প্রজন্মের হাত ধরে জাগরণের পথে ইসলামের অনুসারীদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবনমনের পর এবং ধর্মনিরপেক্ষতার উপর ভিত্তি করে পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের উত্থানের পর একটা বিশাল সময় ধরে তথাকথিত আঁতেল বুদ্ধিজীবীদের মুখে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসকে অন্ধ বিশ্বাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এখনও সমাজতন্ত্রীরা স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসকে আফিমতুল্য মনে করে, বিজ্ঞান কর্তৃক স্রষ্টাকে আবিষ্কার করার ব্যর্থতা এবং বিবর্তনবাদ তাদের আত্মতৃপ্তির পালে হাওয়া দিয়েছিল। নিম্নে আমরা আলোচনা করার চেষ্টা করব যে, স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস অন্ধ বিশ্বাস, নাকি নাস্তিকতা অন্ধ বিশ্বাস। এইখানে স্পষ্ট হয়ে নেয়া ভাল যে, স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণিত হলে, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, ফ্রীডম বা ব্যাক্তি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র প্রভৃতি ধারণাগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক বৈধতা হারাবে। অর্থাৎ স্রষ্টা প্রদত্ত জীবনব্যবস্থার বাইরে অন্য সকল জীবনব্যবস্থা বুদ্ধিদীপ্ত মনের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
প্রথমে, আমরা দেখব যে, বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দিয়ে স্রষ্টাকে প্রমাণ করা কতটা যৌক্তিক। বস্তুত, বিজ্ঞান শুধুমাত্র ঐসকল বিষয় নিয়ে মতামত দিতে পারে, যেইসব বিষয় পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা তার আছে। উদাহরণস্বরূপ, ১ টা ৫ ফুট লম্বা টেবিল যে ৫ ফুট, এটা বিজ্ঞান তখনই বলতে পারবে, যখন তার কাছে ফুট এর সংজ্ঞা জানা থাকবে। কিন্তু টেবিলকে মাপতে পারলেও কোন ব্যক্তি এটা বানিয়েছে, বা আদৌ এটা কেউ বানিয়েছে কিনা, কিংবা সে দেখতে কেমন, কি খায়, কি পরে এইসব প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারেনা। বিজ্ঞান শুধু বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করে তার বৈশিষ্ট্য আমাদেরকে জানাতে পারে।
কিন্তু বৈশিষ্ট্যের কারণ জানাতে পারেনা। যেমন ২ টা হাইড্রোজেন (H) ১ টা অক্সিজেন (O) এর সাথে মিলে পানি তৈরি করে, কিন্তু কেন পানিই তৈরি করল, আগুন কেন তৈরি করলনা, এই ব্যপারে বিজ্ঞান নীরব। সে শুধু বস্তুর গুনাগুন বা বৈশিষ্ট্য বলতে পারে, ততটুকুই যতটুকু সে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল থেকে অবগত হয়। তাই এই সীমিত বিজ্ঞান কে দিয়ে স্রষ্টাকে খুঁজে না পেলেই যে তাকে অস্বীকার করতে হবে, এটা হাস্যকর।
দ্বিতীয়ত, অনেকেই যৌক্তিক পদ্ধতি (Logical method) ব্যবহার করে স্রষ্টার অস্তিত্ব বুঝার জন্য।
কিন্তু এর দুর্বলতা হল যে, যুক্তি সবসময় ১ টা পূর্বলব্ধ ভিত্তি (Premise) এর উপর ভর করে চলে। যদি এই পূর্বলব্ধ ভিত্তি ভুল হয়ে থাকে তাহলে, যুক্তির উত্তরটি ভুল হবে। যেমন ধরুন, কেউ বলল, “কাঠ আগুনে পুড়ে, রফিকের নৌকাটি কাঠের তৈরি, তাই ওটাও আগুনে পুড়বে” এই কথাটি মিথ্যা হবে যদি, নৌকাটি পানিতে ডুবানো থাকে। এখন যুক্তি সবসময় যে পূর্বলব্ধ ভিত্তি নিয়ে কাজ করে তা যে স্বাভাবিক উপলব্ধিমূলক হবে তার কোন মানে নেই। অন্য একটা উদাহরণ দেই, “বাঙ্গালীরা দুর্নীতিবাজ, ফারযানা একজন বাঙ্গালী, সুতরাং সেও দুর্নীতিবাজ” এই কথাটা সত্যও হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে।
কোন নিশ্চয়তা নাই। তাই যুক্তি দিয়ে স্রষ্টাকে প্রমাণ করার প্রমাণ যেমন আছে, অপ্রমাণ করার প্রমাণ ও আছে। অতএব যৌক্তিক পদ্ধতি অবলম্বন করে কখনো চূড়ান্ত ও সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
