আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রামু রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশের রাজনীতি

সুরেশ কুমার দাশ ঃ রাজনীতি। এটা জাতীয় হোক কিংবা আন্তর্জাতিক হোক। রামুর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের পর আমরা কিছুটা টের পাচ্ছি। রামুর সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে অনেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটাকে মেলাতে চাচ্ছে। মিল দিতে পারলে ভালোই হত।

মিলে গেলে এটা কাকতালীয় হতে পারে রামুর ঘটনার সঙ্গে। তবে যে সময়ে বার্মায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছিল তখন বাংলাদেশের সরকার সেখানে জামাতের ইন্ধনের কথা বলেছিল। সরকার এখানেও ইসলামী উগ্রপন্থিদের দিকে আঙ্গুল তুলেছে। যদিও রামুর ঘটনার শুরুটা সরকার দলীয় স্থানীয় উগ্র আওয়ামী লীগারদের ইন্ধনে বলে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে বার বার বলা হচ্ছে। তবে সরকার দলীয় ‘মহানরা’ সেই কথা মানতে নারাজ।

মানার দরকার নেই। ঠিকমত তদন্ত হোক। তবে কেন মানতে নারাজ সেই কথা আজগুবী গল্প শোনার মত। আওয়ামী লীগ দলীয়রা কেন মনে করছে তাদের দলে মুসলিম উগ্রবাদীরা নেই। শুধু জামাত শিবির বা হিজবুত তাহরির কিংবা অন্য উগ্রপন্থি দলেই নয় এরা।

জামাত বা ইসলামী নামের দল করলেই উগ্রপন্থী হয়না। উগ্রপন্থা মনে মনেও লালন করা যায়। আর সুযোগ বোঝে কোপ মারা যায়। আওয়ামী লীগ ভুল করছে আরও একটা জায়গায় সেটা হচ্ছে আরও বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেষ্টা হয়েছিল চট্টগ্রামে কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রচেষ্টায় সেগুলো শুরুতে বন্ধ করে দেয়া সম্ভব হয়। তাহলে রামুতে যারা আওয়ামী লীগ করে তারা কি মৌন থেকেই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের জন্য সম্মতি দিয়েছিল।

কারণ মৌনতা সম্মতির লক্ষ্মণ বলে আমরা মনে করে আসছি। দেশে আওয়ামী লীগের সব নেতা কর্মিরাই যদি আওয়ামী দলীয় আদর্শ লালন করে তাহলে বিপুল ভোটে বিজয়ী বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার চাইলে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধান থেকে তুলে দিতে পারে। তুলে দিতে পারে ‘বিসমিল্লাহর নামে শুরু করছি কিংবা মহান আল্লাহর নামে’ শুরু করছি। আওয়ামী লীগ সরকারের সেই সাহস নিশ্চয়ই নেই। না থাকার কারণ তাদের দলীয় আদর্শ মেনে সকলে এ দলকে সমর্থন করেনা।

তারপর আওয়ামী লীগ যে টুকুন ধর্মীয় উদারতা লালন করে তা একজন সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী কিংবা অসচেতন কর্মির রাজনীতি করার মূল উদ্দেশ্য নয়। রাষ্ট্র ও রাজনীতি এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য সচেতন জনগণ জরুরি। যে সচেতন করার অনেক কাজে খুব স্বল্প শিক্ষিত মোল্লাদের ব্যবহার করা হয় তাতে জনগণ কার কথা শোনে। প্রধানমন্ত্রী যখন রামুতে বক্তব্য দিচ্ছেন তার আগে স্থানীয় মসজিদের ইমামকেও বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। এতে বোঝা যায় রাষ্ট্রের সেকুলারিজম বোঝানোর প্যারামিটার।

একজন মোল্লা দিয়ে উগ্রপন্থিদের বশে আনতে হচ্ছে। আইন প্রশাসন কিংবা রাষ্ট্রের পরিকাঠামো দিয়ে নয়। প্রশাসনের কথা আসছে। স্থানীয় বিএনপি সাংসদের এতই শক্তি প্রশাসন এবং আওয়ামী নেতাদের বর্তমানে তিনি একাই এতবড় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সৃষ্টি করলেন। যদি বলি স্থানীয় বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামাত, রোহিঙ্গা আর প্রশাসনের সরাসরি সহযোগিতায় এত বড় অঘটন ঘটানো হয়েছে।

এটা মূলত রাষ্ট্রে উদারতা, সহনশীলতা ও ন্যায়বিচারবোধের অভাবের কারণে হয়েছে। যেখানে কোন মানুষের বিবেকও কাজ করেনি। অসম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশের হাতেগোণা কিছু সুশীল নাগরিকের প্যাশন নাকি প্রচারমাধ্যমে প্রচার পাওয়ার কৌশল তা বলার সময় এখনও আসেনি। তবু তারা মিডিয়ায় বুলি আওড়ায় বলে এদেশের ‘সেকেন্ড ক্লাস নাগরিকরা’ কিছুটা ভরসা পায়। তাও এ ভরসাটা একপেশে হয়ে যায়।

