আমি একজন পর্যটন কর্মী। বেড়াতে, বেড়ানোর উৎসাহ দিতে এবং বেড়ানোর আয়োজন করতে ভালোবাসি।
তারেক মোরতাজা কক্সবাজার থেকে
কক্সবাজারের রামু ও উখিয়ার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আস্থা ফেরানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তাদের ওপর ফের কোনো হামলা হবে না কিংবা তারা ধর্মীয় স্বাধীনতার পূর্ণ অধিকার নিয়ে আবার আগের মতো সহঅবস্থানে থাকতে পারবেন কিনা এসব নিয়ে শঙ্কায় আছেন বৌদ্ধরা। এক সপ্তাহের বেশি সময় পরেও সেখানকার বৌদ্ধদের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি, ফিরেনি আস্থাÑ জানিয়েছেন কক্সবাজার বুডিডস্ট ফেডারেশনের সভাপতি বোধিমিত্র বড়–য়া।
তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা সম্প্রীতির সাথে আগের মতো এক সাথে বসবাস করতে চাই।
কক্সবাজার বিজিবির ১৭ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে: কর্নেল খালেকুজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, নিরাপত্তা নিয়ে এ মুহূর্তে কোনো সমস্যা নেই। তবে নিরাপত্তা কর্মীরা ফিরে গেলে পরিস্থিতি কী হয় তা নিয়ে উদ্বেগ আছে।
রামুর ফতেখাঁর কুল ইউনিয়নের পুরনো সীমাবিহারের কাছে তিনি নয়া দিগন্তের সাথে আলাপ করছিলেন। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম বৌদ্ধদের মধ্যে আস্থা ফেরানো সম্ভব কিভাবে? তিনি বলেন, এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক রাখতে হবে।
আর এলাকার মানুষের মধ্যে যাতে সম্প্রীতি ফিরে আসে সে জন্য সব ধর্মের লোকজন ও রাজনীতিবিদদের এক সাথে কাজ করতে হবে।
একই রকম কথা বলছিলেন, বৌদ্ধবিহারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা। তিনি গতকাল নয়া দিগন্তকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, আপনারা কী মনে করছেন? নিরাপত্তা কর্মীরা উঠে যাওয়ার পর কী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। নাকি ফের কোনো সমস্যা হতে পারে?
পশ্চিম মরিচ্যার দীপাংকুর বৌদ্ধবিহারের সামনেই তার সাথে আলাপ হচ্ছিল। তিনি এর উত্তরও দেন।
বলেন, এখানে সঙ্কট কাটানোর জন্য সবাইকে এক সাথে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা যাতে অব্যাহত থাকে সে দিকে নজর দিতে হবে।
তিনি বলেন, আমার এ ক’দিন এখানে থেকে মনে হচ্ছে, বৌদ্ধ ও মুসলিমদের সম্পর্ক জোড়া লাগতে বেশ সময় লাগবে। এখনো অনেকে আমাদের বলছেন, তারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। তাদের এ আতঙ্ক কাটাতে হবে।
এ রকম এক প্রেক্ষাপটে আজ রামু যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি রামুর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখবেন, বিহারের ভান্তেদের সাথে আলাপ করবেন, সাধারণ মানুষের সাথেও তার মতবিনিময় করার কথা রয়েছে। পুরো উপজেলায় নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে সেনাবাহিনী ও বিজিবি। তাদের সাথে রয়েছে এসএসএফও।
ধারণা করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর সেখানকার মানুষের মধ্যে একটা আস্থা ফিরে আসবে।
যাতে সামনের দিনগুলোতে কোনো রকমের সমস্যা দ্বিতীয়বারের মতো সৃষ্টি না হয়। গত ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে রামুর বৌদ্ধ পল্লীতে জঘন্য ঘটনা ঘটে। পুড়িয়ে দেয়া হয় বৌদ্ধবিহার ও বুদ্ধের মূর্তিসহ মূল্যবান অনেক ধর্মীয় গ্রন্থাদি। পর দিন উখিয়াতে একই রকমের হামলা হয়। এসব হামলার নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতৃবৃন্দ।
উখিয়াতে সরকারদলীয়দের দায়ী করে মামলাও হয়েছে। তবে সেখানে সরকার সমর্থক কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
রামুর সীমাবিহারের সেক্রেটারি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তরুণ বড়–য়া নয়া দিগন্তকে বলেন, এখন আস্থা ফেরানোটাই মূল লক্ষ্য। যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে। তদন্ত করে আসল অপরাধীদের শাস্তির পাশাপাশি এখানে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বোধ আগের মতো জাগিয়ে রাখতে হবে।
সে জন্য সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওঠে যাওয়ার পর আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা কাটানোর জন্য স্থানীয় রাজনীতিবিদ, ধর্মীয় নেতা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় হতে হবে।
