও স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা করছে। এতে করে এলাকার পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে। ১৪৪ ধারা তুলে নেয়া হয়েছে। আতঙ্কিত ও ক্ষতিগ্রস্তরা পুনরায় বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে।

স্থানীয় প্রশাসন ও সেনা সদস্যরা সম্মিলিতভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। ফলে স্থানীয়দের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসছে। তাদের মাঝে সৃষ্ট ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক অনেকটা কেটে গেছে। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় এলাকাবাসী তাদের স্বাভাবিক কাজকর্মে মনোনিবেশ করতে শুরু করেছে। এলাকার হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমানদের মাঝে শীঘ্রই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আগের ন্যায় ফিরে আসবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।

এলাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার সেলিম মোঃ জাহাঙ্গীর স্বদেশ খবরকে বলেন, সামরিক, বেসামরিক প্রশাসন ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে কক্সবাজারের রামু ও উখিয়া এবং চট্টগ্রামের পটিয়াসহ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার সামগ্রিক পরিস্থিতি এখন বেশ শান্ত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার সেলিম মোঃ জাহাঙ্গীর বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে খুবই সচেতন ও সজাগ রয়েছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন উপলক্ষে নিউইয়র্কে থাকা অবস্থাতেই এক্ষেত্রে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে প্রশাসনকে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। ’ প্রশাসন সে মতে কাজ করাতে জনমনে ধীরে ধীরে স্বস্তি আর শান্তি ফিরে আসে।

লিংক ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.