এইবার আসি চিন্তার ঐ পদ্ধতিতে যা মানবজাতি সার্বজনীনভাবে তার জীবনের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যবহার করে থাকে। আর তা হল, বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতি (Rational method) এই পদ্ধতিতে মানুষ তার চারপাশের বস্তুসমুহকে তার ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করে।
সেই বস্তু সম্পর্কে তার কাছে কিছু পূর্বলব্ধ তথ্য (Previous information) থাকে। সেই পূর্বলব্ধ তথ্য কে ব্যবহার করে সে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। সব মানুষই এই পদ্ধতিতে চিন্তা করে থাকে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (Scientific Method) এবং যৌক্তিক পদ্ধতি (Logical method) কে বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতি (Rational method এর শাখা বলা যেতে পারে। মানুষ কিভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে, তার একটা উদাহরণ দেই।
যখন আপনার দরজায় কেউ টোকা দেয়, তখন আপনি কিন্তু মাপতে বসেন না যে, কত কম্পাংকে, তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে শব্দটা আসল, তারপর হিসাব করেন যে একজন মানুষ কত জোরে বা কত কম্পাংকে আঘাত করতে পারে, তারপর দরজা খুলেন। না, আমরা কেউই এইভাবে সিদ্ধান্ত নেইনা। বরং দরজায় টোকা দিলে তা আমরা ইন্দ্রিয় (শ্রবণ) দ্বারা উপলব্ধি করি, আমাদের মস্তিষ্কে এর ব্যপারে পূর্বলব্ধ তথ্য আছে যে, টোকা দেওয়ার মানে এই যে কেউ এসেছে, এবং তখন আমরা দরজা খোলার সিদ্ধান্ত নিই। এ থেকে আমরা বলতে পারি যে, বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নিতে যে কয়েকটি বিষয় থাকা প্রয়োজন তা হল
১. বাস্তবতা
২. ইন্দ্রিয় দ্বারা বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা
৩. বাস্তবতা সম্পর্কে পূর্বলব্ধ তথ্য
৪. পূর্বলব্ধ তথ্য এর সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সুস্থ, স্বাভাবিক মস্তিষ্ক।
এখন মনের মধ্যে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে, স্রষ্টার কোন বাস্তবতা আমাদের সামনে নেই যে আমরা তাকে ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করব, তাহলে স্রষ্টার অস্তিত্ব এই পদ্ধতিতে বুঝব কিভাবে?? ১০০% correct. আপনার দরজায় নক করলে আপনি দরজার বাইরে কারো অস্তিত্ব বুঝতে পারেন, কিন্তু যিনি নক করছে, তিনি কি পুরুষ না মহিলা, ফর্সা নাকি কালো তা কিন্তু বুঝার উপায় নেই।
কিন্তু তার অস্তিত্ব বুঝা যায়। আমাদের সামনে স্রষ্টার বাস্তবতা না থাকলেও সমস্যা নেই। আমাদের চারপাশে যে বস্তুসমুহ আছে, যাদেরকে আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করতে পারি, চলুন সেগুলোকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে গবেষণা করে দেখি। আমরা আমাদের আশপাশের প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করব, এবং দেখব আদৌ কোন স্রষ্টার প্রয়োজন আছে কিনা। এখানে মনে রাখতে হবে এই পদ্ধতিতে আমরা দেখব মহাবিশ্বের স্রষ্টা আছে কিনা, কিন্তু তিনি দেখতে কেমন, কিভাবে কাজ করেন তা বুদ্ধিবৃত্তিকভাব জানা সম্ভব নয়, কারণ উনি আমাদের ইন্দ্রিয়ের বাইরে, তাকে জানতে হলে একটা পদ্ধতিই আছে, আর তা হল উনি যদি নিজে থেকে আমাদেরকে জানান।
আমাদের চারপাশের প্রত্যেকটি বস্তুর মধ্যেই ২ টি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এরা প্রত্যেকেই সীমাবদ্ধ এবং নির্ভরশীল। যেমন, গাছ আকার আকৃতি, দ্বারা সীমাবদ্ধ এবং নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য সূর্য, পানি ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। মানুষ নানা দিক দিয়ে সীমাবদ্ধ এবং নির্ভরশীল। আলো তরঙ্গদৈর্ঘ্য, গতি দ্বারা সীমাবদ্ধ, নির্ভরশীল উৎস কিংবা রুপান্তর প্রক্রিয়ার উপর।