একই রকম কথা বলেছেন, উখিয়ার দীপাংকুর বৌদ্ধবিহারের ভান্তে বিমল জ্যোতি। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা একবারেই বিচ্ছিন্ন। এখানে ১২-১৩ বছর ধরে আছি।
কোনো দিন কেউ একটা ঢিলও ছোড়েনি। হঠাৎ করে কেন এমন ঘটনা ঘটল বলতে পারব না।
কপালে হাত ঠেকিয়ে বিমল জ্যোতি বলেন, এটা আমার কপাল। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে এসে তিনি এখানে বসবাস করছেন। শিখাচ্ছেন অহিংসার বাণী।
কিন্তু সে বিহারে হিংসার যে আগুন ৩০ সেপ্টেম্বর লাগানো হয়, তাতে মন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে তার।
ধ্বংসস্তূপের দিকে হাত রেখে তিনি বলেন, এর সব তো জড় পদার্থ কিন্তু আমাদের মন ভালো নেই। আমরা আশ্বস্ত হতে পারছি না।
এখন সেনাবাহিনী আছে। বিজিবি আছে।
তারা চলে গেলে আমাদের কী হবে। সেটা ভাবতেই আতঙ্কিত হতে হয়। তবে এ আতঙ্ক যেন কেটে যায় সে জন্য আমরা প্রার্থনা করছি। সরকারকেও নিরাপত্তা রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বৌদ্ধদের সাথে মুসলিমদের কোনো কালেই বিবাদ ছিল না। এখন হঠাৎ করে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে, সেটাকে মিটিয়ে আমরা আবার ভাই ভাইয়ের মতো চলতে চাই।
আমরা এ ঘটনার বিচার যেমনি চাই, তেমনি বিচারের নামে কারো হয়রানি আমাদের কাম্য নয়।
উখিয়া উপজেলা শহরের ওপর জাদিমুড়া বৌদ্ধবিহারটি রয়েছে। তার ভান্তে জ্যোতি শুভ নয়া দিগন্তকে বলেন, ঘটনার পর স্থানীয় লোকজনদের বাদি করে মামলা করেছে সরকার। তারা এখন আমাদের হুমকি দিচ্ছে। বলছে, মামলা তুলে নিতে।
নইলে পুরো মন্দির গুঁড়িয়ে দেবে। আমরা প্রশাসনকে এ সব জানিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ফল পাইনি। তাই একটা আতঙ্ক আমাদের সব সময় তাড়া করে যাচ্ছে। আমরা এখানে মুসলিমদের সাথে আগের মতো থাকতে চাই।
যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন নতুন করে সম্পর্ক জোড়া দিয়ে আমরা সম্প্রীতির বন্ধনে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।
তিনি বলেন, আমরা আশা করব সরকার আমাদের দিকটা বিবেচনা করে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়াবে।
রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেবী চন্দ নয়া দিগন্তকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শুরুতেই পূর্ণ প্রত্যাহার হচ্ছে না। সেনা ও বিজিবি চলে গেলেও পুলিশ থাকবে।
আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এখানকার আস্থার সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারব বলে আশা করছি।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জহিরুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, নিরাপত্তা পরিস্থিতি প্রতিদিনই উন্নতি হচ্ছে। আশা করছি সেনা-বিজিবি মাঠে থাকতে থাকতে আমরা একটা ভালো পরিস্থিতি পাবো। এরপরই তাদের প্রত্যাহার করা হবে।
আতঙ্ক কাটানোর জন্য গত শুক্রবার মসজিদে বিশেষ খুতবা দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধর্মীয় সম্প্রীতি যাতে বজায় থাকে সে জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখছি।
একটা হামলার পরে এখানে আস্থার একটা সঙ্কট থাকবেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা চাই সবাই নির্বিঘেœ তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করুক। সবাই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুক। সে জন্য সরকারিভাবে যা করার তার সবই করা হবে।
রামুর উত্তম বড়–য়া নামে এক যুবক তার সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে পবিত্র কুরআন শরিফকে অবমাননা করা কয়েকটি ছবি ট্যাগ (যুক্ত) করে। এটি দেখার পর রামুর জনসাধারণ ক্ষিপ্ত হয়।
তিনি বলেন, পবিত্র কুরআন অবমাননার ছবি উত্তেজনা তৈরি করে থাকতে পারে। কিন্তু তার জন্য বিহারে হামলার ঘটনা সঠিক ছিল না। প্রাথমিকভাবে ফেসবুকের এ ছবিটিকে হামলার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। তবে এর প্রকৃত কারণ রাজনৈতিক বলেই বৌদ্ধরা মনে করছেন। এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা বলে তারা জানিয়েছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।