কারণএ ভরসা পেয়ে নির্ভয় অনুভব করে সেসব হাতেগোণা সেকেন্ড ক্লাস নাগরিকরা যাদের সঙ্গে সেসব প্যাশন দুরস্ত ফাস্ট ক্লাশ মুসলিম নাগরিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে। তাদের সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশের রামু বা অন্য হাজার হাজার হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সাধারণ জনগণ নিজেদেরকে সাম্প্রদায়িকতার শঙ্কা ও আতঙ্ক থেকে মুক্ত কিংবা স্বাধীন নাগরিক বলে মনে করে না। সাম্প্রদায়িকতার আতঙ্ক ও শঙ্কা থেকে মুক্ত মানুষ ভাবতে হলে রাষ্ট্র কঠোর আইনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা বন্ধ করতে পারে। কিংবা সাম্প্রদায়িকতা চিরতরে ভুলিয়ে দিতে হলে সাম্প্রদায়ক সহিংসতা ও সন্ত্রাস ও হানাহানির পুরনো ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়ার মত সৌহার্দ্য দেখাতে হবে। কিন্তু পোড়া মন্দির, ভাঙ্গা মূর্তি পুন স্থাপনের আগেই আবার নতুন মন্দির পুড়ছে, নতুন মূর্তি ভাঙ্গছে।

ভুলে যাবার মত কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বছর না ঘুরতেই একটার পর একটা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। অর্থাৎ পুরনো ক্ষত না শুকাতেই নতুন নতুন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে ক্ষত বিক্ষত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এখন আমি রাজনীতির কথায় আসি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কথা বলছি।

তারা নিজেদের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক দল হিসাবে দাবী করে। এ দলের নেতারা এটা জোর গলায় বলতে চান। এটা কি স্রেফ বক্তৃতা নাকি সত্যিই তাদের সব নেতা কর্মি সমর্থকদের প্রকৃত চেতনা তা কোন মাপকাঠিতে নির্ণয় করা হয়নি। ইসলামকে দু ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সারা বিশ্বে। এক অংশ মুসলমান নিজেরাই আতঙ্কিত।

আবার এক অংশ মুসলমানকে দিয়ে সম্প্রদায়গত আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে। উপরের কথাগুলো বলেছি একটা সুসমন্বিত রাষ্ট্রের আশায়। বলা হচ্ছে রামুর ঘটনার কিছুদিন আগে মার্কিন চার উপ সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বার্মা হয়ে কক্সবাজার গিয়েছিলেন। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তারা বার্মা সরকারকে রাজী করাতে না পেরে উল্টো বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবদার নয় চাপ দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার জন্য বা এরকম কিছু। মনে রাখা দরকার বার্মায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগেও সেখানে আমেরিকার কর্তাব্যক্তিরা গিয়েছিলেন।

তারপর সেখানে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু করে বৌদ্ধরা। বার্মায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করা হয়েছিল বৌদ্ধ নারীকে ধর্ষণের কথা বলে। রামুতে তা শুরু করা হয় কোরান অবমাননার কথা বলে। তবে বার্মায় এ সাম্প্রদায়িক নিধনযজ্ঞ সরাসরি রাষ্ট্রের সহযোগিতায় হয়েছিল। বাংলাদেশে স্থানীয় প্রশাসন এবং স্থানীয় রাজনীতির যোগসাজসে।

এটা মূলত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সামান্য পার্থক্য। এখন আমেরিকার কথায় আসি। কিছুদিন আগেও আমেরিকা বার্মার জন্য মায়াকান্না করত। এখন তারা আর মায়াকান্না নয় সত্যি সত্যি কান্না করছে। যতই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিদের মন্দির ও ঘরে আগুন দেয়া হোক বা রোহিঙ্গাদের লাশের সারি পড়–ক তাতে কিছু যায় আসেনা।

আমেরিকার স্বার্থটা আসলে দেখতে হবে। যদি ধরে নিই আমেরিকা সহ গোটা বিশ্বজুড়ে অংসাং সুচিকে এত এত সংবর্ধনা এমনি এমনি দেয়া হয়নি। তাহলে কি দাড়াঁয়। কারণ ‘সুচি ম্যাডাম’ কোথাও বার্মার রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিধনযজ্ঞের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা দেখাননি এমন কী মায়াকান্নাও না। এখন বিষয়টা যদি এভাবে দেখা হয়- বার্মায় সামরিক শাসনে সবচেয়ে আস্কারা ছিল চীনের।