প্রত্যেকটি বস্তু নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল। এবং এরা কেউই নিজেরা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য দায়ী নয়। যদি তারা নিজেরা নিজেদেরকে অস্তিত্বে আনতে পারতো তাহলে তারা সীমাবদ্ধতা আর দুর্বলতার উর্ধ্বে থাকত। যদি ধরে নেই যে, নির্ভরশীলতায় তারা একে অপরের উপর নির্ভরশীল এবং কোন স্রষ্টার দরকার নেই, তাহলে আদিকাল থেকে চলে আসা ঘটনা বা বস্তুসমুহের সরুপ দাঁড়ায় .......... y। এইটা অসম্ভব, কারণ কোন শুরু না থাকলে, v, w, x, y এদের কারো অস্তিত্বে আসা সম্ভব নয়।
একটা উদাহরণ দেই। আপনি একটা ক্রিকেট দলের ১০ নাম্বার ব্যাটসম্যান। আপনি কয়জনের পর নামবেন? ৯ জনের পর। আপনি কোন দলের ১০০ তম ব্যাটসম্যান হলে নামবেন ৯৯ জনের পর। আপনার দলে যদি অসীম সংখ্যক ব্যাটসম্যান থাকে, তাহলে আপনি কবে নামবেন? কখনই নামবেন না, কারন আপনার পূর্বে অসীম সংখ্যক ব্যাটসম্যান আছে (অর্থাৎ শুরুও নাই, শেষ ও নাই) আপনার আগেরজনের পূর্বেও অসীম সংখ্যক, তার আগের জনের পূর্বেও অসীম সংখ্যক।
সুতরাং কোন ব্যাটসম্যানই নামতে পারবেনা, কারণ প্রত্যেকের পূর্বেই আছে অসীম সংখ্যক। অর্থাৎ কোন শুরু যদি না থাকে তাহলে কেউই অস্তিত্বে বিরাজমান করেনা। অসীম এই শব্দটা শুধু গাণিতিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, বাস্তবতায় কোন কিছুই অসীম নয় (আমাদের চেনা বাস্তবতায়)। সুতরাং একটা শুরু আছে এমন আরেকটা উদাহরণ দেই, আপনাকে যদি বলি ১০ থেকে শুরু করে ৯৯ পর্যন্ত গুনে আসেন, আপনি গুণতে পারবেন, কিন্তু যদি বলা হয়, অসীম থেকে শুরু করে ৯৯ পর্যন্ত গুনেন, এটা অসম্ভব। আপনি শুরুই করতে পারবেন না এবং ৯৯ তেও আসতে পারবেন না।
৯৯ তে আসতে হলে শুরু আপনাকে করতেই হবে। সুতরাং মহাবিশ্বের শুরু আছে, এবং সে নিজে নিজে তা শুরু করেনি।
অপেক্ষা করুন তারা এখনো আশা ছেড়ে দেয়নি, তারা বলছে zyxwvz অর্থাৎ এটা একটা বৃত্তাকার চক্র। সুন্দর অর্থাৎ z থেকে শুরু হয়ে আবার z এ এসে মিশেছে। এবং z হল সূচনাকারী অর্থাৎ চক্রটাকে ছোট করলে হয় যে z ও y (প্রথম আর শেষ বস্তু)... সুতরাং z, y এর উপর নির্ভরশীল, আর y, z এর উপর নির্ভরশীল।
কিন্তু z না থাকলে তো y existence এ আসতে পারেনা, আবার y না থাকলে z আসতে পারেনা। তাহলে হয় দুইজন একইসাথে অস্তিত্বশীল করে অথবা দুইজনই তাদের অস্তিত্বে আসার জন্য এই বৃত্তের বাইরে তাদের কোন স্রষ্টার উপর নির্ভরশীল।
দুইজন একসাথে অস্তিত্বে থাকলে সমস্যা আছে। তাহলে পৃথিবীর তথা মহাবিশ্বের সব ঘটনাকে একসাথে অস্তিত্বে থাকতে করতে হবে। অর্থাৎ আমি, আমার দাদা, আমার দাদার দাদার দাদার দাদা, আমার নাতি, আমার নাতির নাতির নাতি সবাইকে একসাথে অস্তিত্বে থাকতে হবে।
কিন্তু আমরা বাস্তবতায় এটা দেখিনা। উপরন্তু z যেহেতু y এর উপর নির্ভরশীল, সেহেতু Y এর এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা সূচনাকারী z এর নাই। তার মানে y, তার অস্তিত্তের জন্য z এর উপর নির্ভরশীল নয়, একইভাবে z এর কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যার কারণ y নয়। তাই z ও y এর উপর নির্ভরশীল নয়। এরা প্রত্যেকেই এদের অস্তিত্বের জন্য এদের চক্রের বাইরের কারো উপর নির্ভরশীল।
সুতরাং মহাবিশ্ব নিজেকে নিজে অস্তিত্বে আনেনি, এবং এর পুরো অস্তিত্ব অন্য কারো উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা আছে। এবং সেই স্রষ্টা মহাবিশ্বের উপর নির্ভরশীল নন, কারণ তাহলে তিনিও চক্রের মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং তিনিও অস্তিত্বের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সুতরাং আমরা সিদ্ধান্তে আসলাম এই মহাবিশ্বের অস্তিত্বের জন্য একজন স্রষ্টা থাকা অপরিহার্য। স্রষ্টা ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব অসম্ভব।
সুতরাং পরের আলোচনা হতে পারে,
Who is the Creator of the Creator…..
উৎসঃ Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।