আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন অপ্রতিরোধ্য শাহীন চাকলাদার

Every emotion have a feelings. But every feelings have no emotion. এক যুগ আগেও একটি ওষুধের দোকান চালাতেন। এখন সরকারি দল আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যান। মাত্র ১২ বছরের ব্যবধানে বিপুল অর্থবিত্তের মালিকও হয়েছেন তিনি। যশোরের রাজনীতি যাঁরা জানেন, বোঝেন, তাঁদের বলে দিতে হবে না যে লোকটির নাম শাহীন চাকলাদার। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই আলোচিত চরিত্রে পরিণত হন তিনি।

আর তাঁর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যশোরে তিনি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন। তাঁর দাপটে রাজনীতি থেকে প্রায় উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরিফ আবদুর রাকিবের কাছে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে শাহীন চাকলাদার এসেছিলেন একটি ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার তদবির করতে। শাহীন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দূর সম্পর্কের আত্মীয়তার সূত্রে রাকিবকে খালু বলে ডাকতেন তখন। রাকিবের কাছে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথমে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। পরে আলাপচারিতার একপর্যায়ে তিনি নিজেই জানালেন, আওয়ামী লীগ আগেরবার ক্ষমতায় আসার পর যশোর রোডে বন্যানিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত একটি ঠিকাদারি কাজ পেতে তদবির নিয়ে এসেছিলেন শাহীন।

তখনো তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চাকলাদার কনস্ট্রাকশনসের হাতে তেমন বড় কোনো কাজ ছিল না। তাই অন্য কোনো একটা নামে কাজটা পাইয়ে দিয়েছিলেন। যশোর-বেনাপোল সড়কের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পুনর্বাসনের জন্য প্রায় ২০ কোটি টাকার ওই কাজটি পাইয়ে দিয়েছিলেন শরিফ আবদুর রাকিব। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য শেখ হেলালের পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগে আগন্তুক শাহীন চাকলাদারকে। এই পরিচয়ের সূত্রেই পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে চলে এলেন তিনি।

শাহীন বললেন, ‘আমি রাকিব সাহেবকে সব সময়ই ভাই বলে ডাকি। তাঁর মাধ্যমে কোনো কাজ পাইনি। বরং ঝিনাইদহ অঞ্চলের এক-দেড় কোটি টাকার কাজের ব্যাপারে অনুরোধ করে বিব্রত হয়েছিলাম। ’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাহীন চাকলাদারের এক বন্ধু জানান, শুধু ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার জন্যই আওয়ামী লীগের সেই সময়কার সাধারণ সম্পাদক রাকিবের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেননি শাহীন। আত্মরক্ষা করতে চেয়েছিলেন ছাত্রলীগের তত্কালীন সভাপতি জিল্লুর রহমান ওরফে মিন্টুর আক্রমণ থেকে।

সরেজমিন অনুসন্ধানের সময় জানা যায়, মিন্টুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে গিয়ে শাহীন চাকলাদার সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন, যার ধারাবাহিকতায় তিনি এখন নব্য গডফাদারে পরিণত হয়েছেন। সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতায় নিজের দল থেকে শুরু করে প্রশাসন পর্যন্ত সর্বত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। উত্থানের এ কাহিনি সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহীন চাকলাদার বলেন, এক সময় জামান ফার্মেসি নামের যে ওষুধের দোকানটি চালানোর দায়িত্ব পারিবারিকভাবে তাঁর ওপর অর্পিত হয়েছিল, সেটি কোনো ছোটখাটো ফার্মেসি ছিল না। তা ছাড়া পরিবারের গার্মেন্টস, ঠিকাদারি ও পরিবহনসহ নানা ব্যবসায় তাঁকে ভূমিকা রাখতে হয়েছিল। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিজেকে কোনো আগন্তুক হিসেবে মানতে নারাজ।