কোন কারণে চীনের অবস্থান হয়ত টলে গেছে। কারণ বার্মায় পরমানু অস্ত্র বানানোর পরিকল্পনা চলছে এমন প্রচারণাও চালিয়েছিল আমেরিকা। ‘সোফা’ ‘হানাচুক্তি’ কিংবা নৌবহরের কথা বলে বাংলাদেশ থেকে যা পায়নি আমেরিকা তা যদি বাংলাদেশের পাশের দেশ বার্মা থেকে পাওয়া যায় তাতে বৌদ্ধ বা রোহিঙ্গারা দেশ আর ধর্মছাড়া হলে আমেরিকার কী এমন ক্ষতি। নিজেদের স্বার্থের জন্য তারা ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়ার কত বড় সর্বনাশই না করেছে এবং করে চলেছে। বার্মা গোপনে পরমানু অস্ত্র তৈরি করছে এটা নেহায়েত কোন প্রচারণা ছিল না।

হতে পারে বার্মাকে আমেরিকার থ্রেট। এমন থ্রেট করেই তারা ইরাক আক্রমণ করেছিল। পরের কথা তো সবারই জানা। চীনের আতঙ্ক থেকে রক্ষা পেতেই তাদের আজকের রোহিঙ্গা আর রামুর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস কিনা। শতাধিক বছর ধরে বার্মা চাচ্ছিল রোহিঙ্গাদের সেখান থেকে তাড়ানোর জন্য।

ইতিহাস ঘাটলে মনে হয় এটা যে কোন বার্মা সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। ঐতিহাসিক তথ্য মতে শুধু ব্রিটিশ আমল ছাড়া কোন সময়ে বার্মায় শান্তিতে ছিল না রোহিঙ্গা মুসলমানরা। আওয়ামী লীগ সরকার এদেশে কিছুটা সেকুলারিজমের কথা বলছে। তাই এ সরকারের আমলে যদি সাম্প্রদায়িক হানাহানি সৃষ্টি করা যায় তাহলে বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার যেটুকু ভিত আছে সেটুকু নড়বড়ে হয়ে যায়। অন্যদিকে কক্সবাজার তথা চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িকতা এবং রোহিঙ্গাদের গুপ্তভাবে সংগঠিত হবার বিষয়টা এ অঞ্চলের ঘাড়ে চেপে বসবে।

তাতে মার্কিনিদের উদ্দেশ্য সফলতার মুখ দেখবে। আর কাকতালীয়ভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে মিলে যাওয়াটা জামাতের একটা আপাত সুবিধা বটে। হয়ত। ইতিহাসের তথ্যমতে কক্সবাজার, রামু, সাতকানিয়া, উখিয়া এবং টেকনাফে আসলে যেসব মুসলিম বসতি আছে তাদের অন্তত ৬০ শতাংশ রোহিঙ্গা মুসলমান। যারা চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন তারা জানার কথা এটা।

এ কথাটা কেন বললাম- কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির সাংসদকে দুষছেন। তার আগে এ ঘটনার জন্য যারা মিছিল -জনসভা করেছিল সেসব লোকদের আদি বাসস্থান কিংবা কোন সম্পর্ক আরাকানের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আছে কিনা তা জরুরিভাবে দেখার বিষয়। যদি বিএনপির সাংসদও তাই হন। একজন রোহিঙ্গা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি করতেই পারে। কারণ এখানে তার একটি রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে তার উদ্দেশ্যটা বাস্তবায়ন করা অনেক সহজ।

এবং আওয়ামী লীগ করলেই কেউ সাম্প্রদায়িক বা মতলববাজ হবে না তাও নয়। তাই যদি হত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে এ সরকার কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যেতে পারত। মূলত আমাদের গণতান্ত্রিক চেতনা উন্নত না হলে, প্রকৃত নাগরিক অধিকার সম্পর্কে না বুঝলে আমরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে হানাহানি করব। এখানে সাম্প্রদায়িক হানাহানি কতটা সহনীয়। কারণ আমাদের মধ্যে দ্বিধা- বিভক্তি তৈরি হলেই আমাদের ঘাড়ে চাপবে আমেরিকা বা অন্যরা।

যে দেশের নাগরিক রোহিঙ্গারা সেদেশে গিয়ে আমেরিকা কোন মাতবরি ফলাতে পারে না। উল্টো বাংলাদেশকে চাপ দেয়। এতে কি মনে হয়না তারা আমাদের দুর্বলতা দেখছে। দুর্বলতা এটা যে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিলেই আমরা দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ব। হানাহানি করব।

বার্মা শুধু একটা বৌদ্ধ রাষ্ট্র। কিন্তু আমরা বিভিন্ন সম্প্রদায় ও সংস্কৃতিতে বিভক্ত। এ কারণে আমাদের রাজনৈতিক,রাষ্ট্র ও নাগরিক সচেতনতা আরও বেশি দরকার। হয়ত। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.