তাঁর দাবি, তাঁরা পারিবারিকভাবেই আওয়ামী লীগের অনুসারী। ছাত্রজীবনে সংগঠনের কোনো পদ-পদবিতে না থাকলেও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, ‘আমি আসলে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। আর সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মিডিয়া আমাকে গডফাদার বানানোর ব্রত নিয়েছে। ’ নিজেকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার বলে যে দাবি করেছেন শাহীন চাকলাদার, গণভবনে সন্ত্রাসীদের বহর নিয়ে উপস্থিত হয়ে নিজেই সেই দাবির অসারতা প্রমাণ করেছেন।

বর্তমান সরকারের প্রথম বছরে একটি গোয়েন্দা সংস্থা শাহীনকে সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক অভিহিত করে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগে তাঁর রাশ টেনে ধরার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দিয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল। ফলাফল যে শূন্য, তা ওই প্রতিবেদন পাঠানোর প্রায় তিন বছর পর বোঝা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বসার যে কর্মসূচি নিয়েছিলেন, তার অংশ হিসেবে ২ ফেব্রুয়ারি ডাক পড়ে যশোর জেলার। নিয়মানুযায়ী তৃণমূলের ওই প্রতিনিধি সভায় আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সব সদস্য এবং উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু শাহীন নির্ধারিত প্রতিনিধিদের বাইরে অতি-উত্সাহী শতাধিক লোক নিয়ে উপস্থিত হন সম্মেলনে।

যার মধ্যে শাহীনের সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান সাহারুল ইসলামের নেতৃত্বে ভুট্টো, হাফিজ, দাঁতাল বাবু, টাক শিপন, বুনো আসাদ, নবাব, উপল, মিন্টু, ফিরোজ, মামুন, হালিম, রিপন, ডিম রিপন, ফুলু, মিঠু, সেতু, জিতু, ক্বারী আশরাফ, আবদুল লতিফ, আশফাক, বাবু, বিল্লাল, আনিস, শামীম, মোমিন, হজরতসহ গোটা ত্রিশ-চল্লিশেক সন্ত্রাসী ছিলেন। জানা যায়, এরই মধ্যে এই সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ আবার পক্ষ বদল করেছেন। টাক শিপন কখনো আলী রেজা রাজুর এবং কখনো আবার শাহীন চাকলাদারের ছায়ায় অবস্থান নেন। টাক শিপন ও উপল ছাত্রলীগের সম্মেলনে বোমা হামলা ও সহিংস ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সেতু ও জিতু গ্রেপ্তার হয়েছিলেন খুনের মামলায়।

উপল খুন ও চাঁদাবাজির আট মামলার আসামি। ছাত্রলীগের নেতা শান্ত-মামুন-হালিমের নেতৃত্বাধীন পক্ষটি আর এন রোডের ফেনসিডিল ব্যবসার বড় নিয়ন্ত্রক। তাঁদের আছে একটি ছিনতাইকারী চক্র। শান্ত বিভিন্ন সময় ধর্ষণ ও ছিনতাই মামলায় গ্রেপ্তারও হন। পুলিশের তালিকার ৩৬ নম্বর সন্ত্রাসী বুনো আসাদের বিরুদ্ধে হত্যা-ছিনতাই-চাঁদাবাজির সাতটি মামলা রয়েছে।

আর তাঁদের নেতা সাহারুল ইসলামের নাম রয়েছে সব কটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে বাছাই করে যশোর জেলার ৩০২ সন্ত্রাসীর যে তালিকা করা হয়েছে, সেই তালিকার শীর্ষভাগে। শাহীন চাকলাদারের হয়ে সদর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে মারধর করার অভিযোগে মামলা হয়েছিল সাহারুলের নামে। তিনি ছাত্রলীগের নেতা রিপন হোসেন ওরফে দাদা রিপন হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। ওই ঘটনার পরপর সাংসদ খালেদুর রহমান টিটো সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘যারা রিপনকে হত্যা করেছে, তারা আওয়ামী লীগের সদর উপজেলার সাংগঠনিক সম্পাদক সাহারুল ইসলামের লোক। ’ টিটো সাহারুলকে শাহীন চাকলাদারের খাস ক্যাডার আখ্যায়িত করে আরও বলেছিলেন, সাহারুলকে রিমান্ডে নিলেই সব তথ্য বেরিয়ে আসবে।

তৃণমূলের ওই কর্মিসভায় একজন প্রতিনিধি ছিলেন যশোর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ। গণভবনে সন্ত্রাসীদের নিয়ে যাওয়ার কথা জানতে চাইলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। সন্ত্রাসীদের নাম জানাতে বললে বলেন, ‘সাহারুল, ভুট্টো ও হাফিজের নেতৃত্বে ৩০-৪০ জন সন্ত্রাসীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওই সভায়, যাঁদের সবার নাম আমার জানা নেই। ’ আপনারা কেউ প্রতিবাদ করলেন না কেন? উত্তরে মোহিত কুমার বলেন, ‘আমি আমার বক্তব্যে যশোরে একের পর এক খুন-সন্ত্রাসের নেপথ্য কাহিনি তুলে ধরার সময় প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রীকে বলেছি, “আপনার এ গণভবনে যেখানে রয়েছে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা, সেখানেও নিয়ে আসা হয়েছে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের। ” তখন উপস্থিত সন্ত্রাসীদের চিত্কারে একপর্যায়ে কথা থামিয়ে দিতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী।

’ মোহিত কুমারের বক্তব্যের সময় বাধা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন সাহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মোহিত গণহারে সবাইকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করছিলেন। আমাদের নেতা শাহীন চাকলাদার এবং সাংসদদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছিলেন। ’ সাহারুলকে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা বিভিন্ন মামলার কথা মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘রাজনীতি করতে গেলে নানান মিথ্যা মামলার শিকার হওয়া লাগে। তাই বলে আমাদের সন্ত্রাসী বলা উচিত হবে না।

’ শাহীন চাকলাদারের কাছে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বললেন, সাহারুলের মতো দক্ষ ও নিবেদিত কর্মী একটা দলের মধ্যে খুব বেশি থাকে না। যে মোহিত এখন সাহারুলের নিন্দায় পঞ্চমুখ, তাঁর হাতেই সাহারুলের রাজনীতির হাতেখড়ি। মোহিত ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আলী রেজা রাজুর বিরুদ্ধে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী কাজী শাহেদ আহমেদের নির্বাচন করায় সাহারুলরা তাঁকে ছেড়ে এসেছেন। আরও বললেন, দলের নেতা হিসেবে আর উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর সঙ্গে লোকজন ঘুরবে, থাকবে—এটাই তো স্বাভাবিক। শাহীন চাকলাদার বললেন, তিনি তৃণমূলের কর্মিসভায় অননুমোদিত কাউকে নিয়ে যাননি।

তবে আওয়ামী লীগের নিবেদিত শ খানেক কর্মী সভানেত্রীর দেখা পাওয়ার আশায় গণভবনের বাইরে ভিড় করেছিল। সভানেত্রীর অনুমতিসাপেক্ষে তাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার অভিযোগ নাকচ করলেও শাহীন চাকলাদার নিজে যে সবসময় সন্ত্রাসী হামলার আতঙ্কে ভোগেন, তা তাঁর অফিস ও বাড়িতে বসানো ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দেখেই বোঝা যায়। তাঁর নিরাপত্তার জন্য সরকার অনুমোদিত গ্যানম্যানও আছে। তিনি যখন প্রকাশ্যে চলাফেরা করেন তখন তাঁর গাড়িতে তিন-চারজন ব্যক্তিগত প্রহরী থাকেন।

প্রায় সময়ই তাঁর গাড়িকে অনুসরণ করে গোটা দশেক মোটরসাইকেল চলতে দেখা যায়। শাহীন চাকলাদারের দাবি, ‘আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে গিয়ে এমন অনেক সিদ্ধান্তই আমাকে নিতে হয়েছে, যে কারণে অনেক মিত্রও শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এ জন্যই আমার নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে। ’  ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.